শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

পস্নাস্টিক বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরা শক্তি

আলতাব হোসেন
  ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
পস্নাস্টিক বর্জ্যে নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরা শক্তি

বাজারের ব্যাগ থেকে শুরু করে ওষুধের বোতল, প্রসাধন সামগ্রীর মোড়ক, পানির বোতল, গৃহস্থালিসহ নানা কাজে বাণিজ্যিকভাবে পস্নাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। পলিথিন ও পস্নাস্টিক বর্জ্য ১০০ বছরেও মাটির সঙ্গে মিশে না। বছরে প্রায় ২৭ হাজার টন পস্নাস্টিক ও পলিথিন দেশের ফসলি মাটিতে পড়ছে। পস্নাস্টিক ও পলিথিনের ব্যাগ মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছে তা চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এতে মাটির গুণগত মান কমে যাচ্ছে। ভেঙে পড়ছে মাটির স্বাস্থ্য।

ফসল উৎপাদনের জন্য সুষম মাটিতেই পাঁচ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকার প্রয়োজন। অথচ পস্নাস্টিক ও পলিথিন দূষণে দেশের অধিকাংশ এলাকায় মাটির জৈব পদার্থের উপাদান এক শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। মাটি হচ্ছে কৃষির মূল ভিত্তি। উর্বর মাটি না হলে ভালো ফসল পাওয়া যায় না। মাটি বা মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরিভাগের নরম আবরণ যা পরিবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বর্তমানে এই মহামূল্যবান প্রকৃতিকসম্পদ নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিকভাবেই মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে দেশের মোট আবাদি জমির ৮৫ ভাগেই মারাত্মক জৈব ঘাটতি তৈর হয়েছে। মাটিতেই পাঁচ শতাংশ জৈব উপাদান থাকার কথা থাকলেও তা এক শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে।

সাধারণত ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব এবং ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকা মাটিকে সুষম মাটি বলা হয়। একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ থাকা অতি প্রয়োজনীয় হলেও এ দেশের বেশিরভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এক দশমিক ১৭ শতাংশ এবং কিছু কিছু জমিতে এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম? এর মধ্যে ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৬ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, ৩৩ দশমিক ৩০ লাখ আট হাজার হেক্টর জমিতে গন্ধক, ২৭ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা সার, ২৩ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরন সারের অভাব রয়েছে? এছাড়া, অনেক জমিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের অভাব।

কৃষিনির্ভর সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি মূলত কৃষি ও মাটির ওপর নির্ভরশীল। আয়তনে ছোট, ঘনবসতি ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশ হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে পরিচিত। এর মূল কারণ হলো আমাদের দেশের সোনাফলা উর্বর মাটি। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনায় মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে জমির উবর্রতা হ্রাস পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক।

সুষম মাটি হচ্ছে কৃষির মূল ভিত্তি। উপযুক্ত মাটি না হলে অর্থাৎ ফসলের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সমৃদ্ধ মাটি না হলে কাঙ্ক্ষিত ফসল পাওয়া যায় না। মাটি এক জীবন্ত সত্তা। তাই মাটিরও ভালো বা মন্দ লাগা আছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাড়তি খাদ্য চাহিদা মেটাতে গিয়ে একই জমিতে বর্তমানে তিন থেকে চারবার একই ধরনের ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে। আবাদ করা হচ্ছে উচ্চফলনশীল অথবা হাইব্রিড জাতের ফসল। এসব ফসল মাটি থেকে বিপুল পরিমাণ পুষ্টি উপাদান শোষণ করছে। উপরিভাগের উর্বর মাটি ব্যবহার হচ্ছে ইটভাটা ও উন্নয়ন কাজে। ফলে জমি হারাচ্ছে স্বাভাবিক উৎপাদনক্ষমতা। কাজেই মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতি জরুরি। মাটিতে বিনিয়োগ অত্যন্ত লাভজনক। মাটিতে এক মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করলে পাঁচ মার্কিন ডলার প্রতিদান পাওয়া যায়।

পস্নাস্টিক ও পলিথিন দূষণ বিশ্বব্যাপী এক জটিল সমস্যা- যা পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য এক বিরাট হুমকি। মানবসৃষ্ট পস্নাস্টিক দূষণ পৃথিবীতে নানা রকম ইকোসিস্টেমের জন্য এক ভয়ংকর বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিপন্ন করে তুলেছে পৃথিবীতে মানুষ ও অন্যান্য জীবের অস্তিত্বকে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পস্নাস্টিকজাত পণ্য বা পলিথিন ব্যাগ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশক অন্যান্য উপাদানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। দেশে পস্নাস্টিক দূষণের মাত্রা ও প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ এবং দূষিত পরিবেশকে পুনরুদ্ধারের জন্য জাতীয়ভাবে আন্তঃবিভাগীয় সমন্বিত গবেষণা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি আমাদেরও পস্নস্টিক দূষণ রোধের কার্যক্রমকে গতিশীল করে তুলতে আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি সবাইকে পস্নাস্টিক পণ্য ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

কৃষি গবেষক ড. আব্দুল কালাম আজাদ বলেন, পস্নাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনায় মানবসভ্যতাকে ফেলেছে এক ভয়ংকর বিপদের মুখে। পস্নাস্টিক ও ন্যানো পস্নাস্টিক বর্জ্য নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ জীবের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন এবং ক্যানসারসহ নানারকম দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হতে পারে। উর্বরা শক্তি ফিরিয়ে আনতে চাষে ভিন্নতা আনতে হবে। একবার ধান চাষ করলে পরের বছর ডাল জাতীয় ফসল করতে হবে। আবার দুই ফসল উৎপাদনের পর জমিকে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। গরু-মহিষের গোবর জৈব পর্দাথের বড় উৎস্য।

এ বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ডক্টর মামুন রশিদ খান বলেন, পস্নাস্টিকের রকমারি পণ্য এবং তার প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত উপাদানেরও বিভিন্নতা রয়েছে। আমাদের দেশে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য যদি উৎসে আলাদা করা সম্ভব হতো, তাহলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে সহজ হতে পারতো। সবরকম পলিথিন ও পস্নাস্টিক বর্জ্য আলাদাভাবে প্রতিটি বাসা থেকে সংগ্রহ করতে পারলে তা পুর্নচক্রায়ণ করে নতুন উৎপাদন করা সম্ভব। দুধ ও পানীয়জাত দ্রব্যের পস্নাস্টিকে বাজারজাত করা বন্ধ করে কাঁচের বোতল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত। যেসব কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কোমল পানীয় বা পানির বোতল ও অন্য যেসব পস্নাস্টিক পণ্য বিক্রি করে থাকে, সেসব পণ্য ব্যবহার শেষে আবার ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের বা চটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগের সরবরাহ বাড়াতে হবে। পস্নাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারে মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পাটের সুতা মূলত সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ ও লিগনিন দ্বারা গঠিত। সেজন্য পাটজাত দ্রব্যের বর্জ্য সহজে পরিবেশে পচে মৃত্তিকার উবরা শক্তি বাড়ায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব এবং ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকা মাটিকে সুষম মাটি বলা হয়। একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ থাকা অতি প্রয়োজনীয় হলেও দেশের বেশিরভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এক দশমিক ১৭ শতাংশ এবং কিছু কিছু জমিতে এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম? এর মধ্যে ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৬ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, ৩৩ দশমিক ৩০ লাখ আট হাজার হেক্টর জমিতে গন্ধক, ২৭ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা সার, ২৩ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরন সারের অভাব রয়েছে? এছাড়া অনেক জমিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের অভাব। মাটির পুষ্টি উপাদান হ্রাস, মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি, মাটির অম্স্নতা বৃদ্ধি, ভূমিক্ষয়, নদী ভাঙন, জলাবদ্বতা, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ভারী ধাতুদূষণ ইত্যাদি ভূমির অবক্ষয়ের প্রধান কারণ। একদিকে জনসংখ্যার চাপ, সম্পদের সীমাবদ্ধতা, খাদ্য নিরাপত্তা, জলাবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ইত্যাদি এখন দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

\হপরিবেশবিদ ডক্টর কামরুজ্জামান সরকার বলেন, ভূমির অবক্ষয় রোধে করণীয় হচ্ছে অধিক হারে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন করা, শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা। জমিতে পরিমিত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা। জমিতে রাসায়ননিক সারের পরিবর্তনে জৈব সার ব্যবহার করা। টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। উষ্ণ আবহাওয়া সহনশীল প্রযুক্তি যথা খরা বা অতি তাপমাত্রা সহনশীল, কম পানি লাগে ও অল্পজীবনকাল সম্পন্ন শস্যের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য লবণাক্ত সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবন করা। কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করা যাতে বিরূপ ও রুক্ষ আবহাওয়ায় অতি অল্প সময়ে চাষাবাদ প্রক্রিয়াসম্পন্ন করা যায় এমন ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা।

তিনি আরো বলেন, মাটির স্বাস্থ্য যাতে শস্য উৎপাদান উপযোগী থাকে ও এলাকা টিতে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা। খরা প্রবণ অঞ্চলে জনপদ ধরে রাখার জন্য আর্থ-সামাজিক কার্যক্রম জোরদার করা ও পরিবেশ উন্নত রাখা। স্থানীয় টেক সই প্রযুক্তিসমূহের সম্প্রসারণ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে