রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে আধুনিক হচ্ছে কৃষি

প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন
  ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে আধুনিক হচ্ছে কৃষি

ফসল আবাদে বাড়ছে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার। ফলে বদলে যাচ্ছে কৃষির দৃশ্যপট। গ্রামীণ কৃষি পরিণত হচ্ছে এক আধুনিক কৃষিতে। এখন জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ধান কাটা মাড়াই, ঝাড়া ও শুকানো সবই হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষি প্রবেশ করেছে যান্ত্রিক যুগে। এতে শুধু ফসল উৎপাদনের ব্যয়ই কমছে না, কমছে ফসল ঘরে তোলার সময়ও। সময়মতো ফসল সংগ্রহ করার ফলে হ্রাস পাচ্ছে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি। সাশ্রয় হচ্ছে কৃষকের সময়ও। হ্রাস পাচ্ছে কৃষকের কায়িক শ্রম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে ফসল। সংগ্রহোত্তর অপচয় হ্রাস পাওয়ায় বেশি ফসল পাচ্ছে কৃষক। উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় কৃষকের লাভের পরিমাণ বাড়ছে। এতে প্রতি বছর শুধু বোরো ও আমন মৌসুমেই কৃষকের সাশ্রয় হচ্ছে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা। যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে খরপোশের কৃষি হচ্ছে আধুনিক ও ব্যাণিজিক।

দেশের উন্নয়নের ধারার সঙ্গে পালস্না দিয়ে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। দেশের কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে বড় সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। কৃষিতে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় হ্রাস, শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে শুরু হয় কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। তার নির্দেশনায় ১৯৭৩ সালে দ্রম্নততম সময়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো নামমাত্র মূল্যে ভর্তুকি দিয়ে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প, দুই হাজার ৯০০ গভীর নলকূপ এবং তিন হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। আধুনিক কৃষিযন্ত্র সম্প্রসারণে এটি ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

সনাতন পদ্ধতিতে প্রতি একর জমির ধান কাটা, ধানসহ খড় পরিবহণ, মাড়াই ও ঝাড়াইয়ে খরচ হয় ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। আর একই পরিমাণ জমির ধান কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে কাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও পরিবহণ বাবদ খরচ হয় ছয় হাজার টাকা। অর্থাৎ কৃষিযন্ত্র ব্যবহারে প্রতি একরে কৃষকের খরচ কমছে আট হাজার টাকা। আউশ, আমন ও বোরো মৌসুম মিলিয়ে এক বছরে কম্বাইন হার্ভেস্টার ব্যবহার করে কৃষকদের প্রায় তিন হাজার পঞ্চাশ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।। কম্বাইন হারভেস্টারের কারণে যেখানে ১টি ফসল হতো সেখানে এখন ২টি ফসল যেখানে ২টি ফসল হতো সেখানে ৩টি ফসল হচ্ছে।

গত আমন ও বোরো মৌসুমে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ধান কাটার ফলে সংগ্রহোত্তর অপচয় ১০ শতাংশ থেকে কমে দুই শতাংশ চলে এসেছে। শস্যের অপচয় রোধ ৪,১৩,৭১৬ টন- যার বাজার মূল্য ১০১৮ কোটি টাকা। ফলে কৃষক আট শতাংশ ধান বেশি পাচ্ছে। এছাড়া, কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করে কৃষক কম সময়ে ফসল ঘরে তুলতে পারছে। সময়মতো ফসল সংগ্রহ করায় সংগ্রহোত্তর ক্ষতি অনেক কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগেই কৃষক ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারছেন। সাশ্রয় হচ্ছে কৃষকের সময়। হ্রাস পাচ্ছে কৃষকের কায়িক শ্রম। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় কৃষকের লাভের পরিমাণ বাড়ছে। কম্বাইন হারভেস্টারের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক বাজারেও। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এক জরিপে দেখা যায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন ও ভারতের পর তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। দেশের কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে নতুন ধানের জাতসহ যন্ত্র নিভর্রতা বাড়ায় উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কারণে দেশে কৃষিযন্ত্র ব্যবসায় নতুন নতুন কোম্পানি আসছে। আগে কৃষিযন্ত্রের ব্যবসার সঙ্গে ১৪টি কোম্পানি জড়িত ছিল। এখন সেখানে ৪০টি কোম্পানি যুক্ত হয়েছে। এতে বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে কৃষকরা সঠিক মূল্যে কৃষিযন্ত্র কিনতে পারছেন। কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে খুচরা যন্ত্রাংশের চাহিদা বাড়ছে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে ঘিরে সারাদেশে খুচরা যন্ত্রাংশের বিশাল বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে এক অনন্ন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। অনেক স্বল্প ও উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক এ প্রকল্পের আত্ততায় ২৮ দিনের আবাসিক মেকানিক প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরি না করে কম্বাইন হারভেস্টার ভুর্তুকিতে ক্রয় করে বিভিন্ন জেলায় ধান কর্তন করে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন।

ফসল আবাদে বাড়ছে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার। ফলে বদলে যাচ্ছে কৃষির দৃশ্যপট। সনাতন কৃষি পরিণত হচ্ছে এক আধুনিক কৃষিতে। এখন জমি প্রস্তুতত থেকে শুরু করে ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও শুকানো সবই হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষি প্রবেশ করেছে যান্ত্রিক যুগে। এতে শুধু ফসল উৎপাদনের ব্যয়ই কমছে না, কমছে ফসল ঘরে তোলার সময়ও। সময়মতো ফসল সংগ্রহ করার ফলে হ্রাস পাচ্ছে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি। সাশ্রয় হচ্ছে কৃষকের সময়ও। হ্রাস পাচ্ছে কৃষকের কায়িক শ্রম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে ফসল। সংগ্রহোত্তর অপচয় হ্রাস পাওয়ায় বেশি ফসল পাচ্ছে কৃষক।

এক সময় দেশে চাষাবাদ হতো গরু ও মহিষ দিয়ে। শ্রমিক সংকটে ধানকাটা নিয়েও বিপাকে পড়তে হতো। সময়ের ব্যবধানে গত কয়েক বছরে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ায় কৃষকদের সেই কষ্ট লাঘব হয়েছে। এখন আর শ্রমিকদের অপেক্ষায় দিন গুণতে হয় না কৃষকদের। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের ফলে স্বল্প সময়েই কয়েক বিঘা জমি চাষাবাদ করা যাচ্ছে। রাইস ট্রান্সপস্নান্টার যন্ত্রের মাধ্যমে ঘণ্টায় ২.৫ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করা যায়। এতে কৃষকের শ্রমিক, সময় ও অর্থের সাশ্রয় হয়। চারা রোপণে যন্ত্রটি ব্যবহার করলে রোপণ খরচ ৫০ থেকে ৭৫ ভাগ পর্যন্ত কমানো সম্ভব বলে জানা যায়। আবার স্বল্প শ্রমিকেই মাইলের পর মাইল হয়ে যাচ্ছে ধান কাটা ও মাড়াই। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ঘণ্টায় চার বিঘা জমির ধান কাটা যাচ্ছে। চাষাবাদ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত সবখানেই যন্ত্র তাদের সাহায্য করছে। চাষ, সেচ, নিড়ানি, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০-৯৫ শতাংশ যন্ত্র দিয়েই হচ্ছে।

আধুনিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়ায় দেশের কৃষির অবস্থা ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি ও খরচ কমিয়ে আনতে এখন বড় ভূমিকা রাখছে আধুনিক কৃষিযন্ত্র। এগুলোর মধ্যে আছে ফসল কাটা ও শস্য সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, মাটিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গভীরভাবে কর্ষণ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে পাওয়ার টিলার। এটি মাটিকে প্রায় ১২ ইঞ্চি গভীর থেকে আলগা করে। মাটিকে বীজবপনের উপযোগী করে প্রস্তুত করার কাজে রয়েছে পস্ন্যান্টার। মাটিকে চাষাবাদের উপযোগী করতে ও বসতবাড়ির কাজে লাগাতে ব্যবহৃত হচ্ছে টু হুইল ট্রাক্টর। বীজবপন, সার দেওয়া, কীটনাশক ছিটানো প্রভৃতি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ব্রডকাস্ট সিডার। নির্দিষ্ট স্থানে বীজ বপন করতে রয়েছে সিড ড্রিল। এ যন্ত্রটি ব্রডকাস্ট সিডার অপেক্ষা আধুনিক। এ ছাড়া রয়েছে মেনুয়র স্প্রেডার, স্প্রেয়ার, বিন হার্ভেস্টার, চেজার বিন, কর্ন হার্ভেস্টার ইত্যাদি।

ফলে হালের বলদ আর হাতে তৈরি যন্ত্রপাতির ব্যবহার এখন আর হয় না বললেই চলে। হাল চাষ করার জন্য এখন আর ব্যবহার হয় না লাঙ্গল। ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার নামের চাষের মেশিন দিয়ে এখন নিমিষেই রোপণ উপযোগী করা হয় জমিকে। জমিতে সার দেওয়ার জন্য কিংবা জমির আগাছা দমন করার জন্য দিনের পর দিন আর কষ্ট করতে হয় না। মেশিনের সাহায্যে সহজেই এখন এই কাজগুলো সম্পন্ন করা যায়।

ফসল পরিপক্ব হয়ে গেলে জমি থেকে বাড়িতে ওঠানো পর্যন্ত কৃষকের ঘুম হয় না। এই কাজের জন্য এক সময় অনেক লোকের দরকার হতো। কিন্তু আধুনিক কৃষিতে ফসল কাটার যন্ত্র যোগ হওয়ায় কৃষকরা এখন অনেকটাই শঙ্কামুক্ত থাকেন। ফসল কাটা থেকে মাড়াই পর্যন্ত প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ায় একদিনেই একরের পর একর জমির ধান ঘরে তোলা সম্ভব হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে কৃষি যন্ত্রের মাধ্যমে নিরাপদে ফসল ঘরে তুলতে পেরে কৃষকও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।

এক সময় মনে করা হতো আধুনিক কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়লে কৃষি খাতে বেকারের সংখ্যা বাড়বে। অথচ এখন কৃষি শ্রমিকের সংকট এবং মজুরি যে হারে বাড়ছে তাতে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় কমাতে আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের বিকল্প নেই। ফলে সরকার উদ্যোগী হয় দেশে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য। দেশের উন্নয়নের ধারার সঙ্গে পালস্না দিয়ে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষি ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। এক যুগেরো বেশি সময় ধরে চলা সরকারের যান্ত্রিকীকরণ উদ্যোগ ব্যাপকভাবে প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, গ্রামীণ শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ এখন কৃষিকাজ করে। ২০৩০ সাল নাগাদ তা কমে ২০ শতাংশ হবে। ফলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া আর বিকল্প নেই। বাংলাদেশে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ একটি প্রতীকী প্রয়াস যার লক্ষ্য কৃষিতে মনুষ্য শ্রমের ঘাটতি দূর করা, কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা, ফসল-সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে ক্ষতি হ্রাস, উৎপাদন খরচের ব্যাপক সাশ্রয় এবং খাদ্যের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা। এতে ফসলের সংগ্রহোত্তর অপচয় কমেছে আট শতাংশ। কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের ফলে আট ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন কৃষক। কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করায় প্রতি একরে আদি পদ্ধতির চেয়ে কৃষকের সাশ্রয় হচ্ছে আট হাজার টাকা। হাওরে শ্রমিক সংকট কাটাতে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বাইরের জেলা থেকে শ্রমিক আনা হতো। ধান কাটার জন্য স্থানীয় কাজ বন্ধ করে দেওয়া হতো। বর্তমানে শ্রমিক সংকট দেখা যায় না। উল্টো দ্রম্নত ধান কেটে সময় ও অর্থের সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের এক গবেষণা বলছে, চাষ, সেচ, নিড়ানি, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০-৯৫ শতাংশ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যদিও ফসল রোপণ, সার দেওয়া, কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখনো অনেক কম। আধুনিক কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়ায় দেশের কৃষির অবস্থা ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির ও খরচ কমিয়ে আনতে এখন বড় ভূমিকা রাখছে আধুনিক কৃষিযন্ত্র।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে