বাংলাদেশ, ভারতসহ উপমহাদেশে অধিকাংশ এলাকাতেই গ্রীষ্মের একটি জনপ্রিয় ফল জাম। পুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত উপকারী ভূমিকার কারণে এটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। শুধু ফলই নয়, এর বীজেও আছে অনেক ঔষধিগুণ। এটি কম ক্যালরিতে অধিক পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে বিধায় ক্যালরি রেস্ট্রিক্টেড ডায়েটে আদর্শ স্ন্যাক হিসেবে গ্রহণযোগ্য। জাম, তাজা ফলের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে খাওয়া হয়ে থাকে যেমন : লবণ-মরিচ দিয়ে মাখিয়ে, ফলের রস হিসেবে, স্মুদি তৈরি করে, জ্যাম তৈরি করে।
জামের পুষ্টি উপাদান : ১০০ গ্রাম জামে আছে-ক্যালরি ৬০-৬২ ক্যালরি, শর্করা ১২-১৪ গ্রাম, আয়রন ১.৩-১.৬ মি. গ্রাম, ফিলক এসিড ৩ মাইক্রো গ্রাম, ভিটামিন- এ ৮ আই ইউ, ভিটামিন-সি ৬-১৮ মি. গ্রাম, সোডিয়াম ২৬ মি. গ্রাম, পটাশিয়াম ৫৫ মি. গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৮-১৫ মি. গ্রাম, ফসফরাস ১৬ মি. গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৩৫ মি. গ্রাম
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে জাম: জামের গস্নাইসেমিক ইনডেক্স কম এবং এতে বিদ্যমান উপাদান অগ্নাশয়ের যেখানে ইন্সুলিন তৈরি হয় সেই অংশের সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় জানা গেছে যে, জামের বীজের গুঁড়াও পর্যাপ্ত ইন্সুলিনের নিঃসরণে সহায়তার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বহুকাল ধরেই জাম ও জামের বীজ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে : জামের বীজের গুঁড়া রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে উপকারী কোলেস্টেরল বা এইচডিএল-এর মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। যার ফলে রক্ত সংবহন তন্ত্রের ঝুঁকি কমায়।
রক্তস্বল্পতা দূর করে : জামে আয়রন ও ফলিক এসিডের পর্যাপ্ত উপস্থিতির কারণে এটি রক্তস্বল্পতার চিকিৎসা ও প্রতিরোধে বিশেষ কার্যকরী।
দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও রক্ষণাবেক্ষণ করে।
এতে প্রচুর ভিটামিন-সি থাকার ফলে এটি দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে : এটি উচ্চ পটাশিয়ামযুক্ত হওয়ায় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, শরীরের পানির ভারসাম্য বজায় রাখা, মাংসপেশীর কার্জক্ষমতা বজায় রাখা এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্ষমতার রক্ষণবেক্ষণে সহায়তা করে।
বিভিন্ন দূরারোগ্য রোগের ঝুঁকি কমায় : এতে উপস্থিত প্রচুর পরিমাণ ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট এন্থোসায়ানিন ও অন্যান্য অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শরীরে ইনফ্লামেশন রোধ করে, ক্যানসার, ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের প্রাচুর্য শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়, শরীরের ফ্রি রেডিকেলস দূর করে, রক্তনালিতে চর্বি জমা হওয়া প্রতিহত করে হার্টে বস্নক তৈরির ঝুঁকি কমায়। এটি শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ বৃক্কের মাধুমে নিষ্কাশনে সহায়তা করার কারণে ভালো ডিটক্সিফায়ার হিসেবেও পরিচিত।
সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমায় : জাম গাছের ছাল, বাকল, বীজ, ফল সবকিছুতেই ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণরোধকারী উপাদান রয়েছে বিধায় প্রাচীনকাল থেকেই ভেষজ ও আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে জাম গাছের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
হজমে সহায়ক : এতে প্রচুর ফাইবার থাকার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য ও এসিডিটি দূর করে পরিপাকতন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। এর হালকা টক-মিষ্টি স্বাদ ভ্রমণজনিত বমিভাব দূর করতে সহায়তা করে। এর অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল বৈশিষ্ট্যের কারণে মুখের দুর্গন্ধ প্রতিহত করে। প্রাচীনকাল থেকে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়া ও আমাশয়ের ঘরোয়া চিকিৎসায় জাম ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
প্রাকৃতিক মূত্রবর্ধক : এটি বেরি জাতীয় ফল যা প্রাকৃতিক মূত্রবর্ধক। মূত্রথলির ইনফেকশনে এটি ঔষধি হিসেবে কাজ করে।
ত্বকের সুরক্ষা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে : এর এস্ট্রিঞ্জেন্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে তকের লোমকূপের দৃশ্যমানতা কমায়, তৈলাক্ততা রোধ করে, ত্বককে দাগ, ব্রণ, বলিরেখা ও শুষ্কতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে ত্বককে তারুণ্যদীপ্ত রাখতে সহায়তা করে।
ব্রেইন বুস্টার, স্মৃতিশক্তি বর্ধক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষাকারী: সর্বোপরি এর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের পর্যাপ্ততা ও অধিক ফাইটোনিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতির কারণে এটি ব্রেইন বুস্টার, স্মৃতিশক্তি বর্ধক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষাকারী হিসেবেও আয়ুর্বেদ ও ভেষজ চিকিৎসকদের কাছে সুপরিচিত।
জামের স্বাস্থ্যঝুঁকি : যে কোনো খাবারই অতিরিক্ত খেলে কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। পরিমিত জাম খেলে যেমন হজমে সহায়তা করে, তেমনি অতিরিক্ত খেলে তা থেকে হতে পারে পেট ফাঁপা, পেটে ব্যথা এমনকি বমিও হতে পারে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের চিকিৎসায় জাম খেতে বলা হলেও মাত্রাতিরিক্ত খেলে তা রক্তের শর্করার মাত্রা ও রক্তচাপকে অনিয়ন্ত্রিত করতে পারে এমন সম্ভাবনাও রয়েছে। তাই বহুমুখী উপকারিতা আছে ভেবে অনেক বেশি পরিমাণে জাম খাওয়া যাবে না, এমনকি কোনো নির্দিষ্ট রোগের ব্যবস্থাপনার জন্য যদি খাওয়া হয় তাহলেও জেনে নিতে হবে এর নির্দেশিত পরিমাণ।
লেখক : সিনিয়র ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান ও নিউট্রিশনিস্ট, ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।