মিনিকেট চালের নামে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
এখন বাজার সয়লাব মিনিকেট নামের চালে। গত দুই দশক ধরেই খাবার টেবিলে তা শোভা বাড়াচ্ছে। কারণ এ থেকে চিকন ও সাদা ভাত হয়। তবে এ ধান কোথা থেকে আসে, কীভাবে মিনিকেট চাল হয়ে যায় তা ভোক্তাদের অজানা। এই চাল নিয়ে অসাধু ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যের ফলে একদিকে যেমন ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছেন; অন্যদিকে, অতিমাত্রায় ছাঁটাইয়ের ফলে চালের পুষ্টিমান কমে গিয়ে তা শরীরের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। চাল ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে মিল মালিকরা প্রতারণা করছেন। পলিশিং করে মিলগুলো চালকে চিকন করে। এতে অনেক পুষ্টিগুণ চলে যায়। কোন জাতের চাল এ বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে মিলগুলো নিজেদের মতো ব্র্যান্ড দাঁড় করিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের ভেজালের খপ্পরে কৃষিতে সরকারের নানা উদ্যোগের সুফলভোগী হতে পারছে না সাধারণ মানুষ। দেশে-বিদেশে মিনিকেট নামের কোনো ধান নেই। বাজারে এ নামে রং-বেরঙের নানা বস্তাবন্দি যে চাল পাওয়া যায় তা আসলে মোটা চাল মেশিনে ছেঁটে সরু করে অটোরাইস মিল মালিকরা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে ভোক্তাদের বোকা বানানোর এ কাজ করছেন মিল মালিকরা। নজরদারি না থাকায় মোটা চাল সরু করার এ প্রতারণা ঠেকানো যাচ্ছে না। মোটা চাল রোলার ক্রাশিং মেশিনে সাত ধাপে চিকন ও উজ্জ্বল করে মিনিকেট চাল করা হয়। মোটা চাল কেটে প্রথমে পোল্ট্রি ফিডসহ গরু-ছাগলের খাদ্য বের করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে রাইসব্রেন তেল উৎপাদন করা হয়। মোটা চালকে ওভার পলিশিং করে একাধিক বাই প্রোডাক্ট বের করা হয়। প্রতি ১০ মণ মোটা ধান থেকে মিনিকেট চাল পাওয়া যায় সাড়ে ছয় মণ। উচ্চমূল্যের হ্যাচারি ফিড পাওয়া যায় ৫০ কেজি, রাইস ব্র্যান তেল পাওয়া যায় ৫০ থেকে ৬০ কেজি। এগুলোর বাইরে পশুখাদ্য, কালো চাল বা খুদ পাওয়া যায় ১২ থেকে ২০ কেজি। কুঁড়া হয় প্রায় ৭০ কেজি। এরপর মোমপলিশ দিয়ে মিনিকেট চালকে সিল্কি করা হয়। চালের উপরের বাদামি আবরণ তুলতে রাসায়নিক পাউডার ব্যবহার করে চালকে সাদা করা হয়। কাপড় ধোঁয়ার ডিটারজেন্ট গুড়া ব্যবহার করে চালকে চকচকে ও পিচ্ছিল করা হয়। চালে পোঁকা না ধরতে দেওয়া হয় বিষাক্ত কীটনাশক ও ইউরিয়া সার। অন্যান্য চালে সাধারণত নরম আভরণের একটি মুখ দেখা যায়, অথচ মাত্রাতিরিক্ত ছাঁটাইয়ের কারণে মিনিকেটে চালে কোন মুখ খুঁজে পাওয়া যায় না। এ চালের ভাতে ঘ্রাণ ও স্বাদ নেই। অধিক ছাঁটাই করা এসব চাল কার্বোহাইড্রেট বা শর্করায় ভরা। চালের উপরিভাগের পুষ্টিগুণ কিছুই থাকে না। শুধু শর্করা খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিসসহ নানা রোগের জটিলতা বাড়ছে ভোক্তাদের। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিনিকেট চালের নামে কি খাচ্ছে মানুষ। এ যেন টাকা দিয়ে বিষ কিনে খাওয়ার শামিল। বারডেমের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. ইশরাত জাহান জানান, চালের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাই করা হচ্ছে স্বাভাবিক বা সহনীয় মাত্রা। এর বেশি হলেই তা পুষ্টি ও উপকারী খনিজ মান হারিয়ে যায়। কারণ চালের উপরিভাগেই এগুলো থাকে। বাকিটা থাকে কার্বোহাইড্রেট। দেশে অদক্ষ চালকল চালকরা ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চাল কেটে চিকন ও স্বচ্ছ করে থাকে। ফলে মানুষ যে ভাত খাচ্ছে সেটা শুধুই কার্বোহাইড্রেট। ফলে ডায়াবেটিস, স্থূলতাসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। সাদা চাল দেখতে সুন্দর, চকচকে আর পোঁকা ধরে না। বাদামি চালে যে ফসফরাস থাকে, সেটি মানব দেহে জিংক গ্রহণে বাধা প্রদান করে। চালকে সাদা ও চিকন করার ফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, খনিজ ও আঁশ হারিয়ে যায়। আঁশের পরিমাণ কম থাকায় পরিপাকে খুব তাড়াতাড়ি শর্করা ভেঙে উৎপন্ন চিনি রক্তে চলে যায়। ময়মনসিংহের শুম্ভুগঞ্জের একটি বড় অটো রাইস মিলের সাবেক ম্যানেজার আব্দুল করিম জানান, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা ধান কিনে পরিষ্কার করা হয়। এরপর তিন থেকে পাঁচবার ধান সিদ্ধ করা হয়। এর কারণ হচ্ছে- শক্ত না হলে ছাঁটাইয়ের সময় চাল ভেঙে যেতে পারে। এরপর অটো মেশিনের ঘর্ষণের মাধ্যমে ধানের বাইরের খসখসে খোসাটিকে সরিয়ে ফেলা হয়। এর ওজন ধানের ওজনের প্রায় ২০ শতাংশ। এরপর বাদামি চাল চিকন ও চকচকে সাদা করতে ব্যবহার করা হয় হোয়াইটেনার ও পলিশার নামের দুটি যন্ত্র। সেখানে মূলত ঘর্ষণকে কাজে লাগিয়ে চাল চিকন করা হয়। এতে সম্পূর্ণ দূর হয়ে যায় ফলত্বক, বীজত্বক ও ভ্রূণ। এই দূর হওয়া অংশের ওজন মূল চালের ১০ থেকে ১২ শতাংশ। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মেশিনে বেস্নন্ডিং করে কেটে ছেঁটে পলিশ করা হয়। মোটা চালের ফলে দেওয়া অংশ দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের পশুখাদ্য। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি কেজি মোটা চাল ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় কিনেন অটো রাইসমিলের মালিকরা। সেই মোটা চাল চিকন করতে খরচ হয় দুই থেকে তিন টাকা। বাই প্রোডাক্ট বিক্রি করেই লাভবান হন মালিকরা। আবার চাল বিক্রি করেও বড় মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব বড় অটো রাইস মিলগুলো। বাজারে ক্রেতারা ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজিতে মিনিকেট চাল কিনতে হয়। ধান চাল নিয়ে যারা কাজ করে তারা সবাই এই নয়-ছয় সম্পর্কে জানে। অন্য যে কোনো চালের তুলনায় মিনিকেট বা নাজিরশাইল কিছুটা চিকন, রঙও ফর্সা এবং চালে পোকা ধরে না। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রীত চালের একটি মিনিকেট চাল। অথচ এই নামে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোনো দেশেই এই ধান নেই। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে মিনিকেট ও নাজিরশাইল বলে কোনো ধান নেই। অন্যদিকে, নতুন নতুন কোম্পানি মিনিকেট ও নাজিরশাইলের প্যাকেট করে চড়া দামে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ করেছেন কৃষিমন্ত্রী। ঝকঝকে চালে ক্রেতার আগ্রহ বেশি। ধান থেকে চাল হওয়ার পর তা ব্রান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে দেশে কোনো নীতিমালা নেই। এ সুযোগে অনেক ব্যক্তি ও কোম্পানি নিজের ইচ্ছামতো চালের নামকরণ করে- যা ইতোমধ্যে জনপ্রিয় ওয়ে উঠেছে। গত এক দশক ধরে মিনিকেট চাল নিয়ে চোর-পুঁলিশ খেলা চলছে। এখনো কোনো কৃষক বা ধান বীজ কোম্পানি বাস্তবে মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাত দেখাতে পারেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্রি- ২৮ এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্রি-২৯ ধান মাত্রাতিরিক্ত ছাঁটাই করে, চাল বারবার কেটে এবং রাবার রোলারে ক্রাসিং করে মিনিকেট নামে বাজারজাত করা হয়। একইভাবে ব্রি-২৯ ধান অধিক ছাঁটাই ও পলিশ করে চালের নাম দেওয়া হয় নাজিরশাইল। দ্বিগুণ দামে মিনিকেট চাল কিনে ভোক্তারা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অটো রাইসমিলের অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চক্র। অবশেষে টনক নড়ছে কর্তৃপক্ষের। নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে মিনিকেট চাল। দেশে মিনিকেট আর নাজিরশাইল বলতে কোনো ধান নেই। অন্য জাতের ধানকে এসব ধানের চাল বলে বিক্রি করা হচ্ছে। বিআর-২৮-২৯ ধানকে মিনিকেট বলে বিক্রি করা হচ্ছে। যা প্রতারণার শামিল। এ জন্য মিনিকেট ও নাজিরশাইল নিষিদ্ধ হচ্ছে। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, মিনিকেট চাল তৈরির যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হচ্ছে, অটোরাইস মিলে এমন অতিবেগুনি রশ্মি রয়েছে যার ডিজিটাল সেন্সর চাল থেকে সব কালো বা নষ্ট চাল, পাথর, ময়লা সরিয়ে ফেলে। তারপর এ চাল চলে যায় অটোমিলের ব্রয়লার ইউনিটে। সেখানে ছয় ধাপে পলিশ করার মাধ্যমে মোটা চাল সাদা রং ধারণ করে। এরপর পলিশিং মেশিনে মোটা চাল কেটে চিকন করা হয়। আর চকচকে করার জন্য ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের ক্যামিকেল। অনুসন্ধানে জানান যায়, দেশের বাজারে থাকা চালের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত ১০২টি জাতের ধান থেকে। বাকি ধান আসে কৃষককের সংরক্ষিত বীজ ধান, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বিনা, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি কয়েকটি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদালয় উদ্ভাবিত ধানের জাত থেকে। দেশে বর্তমানে ১১৭টি ধানের জাত রয়েছে। এর মধ্যে বোরো ও আমন মৌসুমে ব্যাপকভাবে চাষ হয় ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ধান। অথচ বাজার সয়লাব বিভিন্ন মানের মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালে। বড় বড় অটো রাইস মিলের মালিকরা তাদের মিলের নামে ৫০ কেজি, ২০ কেজি বা ২৫ কেজির বস্তায় মিনিকেট লিখে বাজারজাত করছে। বর্তমানে মিনিকেট চালের বাজার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। কৃষিবিদ ড. আব্দুল ওয়াহাব বলেন, দেশে মিনিকেট নামের কোনো ধান নেই। ১৯৯৫ সালের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন জাতের চিকন 'শতাব্দী' ধানের বীজ বিতরণ করে। ২৫ কেজি ওই ধানের বীজের সঙ্গে ৫ কেজি কীটনাশকসহ একটি মিনিপ্যাকেট দেয়া হয়। যাকে 'মিনি কিটস' বলা হতো। 'মিনি প্যাকেট' বা 'মিনি কিটস' থেকেই এক পর্যায়ে মিনিকেট নামটি দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে বোরো মৌসুমে সেই মিনি প্যাকেটের শতাব্দী ধানের বীজ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের হাতে পৌঁছে যায়। ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তবর্তী মহেশপুর উপজেলার চাষিরা প্রথম এ ধানের চাষ করেন। দেরিতে হলেও সরকার এখন এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।