গোলমরিচ মসলা জাতীয় একটি অর্থকরী ফসল
প্রকাশ | ২৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন
প্রাচীনকাল থেকে গোলমরিচের গুঁড়া মসলা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। গোলমরিচকে বলা হয় মসলার রাজা। কারণ গোলমরিচের মতো গুণাগুণ নাকি আর কোনো মসলায় নেই। এটি একটি লতাজাতীয় উদ্ভিদ। এ ফলকে শুকিয়ে মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ঔষধি গুণাগুণের জন্যও এটি সমাদৃত। গোলমরিচ মসলা জাতীয় একটি অর্থকরী ফসল।
পুষ্টিবিজ্ঞানের তথ্যানুসারে এতে ক্যালরি কম, আছে ভিটামিন এ, ভিটামিন কে এবং ভিটামিন সি। পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও সোডিয়াম ইত্যাদি খনিজও এতে বিদ্যমান। তাই খাবারের স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি চর্বি কমাতেও তা অনন্য। শরীরের ফ্যাট ঝরাতে সাহায্য করে গোলমরিচ। মুখের স্বাদ বাড়াতে গোলমরিচের জুড়ি নেই। প্রতিদিন হালকা গরম পানির সঙ্গে গোলমরিচের গুঁড়া আর একচামচ মধু মিশিয়ে খেতে পারেন তাহলে কিন্তু মুখে স্বাদ ফিরবে। প্রতিদিন দুই চামচের বেশি গোলমরিচ খাওয়া উচিত নয়। দুই চামচ গোলমরিচ তাতে থাকে প্রায় ১০-১২টা গোলমরিচের দানা। বেশি খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে। বিশেষত যাদের গ্যাসট্রিকের সমস্যা আছে, তারা খুব বেশি খাবেন না। এছাড়াও অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের গোলমরিচ খেতে মানা করেন চিকিৎসকরা। এতে মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
গোলমরিচ মসলা জাতীয় একটি অর্থকরী ফসল। গোলমরিচ ফলটি গোলাকার, কাঁচা অবস্থায় গাঢ় সবুজ এবং পাকা অবস্থায় হলুদ থেকে লাল বর্ণের হয়। এর মধ্যে একটি মাত্র বীজ থাকে। ভারত ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, ব্রাজিল, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে গোলমরিচ চাষ হয়। গোলমরিচের গুঁড়া ইউরোপীয় দেশে খাদ্যে মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কফ ও ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিরাময় করে; ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি ব্যাহত করে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে; গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করে; ওজন কমাতে সাহায্য করে; কোমর বা পাঁজরের ব্যথা সারাতে গোলমরিচ চূর্ণ গরম পানিসহ সকাল ও বিকালে একবার করে খেতে হবে; গোলমরিচ সামান্য পানিসহ বেটে দাঁত ও মাড়িতে প্রলেপ দিলে ব্যথা দূর হয়। গোলমরিচে থাকা পাইপেরিন ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া এতে রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ফ্ল্যাভোনয়েডস, ক্যারোটিনস এবং অন্যান্য অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা ক্ষতিকারক ফ্রির্ যাডিক্যাল অপসারণ, ক্যানসার ও বিভিন্ন রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। পাইপেরিন আমাদের হজমকে সহজ করে তোলে। খাবারে কিছুটা গোলমরিচ মিশিয়ে নিন। খাবার দ্রম্নত হজম করতে সহায়তা করবে।
অব্যবহৃত বা পতিত জমিতে উচ্চ জৈব সার বিশিষ্ট পানি জমে না থাকা, পাহাড়ের লালমাটি গোলমরিচ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। বন্যাকবলিত অঞ্চল ছাড়া বেলে দো-আঁশ মাটিতে গোলমরিচের চাষ করা যায়। ষাটের দশকে বাংলাদেশে গোলমরিচের চাষাবাদ প্রবর্তিত হয়। তখন সিলেট অঞ্চলে বসতবাড়িতে কিছু গাছ ছিল বলে জানা যায়। নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক জৈন্তিয়া গোলমরিচ-১ জাতটি ১৯৮৭ সালে উদ্ভাবিত হয়। যা বারি গোলমরিচ-১ নামে পরিচিত। এছাড়াও কারিমুন্ডা, বালনকাট্টা, আরকুলপাম মুন্ডা প্রভৃতি।
গোলমরিচের বংশ বিস্তার পদ্ধতি খুবই সহজ। গোলমরিচের বীজ থেকে বংশ বৃদ্ধি করা যায়। এতে উৎপাদনে আসতে বেশি সময় লাগে। গোলমরিচের গুণাগুণ মাতৃগাছের মতো নাও হতে পারে। সেজন্য সাধারণত অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে গোলমরিচের বংশবৃদ্ধি করা হয়। সাধারণত এক মুকুল একপত্রীকাটিং-এ বংশবৃদ্ধি করা হয়। এ পদ্ধতি থেকে খুব সহজে গোলমরিচের চারা উৎপাদন করা যায়। শাখা রোপণে গাছ তৈরি হয় এবং গাছগুলো খুব সহজে বড় হয়।
সাধারণত গোলমরিচের চারা ডালের কলম থেকে তৈরি করা হয়। গোলমরিচের গাছের গোড়ার অংশকে 'রানার' বলা হয়। রানারের প্রতিটি গাঁট থেকে শিকড় বের হওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে। রানারের প্রতি তিনটি গাঁটের একটি অংশ কেটে নিয়ে আশ্রয়ী গাছের কাছে 'সরা' লাগিয়ে দিতে হয়। মাটির সঙ্গে ৩ : ১ অনুপাতে দাগ দিয়ে একটি পালং তৈরি করে তাতে গোলমরিচের ডাল থেকে তিনটি গাঁটযুক্ত কলম কেটে লাগাতে হবে। এক থেকে দেড় মাস পর ওই কাটিং থেকে শিকড় বেরিয়ে আসবে। তখন পলিথিন ব্যাগে ৪ ইঞ্চি করে ৩ ভাগ দো-আঁশ মাটি ভর্তি করে ওই শিকড়যুক্ত কাটিং থেকে সাবধানে উঠিয়ে পলিথিন ব্যাগে রোপণ করে দিতে হবে। রোপণের পূর্বে বাঁশের কাঠি দিয়ে পলিথিন ব্যাগের মাটিতে গর্ত করে নিয়ে শিকড়যুক্ত কাটিং লাগাতে হবে। গোলমরিচ সাধারণত ভাল জাতের গাছ বা বীজ বৈশাখের ১০ থেকে ১৫ দিন থেকে আষাঢ়ের ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ৪৫-৬০ দিনের মধ্যে একটি সুন্দর চারা গজাবে। সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাস চারা উৎপাদনের পক্ষে উপযুক্ত সময়।
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে গোলমরিচের চারা উৎপাদনের জন্য দ্রম্নত চারা উৎপাদন পদ্ধতি কার্যকর। একটি গাছ থেকে বছরে ৩০-৩৫টি চারা উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য একটি ছায়াঘর তৈরি করতে হবে। পস্ন্যাস্টিকের তৈরি বিশেষ ধরনের শেডনেট ব্যবহার করে ছাউনিও তৈরি করা যায়। ৬০-৭০ শতাংশ বৃষ্টির পানি আটকানোর ক্ষমতা বিশিষ্ট এ নেটের মধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ রোদ প্রবেশ করতে পারে। ঘরের বাঁশের খুঁটির সারির উচ্চতা হতে হবে প্রতি ৩ মিটার এবং দুপাশের খুঁটির উচ্চতা হবে ২ মিটার। ঘরের মধ্যে ১ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে ৭৫ সেন্টিমিটার গভীর এবং ৩০ সেন্টি মিটার প্রস্থের নালা তৈরি করতে হবে। নালাগুলো বালিমাটি, কম্পোস্ট, কাঁঠালের গুঁড়া এবং সারমিশ্রিত মাটি সমানভাগে মিশিয়ে ভর্তি করতে হবে।
আশ্রয় গাছ হিসেবে মান্দার গাছ গোলমরিচের জন্য ভালো। এ গাছটি সোজাভাবে বাড়বে এবং শাখা-প্রশাখার সংখ্যা কম থাকে। গাছের ছাল অমসৃণ এবং এ থেকে এক প্রকার আঁঠা জাতীয় পদার্থ বের হয়। মান্দার গাছের শাখাগুলো যখন গোলমরিচ গাছের উচ্চতা সীমিত রাখার জন্য কাটতে হয়, তাতে কোনো অনিষ্ট হয় না। মান্দার শুটি জাতীয় গাছ। ফলে বায়ুমন্ডল থেকে নাইট্রোজেন মাটিতে ধরে রাখতে পারে। এতে মাটি সমৃদ্ধ হয়।
ঝাঁঝালো মসলাদার ফ্লেভার খাবারে যোগ করে বাড়তি স্বাদ। হাজার হাজার বছর ধরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে গোলমরিচ। এর বায়োঅ্যাকটিভ যৌগগুলো আমাদের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত উপকারী। এর মধ্যে পাইপেরিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাইপেরিন একটি প্রাকৃতিক ক্ষারজাতীয় উদ্ভিদ- যার কারণে গোলমরিচের স্বাদ ঝাঁঝালো হয়। উপাদানটিকে এক ধরনের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়- যা বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে।
গালমরিচ রোপণের তিন বছর থেকে উৎপাদন শুরু হয়। যদিও ৭-৮ বছর থেকে পুরোপুরি উৎপাদন চলে আসে। প্রতি গাছ থেকে ৫-৬ কেজি কাঁচা গোলমরিচ উৎপাদন হয়। কাঁচা গোলমরিচ থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ শুকনো গোলমরিচ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, একটি গাছ থেকে গড়ে দেড় থেকে দুই কেজি শুকনো গোলমরিচ পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ৫০০ টাকা হলে একটি গোলমরিচের গাছ থেকে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা উপার্জন করা যায়। হিসেব অনুযায়ী একটি গাছের জন্য খরচ প্রায় ৩৫ টাকা। সুতরাং, খরচের তুলনায় লাভ যথেষ্ট। সম্ভাবনাময় গোলমরিচ চাষে কৃষকরা আরও উদ্যোগী হবেন। প্রতি জেলাতে কৃষি বিভাগ গোলমরিচ চারা জোগান ও কৃষি বিভাগের খামারে গোলমরিচ চারা উৎপাদন করা হয়। এ ব্যাপারে সচেতন কৃষকরা সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।