মুক্তা আভিজাত্যের প্রতীক যেমন, তেমনি এর রহস্যময়তায় বিশ্বাসী অনেকে। ব্রিটেনের প্রয়াত রানি এলিজাবেথ, ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ব্রিটেনের প্রিন্সেস ডায়ানা, হলিউড অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো, পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্টমন্ত্রী হিনা রব্বানী প্রমুখ বিশ্ব ব্যক্তিত্বের মুক্তার প্রতি ছিল বিশেষ আকর্ষণ। দেশের পুকুর-দীঘি, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, নদী-নালা ও জলাশয়ে মাছের সঙ্গে ঝিনুকে মুক্তাচাষ করে প্রতি একরে ৪০ লাখ টাকা অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা।
বর্তমানে নতুন সম্ভাবনা হচ্ছে মুক্তা চাষ। এতে বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রা আয়।
বিএফআরআই ইতোমধ্যে ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্রের পুকুরে স্বল্পসময়ে মিঠাপানির ঝিনুক থেকে মুক্তা উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছেন। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত মুক্তা বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর ১৫০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। একই সঙ্গে এতে ২০ থেকে ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, আমাদের বঙ্গোপসাগর ছিল প্রাকৃতিক মুক্তার আবাসস্থল। বাংলাদেশের মহেশখালী ছিল 'পিংক পার্ল' বা গোলাপি মুক্তার জন্য জগদ্বিখ্যাত।
বাংলাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পুকুর-দীঘি, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়। এসব জলাশয় মুক্তা বহনকারী ঝিনুকে পরিপূর্ণ। দেশের প্রায় সর্বত্রই মুক্তা বহনকারী ঝিনুক পাওয়া যায়। তবে গুণগত উৎকর্ষসম্পন্ন গোলাপি মুক্তা বৃহত্তর ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, ফরিদপুর, পাবনা, কুমিলস্না ও চট্টগ্রামে বেশি পাওয়া যায়। প্রাচীনকাল থেকেই দেশের সর্বত্র কমবেশি মিঠাপানির ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলে আসছে।
মিঠাপানির ঝিনুকে উৎপাদিত মুক্তার আন্তর্জাতিক চাহিদা রয়েছে। ইউরোপের বাজারে ছোট মুক্তার চাহিদা বেশি। কিছু দিন আগে নেদারল্যান্ড থেকে এক মহিলা উদ্যোক্তা ইনস্টিটিউটে এসে বাণিজ্যিকভাবে এ দেশের মিঠাপানির মুক্তা (যা রাইস পার্ল নামে খ্যাত) উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিপণনের আগ্রহ দেখিয়েছেন। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, একটি ঝিনুকে ১০ থেকে ১২টি মুক্তা জন্মে। প্রতিটি মুক্তার খুচরা মূল্য ৫০ টাকা। প্রতি শতাংশে ৬০ থেকে ১০০টি ঝিনুক চাষ করা যায়। এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতি শতাংশে ৮০টি ঝিনুকে গড়ে ১০টি করে ৮০০ মুক্তা পাওয়া যায়- যার বাজারমূল্য ৪০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে প্রতি একরে ৪০ লাখ টাকার মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব। কাজেই মাছের সাথী ফসল হিসেবে মুক্তাচাষ খুবই লাভজনক।
বিএফআরআই ১৯৯৯-০১ সালে ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্রে ও কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রে গবেষণা করা হয়। ময়মনসিংহের প্রথম গবেষণায় দু-তিন মিলিমিটার সাইজের মুক্তা তৈরিতে সময় লেগেছিল দেড় থেকে দুই বছর। এরপর অর্থাভাবে মুক্তা গবেষণা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১০-১১ অর্থবছরে একটি 'কোর' গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ঝিনুকে মেন্টাল টিসু্য ঢুকিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গভীরতার পুকুরে ছেড়ে দেয়া হয় এবং নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। এতে পাঁচ মাসেই ঝিনুকে দুই থেকে তিন মিলিমিটার আকারের মুক্তা জন্মে- যা 'রাইস পার্ল' নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বছরব্যাপী চাষ করা হলে মুক্তার আকার আরো বড় করা সম্ভব হবে। গ্রামীণ যে কোনো পরিবেশে বাড়ির আঙ্গিনায় ছোট-বড় পুকুরে মাছের সঙ্গে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে মুক্তা চাষ করা সম্ভব। মুক্তা চাষে মাছের কোনো ক্ষতি হয় না। ঝিনুকের জন্য পৃথক কোনো খাবার দিতে হয় না। তিনি আরো জানান, আগে মুক্তা উৎপাদন করতে প্রায় দুই বছর লাগত। এজন্য মুক্তা চাষে অনেকেই আগ্রহী ছিলেন না। এবার স্বল্পসময়ে মুক্তা উৎপাদনে সফল হওয়ায় অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন। গ্রামীণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজের অবসরে বাড়ির আঙিনার পুকুরে মুক্তা চাষে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারবেন।
শখের বশে নিজের ৪০ শতাংশ জায়গার ওপর পুকুরে ৫শ' ঝিনুক দিয়ে চাষ শুরু করেন তিনি। প্রথম দিকে লাভ না হলেও বর্তমানে মুক্তা চাষে সফল হয়েছেন তিনি। তার উৎপাদিত মুক্তা এখন দেশের বিভিন্ন বাজারের পাশাপাশি ভারতেও বিক্রি হচ্ছে। এদিকে মুক্তা চাষ করে এলাকার বেকারত্ব দূর করতে তিনি কয়েকজনকে দিয়েছেন চাকরি। তারাও মুক্তা চাষের পুরো প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরা মুক্তা চাষ করছেন, পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা পেলে এই মুক্তা দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করেন মুক্তা চাষি নাজিম উদ্দিন।
শখের বশে নিজের ৪০ শতাংশ জায়গার পুকুরে মাছের পাশাপাশি সাত হাজার টাকা খরচ করে ৫শ' ঝিনুক দিয়ে চাষ শুরু করেছিলেন নাজিম উদ্দিন। শুরুতেই তার অধিকাংশ মুক্তা মারা যায়। হতাশ হয়ে যান তিনি। কিন্তু পরে ২০১৮ সালে ময়মনসিংহ মুক্তা গবেষণা কেন্দ্রে মুক্তার ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তা চাষের কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন। ২০১৯ সালে হাওড়সহ বিভিন্ন নদনদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে ৭ হাজার টাকা খরচ করে ৮শ' ঝিনুক দিয়ে চাষ শুরু করেন। এ সময় কিছু ঝিনুক মারা গেলেও বছর শেষে উৎপাদিত মুক্তা প্রায় ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন তিনি। এরপর থেকে মুক্তা চাষে আগ্রহ বেড়ে যায় নাজিম উদ্দিনের। তিনি বাণিজ্যিকভাবে নেমে যান মুক্তা চাষে।
মুক্তা চাষি নাজিম উদ্দিন বলেন, মাছের পাশাপাশি মুক্তা চাষ শুরু করি শখের বশে। হাওড়সহ নদনদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করে 'অপারেশনের' মাধ্যমে মুক্তা চাষ করতে হয়। ঝিনুকের খোলসের ভেতরের শিরা কেটে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মুক্তা তৈরির জন্য সেটিং করা হয়, আর একেই বলা হয় 'অপারেশন'। একটি ঝিনুকে ২ থেকে ৩টি মুক্তা জন্ম নিতে পারে। প্রায় ১০ মাস পর প্রতিটি ঝিনুক থেকে পরিপূর্ণ মুক্তা পাওয়া যায়। মুক্তার দুটি ধরন রয়েছে। একটি রাইচ মুক্তা আরেকটি ইমেজ মুক্তা। ইমেজ মুক্তার চাহিদা বেশি। নাজিম উদ্দিন বলেন, মুক্তা চাষ করে প্রথমে লোকসান হলেও এখন মুক্তা চাষে লাভে আছি। বাংলাদেশের জুয়েলারির দোকান ছাড়া মুক্তা বিক্রি করা যায় না। সরকারি চাকরিজীবী, এনজিওকর্মী, ইউনিসেফ প্রতিনিধিসহ অনেকে আমার কাছ থেকে মুক্তা কিনেন এবং এখান থেকে দেশের পাশাপাশি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মুক্তা বিক্রি করছি। মুক্তাচাষ করে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। এতে দূর হবে হাওড়াঞ্চলের বেকার সমস্যা। তিনি জানান, হাওড়াঞ্চলে মুক্তা চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্বাদু পানিতে মুক্তাচাষ করে সফলতা পেয়েছেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার এক্তারপুর গ্রামের মো. আব্দুর রহমান নামে এক কলেজছাত্র। পরীক্ষামূলক প্রকল্প হলেও এরই মধ্যে মুক্তা আহরণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন তিনি। তার সাফল্যে অন্য বেকার যুবকরাও ঝুঁকছেন এ পেশায়। জানা গেছে, করোনাকালে ইউটিউবে ঝিনুক থেকে মুক্তাচাষের পদ্ধতি দেখে তিনি উৎসাহিত হন। এ আর এগ্রো ফার্মিং মুক্তাচাষ ট্রেনিং সেন্টার খুলে অনেক বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করে দিয়েছেন ওই যুবক। আব্দুর রহমান এক্তারপুর গ্রামের কবির হেসেনের ছেলে। আব্দুর রহমান বলেন, ২০২০ সালে করোনার সময়ে বাড়িতে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি ইউটিউবে ঝিনুক থেকে মুক্তাচাষের পদ্ধতি দেখে উদ্বুদ্ধ হই। এরপর এটা নিয়ে কিছুদিন গবেষণা করি। প্রথম দিকে দুটি ঝিনুক সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে সাফল্য পেয়ে আমি পরবর্তী সময়ে ৫০০ ঝিনুক নিয়ে কাজ শুরু করি। ৫০০ ঝিনুক থেকে এখন তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজারে। এখন প্রতি মাসে কয়েক হাজার টাকার মুক্তা বিক্রি করেন তরুণ এই উদ্যোক্তা। সরজমিনে দেখা যায়, তার বাড়ির ছাদে ২০ ফুট ও ১০ ফুট একটি পানির হাউস আছে। পানিতে ঝিনুকের পাশাপাশি ছোট ছোট রঙিন মাছ খেলা করতে দেখা যায়। ঝিনুক থেকে কীভাবে মুক্তাচাষ করা হয় জানতে চাইলে আব্দুর রহমান জানান, মুক্তা এমন একটি রত্ন- যা পেতে ঝিনুককে যত্ন করতে হয়। মুক্তা চাষের জন্য প্রয়োজন কিছু সরঞ্জাম। যেমন- ঝিনুক অপারেশনের কিটবক্স, দুই ধরনের নেট বক্স ও ইমেজ তৈরির জন্য কিছু যন্ত্রপাতি। সাধারণত ১০ থেকে ১২ মাস বয়সে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ইমেজটি স্থাপন করা হয় ঝিনুকের পেটে। এরপর দুই থেকে আড়াই ফুট পানির নিচে ডুবিয়ে রাখা হয় ঝিনুকগুলোকে। এভাবে ২১ থেকে ২৮ দিন রাখার পর সেগুলোকে উন্মুক্ত করা হয় ছাদ পুকুরে। এরপর ১০ মাসের মধ্যে স্থাপিত ইমেজটি মুক্তায় পরিণত হয়। সবশেষে পুকুর থেকে ঝিনুক তুলে আহরণ করা হয় মুক্তা। ঝিনুক সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রতিটি মুক্তা আহরণ পর্যন্ত খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা। ঝিনুক অস্ত্রোপচার ঘরে বসেই করা যায়। খুব অল্প খরচে সরঞ্জাম কেনা যায়। ধৈর্য ধরলে ভালো মুক্তা মেলে, লাভ পাওয়া যায়। মুক্তা চাষের বিশেষ দিক- ঝিনুককে বাড়তি খাবার দিতে হয় না। ঝিনুক নিজে থেকেই খাবার নিয়ে নেয়। উল্টো পুকুরের পানি মাছ চাষের জন্য উপযোগী করে তোলে ঝিনুক। মাঝেমধ্যে পানির পিএইচ ও ঝিনুকের আবরণ পড়ছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। পরে ওই ঝিনুক থেকেই মুক্তা তৈরি হয়।
মানসম্মত মুক্তা চাষ করতে পারলে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। বেকার যুবকরা এ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে স্বাবলম্বী হতে পারে। মুক্তা চাষ করতে গেলে প্রথমেই পুকুর নির্বাচন করতে হয়। সেটা এমন পুকুর হওয়া চাই, যেখানে সূযের্র আলো পৌঁছায় ভালো। কমপক্ষে ৫ ফুট পানি থাকতে হয় পুকুরে। পানিতে অ্যামোনিয়া আর অক্সিজেনের মাত্রাও পরীক্ষা করা দরকার হয়। পুকুর নির্বাচন করা হয়ে গেলে ভালো মানের ঝিনুক সংগ্রহ করতে হয়; আর তা মৎস্য খামার থেকেই করা যায়।