বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান কৃষি খাতের

প্রকাশ | ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
বাংলাদেশের মানুষের জীবিকা, কর্মসংস্থান এবং জিডিপিতে অবদানের জন্য কৃষি অপরিহার্য। বাংলাদেশে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্যের পর্যাপ্ততা বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি একটি কার্যকর হাতিয়ার। গ্রাম পর্যায়ে দেশীয় অনেক পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। তাছাড়া কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক কাঠামো কৃষিভিত্তিক। শস্য, মাঠ ও প্রাণিসম্পদ- তিন খাতকে কৃষির মধ্যে ধরা হয়। দেশের ৭০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য সরবরাহের প্রধান উৎসই এ খাত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সরকারি তথ্য অনুসারে মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) কৃষির অবদান ১৪ শতাংশ। কিন্তু কর্মসংস্থানের দিক থেকে প্রথম অবস্থানে এ খাত। বর্তমানে প্রায় ৭ কোটি শ্রমশক্তির মধ্যে কৃষিতেই রয়েছে দুই কোটি ৬০ লাখের বেশি। অর্থাৎ মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি কৃষিতে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ছিল এক কোটি ৮ লাখ টন। কিন্তু বর্তমানে তা চার কোটি ৫৪ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ কৃষির ওপর নিভর্র করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে দেশ। এছাড়া বিভিন্ন শিল্পে মূল্য সংযোজন করছে এ খাত। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এ খাত। বর্তমানে বাংলাদেশ ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে। এছাড়া পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, কাঁঠালে দ্বিতীয়, চাল, মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম ও আলুতে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম এবং মৌসুমি ফলে দশম অবস্থানে বাংলাদেশ। আর কৃষিতে এ অর্জনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। প্রযুক্তির হাত ধরে গত ১৫ বছরে পোলট্রি, গবাদি পশু এবং মাছ চাষে বিপস্নব ঘটিয়েছে। দাম তুলনামূলকভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর মধ্যেও রয়েছে কৃষি। এ খাতে কৃষকের সহায়তা পুঁজির সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়েছে। প্রথম তিন দশকে কৃষিতে উন্নতি হয়েছে। পরের দশকে অর্থাৎ চলিস্নশের দশকে তার দ্বিগুণ হয়েছে। আবার ৪০ থেকে ৫০ বছরে অর্থাৎ শেষ দশকে বৈপস্নবিক পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণ হলো এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার, নানা ধরনের চাষাবাদ বেড়েছে, নতুন বীজ আসছে। এ সময়ে বিশ্বব্যাপী কৃষিতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। গবেষণা বেড়েছে, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক কৃষি, নানা ধরনের আবিষ্কার হয়েছে। অর্থাৎ তারা স্মার্টকৃষিতে চলে গেছে। মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই খাদ্য। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষের প্রধান খাবার ভাত। দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাবারের জোগান নিশ্চিত করা সহজ কথা নয়। এর পেছনে রয়েছে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, কৃষি উপকরণ সহায়তা, ভর্তুকি, প্রণোদনা, দেশের ধান বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণা এবং ঘাম ঝরানো কৃষকদের নিরলস পরিশ্রম। এসবের মধ্য দিয়ে খাদ্য ঘাটতির দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার গৌরব লাভ করেছে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে বড় অবদান রাখছে কৃষি খাত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্স্নোগান ছিল, 'বাংলার প্রতি ঘর, ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে'। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও দারিদ্র্য বিমোচনে যে কয়েকটি খাত এগিয়ে আছে, তার মধ্যে বড় অবদান রেখেছে কৃষি খাত। মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং অব্যবহিত পরে প্রায় সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে দেশকে। তখন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হতো। দুর্ভিক্ষের মতো বিপর্যয় কড়া নাড়তো। এখন দেশের লোকসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি, পাশাপাশি আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে। এরপরও বছরে প্রায় সাড়ে চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন খাদ্য রফতানিকারক দেশ। বিপুল মানুষের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই বড় অর্জন। দেশে বছরে মাথাপিছু চালের চাহিদা ১৩৪ কেজি। চাল থেকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার রয়েছে- যা বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দৈনিক ক্যালরির চাহিদা পূরণ করে। ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো কৃষিনির্ভর। দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এখনো আমদানি নির্ভরতা কমেনি। তারপরও ধান, গম ও ভুট্টা বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। খাদ্য ও কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। মহামারি করোনাকালেও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় বিশ্বে কৃষি ও খাদ্যের ১১ খাতে সেরা বাংলাদেশের নাম। সরকারের কৃষি অনুকূল নীতি এবং প্রণোদনায় কৃষক ও কৃষিবিদদের চেষ্টায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে চাল রপ্তানি কারক দেশ হিসেবে নাম ওঠেছে বাংলাদেশের। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, বর্তমানে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য বিশাল এক অর্জন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় মাইলফলক বলে উলেস্নখ করেছেন বিশিষ্টজনরা। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরে রাখা, চালসহ কৃষিপণ্য, প্রক্রিয়াজাত মাছ-মাংস রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একের পর এক স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২০২২-২০২৪ মেয়াদে এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। নিরাপদ খাদ্যশস্য রপ্তানিতেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এরপরও বছরে প্রায় চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ। বিপুল মানুষের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই বড় অর্জন। স্বাধীনতার পর দেশে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে একটা নীরব বিপস্নব ঘটে গেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রাকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ২১৭ জাতের বিভিন্ন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের খাদ্য সংকটকে ইঙ্গিত করে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে মন্তব্য করেছিলেন। এখন আর খাদ্য সংকটের দেশ নয়। বাংলাদেশ এখন খাদ্যপণ্য রপ্তানিকারক দেশ। এর মধ্যে ব্রি'র ১০৬টি (৯৯টি ইনব্রিড ও ৭টি হাইব্রিড) উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ৪৬টি জাত বোরো মৌসুমের জন্য, ১২টি জাত বোরো ও আউশ উভয় মৌসুমি উপযোগী, ২৬টি জাত বোনা, রোপা ও আউশ মৌসুমি উপযোগী, ৪৫টি জাত রোপা ও আমন মৌসুমি উপযোগী, ১টি জাত বোরো, আউশ ও রোপা আমন মৌসুমি উপযোগী, ১টি জাত বোনা আমন মৌসুমি উপযোগী। বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা লবণসহিষ্ণু খরাসহিষ্ণু ও বন্যাসহিষ্ণু ধানের ২৪টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশগুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে তিনটি ফসল হচ্ছে। পরিশ্রমী কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য। অধিক ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করায় হাজার বছরের খাদ্য ঘাটতির দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বিশ্বে দ্রম্নত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবার ওপরে। বিশেষ করে খাদ্যঘাটতির দেশ থেকে উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উদাহরণ দেখছে বিশ্ব।