কোমর বেঁধে আমন চাষে মাঠে ব্যস্ত কৃষক-কৃষানি
প্রকাশ | ২৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন-পঞ্জিকা বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। আমন ধান সম্পূর্ণভাবে বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। বর্ষার নতুন পানিতে আমন ও আউশ রোপণ করেন কৃষক। দেশের প্রধান তিন নদী পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলোতে মা মাছ এসে ডিম পাড়ে। ধরা পড়ে স্বাদের ইলিশ। বর্ষার বৃষ্টির পানিতে পাট জাগ দেন কৃষক। এবার শ্রাবণ মাসের শুরুতে গ্রামীণ জনপদে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। এ যেন কৃষকের জন্য তা সৌভাগ্য হিসেবে এসেছে। এতে গ্রাম-বাংলায় পুরো রূপে বর্ষা ধরা দিয়েছে। আষাঢ় মাসে ভারী বৃষ্টির দেখা না মিললেও শ্রাবণ মাসে কয়েকদিনের পর্যাপ্ত বৃষ্টি কৃষকের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বৃষ্টি কৃষকের বিঘাপ্রতি সেচ খরচ এক হাজার টাকা সাশ্রয় করেছে। গ্রামে গ্রামে কোমর বেঁধে আমন চাষে মাঠে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষক-কৃষানিরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বোরো ধানের মতো সেচের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে আমন চাষও। তবে শ্রাবণের কয়েকদিনের বৃষ্টি নতুন করে আমন চাষে আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষকের। বৃষ্টি হওয়ায় পতিত জমিতে আমনের চারা রোপণে ও জমি থেকে চারা তোলা, রোপণ কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যেমন সবকিছুরই দাম বেড়ে চলছে তেমনি ধানের চারা ও কৃষকের মজুরি ও কৃষি উপকরণের দাম সমান তালে বেড়েছে। কৃষকের মজুরি বেশি। বর্তমানে এক মণ ধানের মূল্য ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকা। অপরদিকে, একদিনে একজন কৃষি শ্রমিকের মজুরির বেতন বেড়ে হয়েছে এক হাজার টাকা।
অনুকূল আবহাওয়া পেয়ে কৃষকরা কোমর বেঁধে আমন চাষে মাঠে নেমেছেন। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়েই বৈরী আবহাওয়া। দেশের কোথাও ভারী বৃষ্টি হলেও অনেক জেলাতেই পর্যাপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে না। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা এখনো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির দেখা পায়নি। আবার রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ জেলার কয়েকটি এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে আমন চাষ নিয়ে বিপাকে আছেন কৃষক।
ঋতু পরিবর্তিত চিরায়ত ধারায় আষাঢ়-শ্রাবণ এ দুই মাসকে ঘিরে আসে বর্ষাকাল। কদম, কেয়া আর কেতকীর নয়নাভিরাম রূপের পসরা ও পেখম খোলা ময়ূরের উচ্ছল নৃত্যের আবাহন নিয়ে আসে বৃষ্টি। বাঙালি মননে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিকতা-আধ্যাত্মিকতার সুর বাজে এই বর্ষায়। সবুজের সমারোহে নতুন প্রাণের বার্তা নিয়ে আসে বর্ষা। গ্রামীণ আবহাওয়ায় আকাশ ছেয়েছে মেঘের ঘনঘটায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিতে বজ্রপাত শুরু হলে মাছ, ব্যাঙ ও সরীসৃপ প্রাণীদের প্রজনন শুরু হয়। দেশের প্রধান তিন নদী পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলোতে মা মাছ এসে ডিম পাড়ে। ধরা পড়ে স্বাদের ইলিশ। কৃষকরা পাট বেঁচে ইলিশ মাছ কিনেন। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি নাগরিক জীবনে কিছুটা বিড়ম্বনার কারণ হলেও কৃষকের জন্য তা সৌভাগ্য হিসেবে এসেছে। শ্রাবণের অঝোর ধারায় স্বস্তি ফিরেছে গ্রাম-বাংলায়। পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে স্বাভাবিক রূপে ফিরেছে বর্ষা। ক্ষেত-খামার হয়েছে চাষের উপযোগী। বৃষ্টির ছোঁয়ায় প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আমন ধান রোপণের জন্য ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টির প্রয়োজন হয়।
নেত্রকোনো জেলার দুর্গাপুরের বিজয়পুর গ্রামের কৃষক ফজলু মড়ল জানান, বৃষ্টি পেয়ে এলাকার কৃষক নতুন করে আমন চাষে মাঠে নেমেছেন। কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রোপণকৃত আমন ধানের মাঠ দ্রম্নতই সবুজ হয়ে উঠছে। আমন আবাদটা কৃষকের অনেক লাভজনক। তাই যেভাবেই হোক আমরা আমনের চারা রোপণ করেছি। কারণ, এতে সেচ লাগে না বৃষ্টির পানিই যথেষ্ট। এতে ফলনও ভালো পাওয়া যায়। বর্ষার নতুন পানিতে মাছ ডিম ছাড়ে, আমন ও আউশ রোপণ করেন কৃষক।
রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে। ফলে, আমন রোপণ এখনো তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। যমুনা-তিস্তায় পানি বাড়ায় এর শাখা নদী ছোট যমুনা-আত্রাই-মহানন্দায় কিছু পানি এসেছে। যমুনার পানি এসেছে চলনবিল এলাকায়। বৃষ্টিপাতের কারণে নিচু এলাকার আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এতে আমন রোপণ ঝুঁকিতে পড়ছে। বগুড়ার আমন চাষিরা বলছেন, শেষ সময়ের বৃষ্টি না হলে বিঘাপ্রতি খরচ বাড়তো প্রায় এক হাজার টাকা। বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার যমুনার চরে এবার বিপুল পরিমাণ স্থানীয় জাতের আমনের চাষে মাঠে নেমেছেন কৃষক। খুলনা, যশোর ও মাগুড়া অঞ্চলে এ বছর আষাঢ়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আমন চাষ বিলম্বে হচ্ছে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাতে আমন ধানের বেশ উপকার হচ্ছে। বর্তমানে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তাতেই মাঠে আমন ধানের চারায় পরিবর্তন এসেছে। টানা বৃষ্টিতে চাষিদের মনে স্বস্তি ফিরেছে।
টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের শিয়ালকোলের কৃষক জাফর মিয়া বলেন, বর্ষাকালের প্রথম দিকে বৃষ্টি না হওয়ায় এই অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। শ্রাবণের স্বস্তির বৃষ্টিতে পুরোদমে রোপা আমন ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। জমিতে চাষ, আগাছা পরিষ্কার, সার দেওয়াসহ নানা কাজে এখন পুরো ব্যস্ত তারা। আমন আবাদে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল শ্রাবণের বৃষ্টিতে তা পুষিয়ে গেছে। এখন কৃষকের ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আমন উৎপাদন হবে। শ্রাবণের বৃষ্টিতে কৃষকরা আমন রোপণে মাঠে আছেন।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ৫৬ লাখ ৫৯ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ টন। ইতোমধ্যে ৫৬ দশমিক ২২ শতাংশ জমিতে ধান রোপণ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক শহীদুল আলম বলেন, অব্যাহত বৃষ্টিতে এখন পুরোদমে আমন চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমন রোপণের সাবির্ক অবস্থা খুবই ভালো। আমাদের কর্মকর্তারা মাঠ পরিদর্শন করছেন। আশা করি, এবার বাম্পার ফলন হবে। তবে রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নালফামারীতে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমি বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। সেখানে রোপণ শেষ হতে হয়তো একটি বেশি সময় লাগবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, বরেন্দ্র অঞ্চল ও হাওড় এলাকায় কৃষকরা সাধারণত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমন রোপণ করে থাকেন। আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছি। আমনের উৎপাদন বাড়াতে কৃষদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহের ফুলপুরের কৃষক কাশেম মিয়া বলেন, আমন আবাদটা কৃষকের অনেক লাভজনক। তাই যেভাবেই হোক আমরা আমনের চারা রোপণ করেছি। কারণ, এতে সেচ লাগে না বৃষ্টির পানিই যথেষ্ট। এতে ফলনও ভালো পাওয়া যায়। টানা ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় আমন খেত দেখে মন ভরে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মানুষ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ। জলবায়ুর প্রভাবে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে দিনের পর দিন বাড়ছে আবহাওয়ার খামখেয়ালি আচরণ। অসময়ে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা।
আবহাওয়াবিদ ডক্টর সমর সাহা জানান, বৃষ্টি এক ধরনের তরল- যা আকাশ থেকে মাধ্যাকর্ষণের টানে ভূপৃষ্ঠের দিকে পড়ে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। এই মেঘ যথেষ্ট পরিমাণে ভারী হলে তা বৃষ্টি আকারে পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ে- একেই বলে বৃষ্টি। বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে বৃষ্টি সুপেয় জলের বড় উৎস। বিচিত্র জৈব ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে, জলবিদু্যৎ প্রকল্পগুলো সচল রাখতে ও কৃষি সেচ ব্যবস্থা সচল রাখতে বৃষ্টির প্রয়োজন হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বাড়াবাড়ির ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০২১ সালে কালবৈশাখীর মৌসুমে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। ২০২০ সালের কার্তিকের বৃষ্টি যেন আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিকেও হার মানিয়েছে। ২০২০ সালের অসময়ের বৃষ্টি ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। রংপুরে মাত্র ১৪ ঘণ্টায় ৪৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। অথচ প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গড়ে সারাদেশে ২২৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৯ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসের বৃষ্টি আগের ৫২ বছরের রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ২০১৮ সালের শুরুতে স্মরণকালের রেকর্ড ভেঙে শীতে তাপমাত্রা নেমে আসে ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তারপর শরৎকালে আকাশ ভেঙে নামে বৃষ্টি। ২০১৭ সালের শুরুতে অতিবৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা আগাম ঢলে হাওরের ধান তলিয়ে যায়। ওই বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বেশি বৃষ্টি হয়। ওই পানি উজানের এলাকা বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাওয়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের ক্ষতি করে যায়। ২০১৭ সালের ফেব্রম্নয়ারি-মার্চ মাসেও ব্যাপক বৃষ্টি হয়। বাংলা চৈত্র মাসে আষাঢ় মাসের মতো বৃষ্টি হয়। এতে আগাম বন্যায় আঘাত হানে শস্যভান্ডারখ্যাত দেশের হাওরাঞ্চলে। ওই বছর ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বেশি বৃষ্টি হয়।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর মঞ্জুরুল হান্নান খান যায়যায়দিনকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে একেক বছর একেক ধরনের আবহাওয়া বিরাজ করছে। গত পাঁচ বছরের আবহাওয়া বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বৃষ্টিপাতের মাত্রা দিনের পর দিন বাড়ছে। অসময়ে একই সঙ্গে রেকর্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গঙ্গা অববাহিকায় প্রায় বছরই রেকর্ড ভাঙা বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ ২০২৩ সালে আমন মৌসুমে বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি।