রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় বাংলাদেশ

ইমরান ছিদ্দিকি
  ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় বাংলাদেশ

গত দুই বছরে বাংলাদেশে মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বেড়ে ১.৩২ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। এতে মিঠাপানির মাছ আহরণে বিশ্বে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী মিঠাপানির মাছ আহরণে বাংলাদেশ চীনকে টপকে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থানের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। ক্রাস্টাশিয়ান্স (খোলসযুক্ত মৎস্য জাতীয় প্রাণী যেমন: চিংড়ি, লবস্টার ইত্যাদি) উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম এবং সামুদ্রিক মাছ উৎপাদনে ১৪তম স্থান অধিকার করেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের জুন মাসে এ সুসংবাদ পেয়েছে বাংলাদেশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনের মিঠাপানির মাছ উৎপাদন ছিল ১.৪৬ মিলিয়ন টন এবং অবস্থান ছিল বিশ্বে দ্বিতীয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের উৎপাদন ছিল ১.২৫ মিলিয়ন টন এবং অবস্থান ছিল বিশ্বে তৃতীয়। বিগত দুই বছরে বাংলাদেশের মিঠাপানির মাছ উৎপাদন ১.২৫ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ১.৩২ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। পক্ষান্তরে চীনের উৎপাদন ১.৪৬ মিলিয়ন টন থেকে কমে ১.১৬ মিলিয়ন টন হয়েছে। গত দুই বছরে মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে উলেস্নখযোগ্য অবদান রেখেছে ইলিশ, দেশীয় প্রজাতির মাছ (পাঙাশ, বোয়াল, আইড় ও অন্যান্য ছোট মাছ) এবং কার্পজাতীয় মাছ। এর মধ্যে সর্বাধিক অবদান রয়েছে ইলিশ মাছের বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল।

গত ৮ জুন শনিবার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার (এফএও) প্রকাশ করা বিশ্বের মূলত নদনদী, বিল, হাওড়- বাঁওড়সহ উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছ আহরণকে ওই হিসাবে নেওয়া হয়েছে। তবে পুকুর ও অন্যান্য জলাশয়ে চাষ মিলিয়ে মাছের উৎপাদনে বাংলাদেশ এবার তৃতীয় অবস্থান থেকে দুই ধাপ পিছিয়ে পঞ্চম অবস্থানে নেমে এসেছে। এফএওর ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে ছিল। এর আগে ২০২০ থেকে এর আগের টানা পাঁচবার বাংলাদেশ ছিল পঞ্চম অবস্থানে। ইলিশের প্রজনন এবং জাটকা রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়ায় বিশ্বের উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। তবে দেশের হাওড় ও বিলগুলোতে ছোট ও মাঝারি অন্য মাছের জাতগুলোর প্রজননের সময় সুরক্ষা দেওয়া উচিত। উলেস্নখ্য, উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আহরণ করা মাছের অর্ধেকই ইলিশ। বাংলাদেশ ২০২৩ সালে মোট সাড়ে ছয় লাখ টন শুধু ইলিশ উৎপাদন করেছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাদুপানির মাছ উৎপাদন করেছে ১৩ লাখ ২২ হাজার টন- যা বিশ্বের মোট মাছের ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। বিশ্বের স্বাদুপানি ও চাষের মাছে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর বেশিরভাগ এশিয়া মহাদেশের। এখানকার স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মাছের চাষ বেশি হয়। বিশেষ করে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায় নদী ও জলাভূমি বেশি থাকায় সেখানে স্বাদুপানির মাছ সংগ্রহ ও চাষের জন্য উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে। মৎস্য খাতে সরকার সময়োপযোগী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণের কারণে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আমরা মনে করি, এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ সাফল্য লাভ করলেও বাজারে মাছের লাগাম ছাড়া দাম। স্বাভাবিক নিয়মে মাছের উৎপাদন ও সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কমার কথা। অথচ বাজারে উল্টো চিত্রই চোখে পড়ে। নদী-জলাশয়ে, খালে-বিলে প্রাকৃতিক মাছ কমে যাওয়ায় এখন অধিকমাত্রায় মাছের চাষ হচ্ছে। এর ফলে, মাছের চাহিদা পূরণ হচ্ছে, পাশাপাশি কর্মসংস্থানও হচ্ছে। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপই কেবল পারে মৎস্য উৎপাদনে আরও সমৃদ্ধি লাভ করতে। সে জন্য বর্তমান সাফল্য ধরে রাখতে হবে।

বিএফআরআইয়ের হিসাবে, বাংলাদেশ গত বছর (২০২৩) মোট ৪৮ লাখ টন মাছ উৎপাদন করেছে। এর মধ্যে চাষের মাছ ৩২ লাখ টন, উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আহরণ করা ১৩ লাখ টন। বাকিটা সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা। উলেস্নখ্য, উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আহরণ করা মাছের অর্ধেকই ইলিশ। বাংলাদেশ ২০২৩ সালে মোট সাড়ে ছয় লাখ টন শুধু ইলিশ উৎপাদন করেছে। বাংলাদেশ স্বাদুপানির মাছ উৎপাদন করে ১৩ লাখ ২২ হাজার টন- যা বিশ্বের মোট মাছের ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। এর আগে সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবদান ছিল ১১ শতাংশ। ভারত এবার ১৮ লাখ ৯০ হাজার টন উৎপাদন করে ওই তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। আর চীন ১১ লাখ ৬৬ হাজার টন উৎপাদন করে তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। চীনের পরে রয়েছে মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও উগান্ডা। প্রতবেদনটিতে বলা হয়, বিশ্বের স্বাদুপানি ও চাষের মাছে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর বেশিরভাগ এশিয়া মহাদেশের। এখানকার স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মাছের চাষ বেশি হয়। বিশেষ করে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায় নদী ও জলাভূমি বেশি থাকায় সেখানে স্বাদুপানির মাছ সংগ্রহ ও চাষের জন্য উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে। এখানকার অধিবাসীদের জীবিকা ও পুষ্টির জোগান দিতে মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিবেদনে বিশ্বের মৎস্য সম্পদের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বের মাছের উৎপাদন সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে। ওই বছর মোট ২২ কোটি ৩২ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে- যা ২০২০ সালের তুলনায় ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। এর আর্থিক মূল্য ৩১৩ বিলিয়ন ডলার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী দিকনির্দেশনা ও প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়। বর্তমান সরকারের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনায় মৎস্য খাতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়নের ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪৯.১৫ লাখ টন। বিশ্বের স্বাদুপানি ও চাষের মাছে শীর্ষে থাকা দেশগুলোর বেশিরভাগ এশিয়া মহাদেশের। এখানকার স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মাছের চাষ বেশি হয়। বিশেষ করে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায় নদী ও জলাভূমি বেশি থাকায় সেখানে স্বাদুপানির মাছ সংগ্রহ ও চাষের জন্য উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে। এখানকার অধিবাসীদের জীবিকা ও পুষ্টির জোগান দিতে মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

'মাছে-ভাতে বাঙালি' এই প্রবাদটি সেই হাজারো বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। 'মাছে-ভাতে বাঙালি' এটা বর্তমান সময়ের কোনো কথা নয়। বর্তমানে আমাদের সংস্কৃতি অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। আগেকার দিনে যখন এত বিদেশি খাবারের প্রচলন ছিল না সেসময় বাঙালির সংস্কৃতি ছিল কিছুটা হলেও ভিন্ন। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল ভাত। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় এ দেশের সাগর, নদী, খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে মাছ জন্মাতো। এর মধ্যে রয়েছে যেমন- রূপচাঁদা, কোরাল, লাক্ষ্যা, লইট্যা, ছুরি, ফাইস্যা, রুতলা, মৃগেল, ভেটকি, চিতল, বোয়াল, শোল, কৈ, শিং, মাগুরসহ আরও নানা জাতের মাছ। মাছ উৎপাদনে শীর্ষে থাকলেও রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণে পিছিয়ে বাংলাদেশ। রপ্তানিতে এখন অবস্থান ২১তম। এক যুগে মাছের উৎপাদন ৮৫ শতাংশ বাড়লেও দাম নাগালের বাইরে। রপ্তানি বাধা দূর করতে সরকার এখন জোর দিচ্ছে নিরাপদ মাছ উৎপাদনে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ টন- যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের মোট উৎপাদন ২৫ দশমিক ৬৩ লাখ টনের চেয়ে ৮৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি। মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের চাহিদা ৬০ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭.৮০ গ্রাম। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও মাছের বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই। দাম বাড়ার কারণ নিয়ে চাষিরা বলছেন, মাছের খাবার, ওষুধ ও পরিবহণ খরচ বেড়েছে। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় পুকুর ভরতে হচ্ছে সেচের পানিতে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তার কাছে কম দামে মাছ বিক্রি করা যাচ্ছে না। প্রতিবেদনটি দেখা যায়, সেরা ১০ রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য ৫২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া অন্যতম। বৈশ্বিক আর্থিক মন্দায়ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৯ দশমিক ৮৮ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা।

রপ্তানিযোগ্য মাছ ও মাছের পণ্য ট্রেসেবিলিটি পদ্ধতি কার্যকর করার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার চিংড়ি খামার এবং ৯ হাজার ৬৫১টি বাণিজ্যিক মৎস্য খামারের রেজিস্ট্রেশন শেষ হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি চিংড়ি চাষিদের নিয়ে ৩০০টি ক্লাস্টার গঠন করে ই-ট্রেসেবিলিটি কার্যক্রম পাইলটিং করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে নিরাপদ ও মানসম্মত চিংড়ি উৎপাদন নিশ্চিত করতে 'স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর ম্যানুয়াল' প্রণয়ন করা হয়েছে। ওষুধের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে 'অ্যাকোয়াকালচার মেডিসিনাল প্রোডাক্টস নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা' মাঠ পর্যায়ে চাষিদের দেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে আগামীতে মাছ রপ্তানি বাড়বে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে