রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে মৎস্য খাত

ইমরান ছিদ্দিকি
  ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে মৎস্য খাত

অর্থনীতি সচল রাখতে মৎস্য খাত ভূমিকা রাখছে। উদ্যোক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখতে মৎস্য খাত ভূমিকা অব্যাহত রেখে চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে। বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। 'মৎস্য মারিব খাইব সুখে' মধ্যযুগের এ শ্লোক আবার ফিরে এসেছে। 'মাছে-ভাতে বাঙালি' চাষের মাধ্যমে মাছের সেই হারানো গৌরব ফিরে এসেছে। বাংলাদেশে অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য।

বর্তমানে দেশের রপ্তানি আয়ের ১ দশমিক ২৪ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। বিশ্বের ৫৫টির অধিক দেশে মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৪২ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৫ হাজার ১৯১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা- যা আগের বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাছ রপ্তানি করে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকার বেশি আয় হয়েছে, এই অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ আছে। এ ছাড়া এসব জলাশয়ে আরও ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি মাছ আছে। মাছের প্রজাতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ আছে। সামুদ্রিক এলাকায় রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ এবং ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি মাছ। মাছের শ্রেণিবিন্যাস বিভিন্ন রকম হতে পারে।

এফএও পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হবে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের অস্থান থাকবে। বর্তমানে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে প্রথম দেশ চীন, দ্বিতীয় ভারত আর তৃতীয় দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মৎস্য গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিবেশ ব্যবস্থা মিঠাপানির মাছ চাষের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। এখানকার সোয়া দুই লাখ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় আর গ্রামীণ এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাখ লাখ পুকুরে মাছ চাষের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। সরকার যদি মাছ চাষে আরও মনোযোগী হয়, চাষিদের সহায়তা করে, তাহলে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ মাছ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হতে পারে।

এফএও'র হিসাব অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে এক যুগ ধরেই বাংলাদেশ মাছ চাষে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে মাছের মোট উৎপাদন হয়েছে ৪১.৩৪ লাখ টন। এর মধ্যে চাষ করা মাছের পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ টন। জাটকা সংরক্ষণসহ নানা উদ্যোগের ফলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ টন। দেশের জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান ১ শতাংশ। আর জিডিপিতে পুরো মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ষাটের দশকে আসা তেলাপিয়া দিয়ে তা শুরু হয় মাছ চাষের বিপস্নব। পরে থাই পাঙাশ, ভিয়েতনামের কই, থাই কই, আফ্রিকান মাগুর। এখন বাজারে পাওয়া ৯০ শতাংশ মাছই চাষের মাছ। দেশে বর্তমানে ৪৭৫টি সামুদ্রিক প্রজাতি, ৩৬০টি স্বাদু পানির প্রজাতি, ৩৬টি চিংড়ি প্রজাতির মাছ রয়েছে। বিপন্ন হয়ে যাওয়া ২০ প্রজাতির মাছ কৃত্রিম প্রজননে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

বর্তমানে দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে মাছ। মাথাপিছু প্রতিদিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে মানুষ এখন ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এখন মৎস্য খাতের অবদান। বিগত ১২ বছরে মৎস্য খাতে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বার্ষিক মৎস্য দরদামের স্থিতিশীলতাই বলে দেয় মৎস্য চাষে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ, যদিও কোনো কোনো মাছ দেশে উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৭ সালে 'বাংলাদেশের ইলিশ' ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই সনদ লাভ করেছে। বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। বর্তমানে বিশ্বের ৫২টি দেশে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে।

গত কয়েক দশকে চাষ করা মাছ এবং এক দশকে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনুকরণীয়। কিন্তু নদীর নাব্য হ্রাস, দূষণ, হাওড়-বাঁওড় এবং অন্য প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর সংকোচন, দখল, অপ-উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ার মতো ঘটনা বাড়ছে। একই সঙ্গে মাছ ধরা এবং চাষের সঙ্গে জড়িত বিপুল পেশাজীবীর আর্থিক ও পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত- যা এই অগ্রগতিকে হুমকিতে ফেলতে পারে। দেশে এখন প্রায় চার কোটি লোক মৎস্য খাতে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে জড়িত। লাভজনক হওয়ায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত মানুষ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান মৎস্য চাষে এগিয়ে এসেছে। মৎস্য খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বের অনুপ্রেরণা এখন। ভালো ব্যবস্থাপনা এবং মৎস্যবিজ্ঞানী, মৎস্য অধিদপ্তর ও জেলেদের নিরলস পরিশ্রম, ত্যাগে এটি সম্ভব হয়েছে। হাওড়-বাঁওড়, অন্যান্য জলাশয় ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, দূষণ রোধ এবং জাতীয় আয়ে মৎস্য খাতের বিপুল অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। তবেই এ অগ্রগতি ধরে রাখা সম্ভব। পৃথিবীর প্রায় ৫২টি দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মাছের চাহিদা রয়েছে।

সাম্প্র্রতিক বছরগুলোতে দেশে মাছের উৎপাদন উলেস্নখযোগ্য হারে বাড়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। কৃষির অন্যান্য খাত-উপখাতের তুলনায় মাছের উৎপাদন বাড়ার হার বেশি। বিগত ১৫-১৬ বছরে এ খাতে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী সাগর এলাকায় প্রতি বছর ৮০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ দেশের জেলেরা ধরে থাকেন। বিশাল সমুদ্রসীমায় মৎস্যসম্পদের ১ শতাংশও ধরতে পারছেন না বাংলাদেশের জেলেরা উন্নত জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ মৎস্যসম্পদ রয়েছে, সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছ বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে অনায়াসেই বিলিয়ন ডলার আয় করা যায়। এ ছাড়া মাছের তেল থেকে ওষুধ, সস প্রভৃতি তৈরি করা সম্ভব। এতে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব। সমুদ্রে যে বিপুল অর্থনৈতিক এলাকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে, সেখানে মৎস্যসম্পদ আহরণের জন্য চাই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষ জনবল তৈরির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। মাছের বাজার নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। বলা যায়, গোটা বিশ্বেই মাছের অপরিমেয় চাহিদা রয়েছে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে।

এ ছাড়া মৎস্য আহরণ বাড়াতে সামুদ্রিক নৌযান, ট্রলারগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে সমুদ্রের সর্বশেষ অবস্থা সব সময় জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গভীর সমুদ্রে মৎস্যসম্পদ আহরণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। হংকং, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কেবল সমুদ্রকে ব্যবহার করেই বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে। সমুদ্র শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে অনেক দিন নানা ধরনের বিরোধ ছিল, এখন সে অবস্থা নেই। মাছের উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীকে 'বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ' ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া মাছের উৎপাদনকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করতে, পাশাপাশি বর্তমান সরকারের আমার গ্রাম, আমার শহরের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার 'দক্ষিণ বিশিউড়া' ও শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার 'হালইসার' গ্রামকে 'ফিশার ভিলেজ' বা 'মৎস্য গ্রাম' ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প এলাকায় ১০০টি মডেল ভিলেজ প্রতিষ্ঠা ও ৪৫০টি মৎস্যজীবী গ্রাম উন্নয়ন করা হচ্ছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ এক কোটি ৯৫ লাখ বা ১২ শতাংশের বেশি মানুষ মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মাছ ও চিংড়িসহ অন্যান্য জলজ সম্পদের স্থায়িত্বশীল উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের পুষ্টিচাহিদা পূরণ এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে উন্মুক্ত জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ ক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সুফলের মাধ্যমে দরিদ্র্য মৎস্যজীবী ও চাষি তথা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের চারটি উৎস রয়েছে। এগুলো হলো-অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয়, আধালোনা পানির জলাশয় ও সামুদ্রিক জলাশয়।

আন্তর্জাতিক প্রাণপ্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের গবেষণায় দেখা গেছে, এক

সময় দেশের নদনদী ও জলাশয়গুলোতে ২৬৬ প্রজাতির মিঠা ও ঈষৎ লোনা পানির মাছ

পাওয়া যেত।

বাংলাদেশের চাষের মাছের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। প্রায় ৯ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ২১ লাখ টন। উন্নত জাতের মাছ চাষের মাধ্যমে মাছে-ভাতে বাঙালির প্রবাদ ধরে রাখতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। মাছচাষে সরকার কম সুদে ঋণ দিচ্ছে। চিংড়ি ও ইলিশের রপ্তানি বাড়াতে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মৎস্য চাষিদের সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। মাছ ধরা নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের রেশন হিসেবে চাল-ডাল বিতরণ করছে সরকার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে