রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ইলিশ উৎপাদনে প্রথম বাংলাদেশ

বর্তমানে বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই হয় বাংলাদেশে
ইমরান ছিদ্দিকি
  ৩০ জুন ২০২৪, ০০:০০
ইলিশ উৎপাদনে প্রথম বাংলাদেশ

রুপালি রঙ। জাদুকরি স্বাদ। সরষে ইলিশ, ইলিশ পাতুড়ি, ইলিশ ভাজা, হরেক পদের রান্না, হরেক রকম স্বাদ। জাতীয় মাছ ইলিশের এক পদের তুলনা হতে পারে কেবল আরেক পদের সঙ্গেই। আর তা যদি পদ্মার ইলিশ হয় তাহলে তো কথাই নেই। ইলিশের সুঘ্রাণ শুধু বাঙালিকে নয়, ভূতকেও নাকি পাগল করে দেয়। বাঙালির বর্ষবরণ ইলিশ ছাড়া হয় না। ওপার বাংলায় জামাইষষ্ঠীতে তো ইলিশ লাগবেই।

ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় ৫০ ভাগ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। ওই ফ্যাটি এসিডের প্রায় ২ শতাংশ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড- যা মানবদেহের কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া ইলিশের আমিষে ৯ ধরনের অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়- যা মানুষের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না। ইলিশের চর্বিতে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন 'এ' ও 'ডি' থাকে। এ জন্য ইলিশ স্বাস্থ্যবান্ধব মাছ হিসেবে অধিক পরিচিত।

ইলিশের উৎপাদন বাড়িয়ে বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে বিশ্ব উদাহরণ। গবেষকরা বলছেন, ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ প্রথম। মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের গবেষণায় এ তথ্য ওঠে এসেছে। ইলিশ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশে। মাত্র চার বছর আগেও এই উৎপাদনের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে। গত ২০১৬ সালে ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইলিশের স্বত্ব এখন শুধুই বাংলাদেশের।

ইলিশেরমোট আয়ুষ্কাল ৫ থেকে ৭ বছর। আহরিত ইলিশের ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট তিন প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে দুটি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারা জীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর একটি মিঠা পানি ও লোনা পানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ স্রোতের বিপরীতে দৈনিক ৭০ কিলোমিটার অভিপ্রায়ণ করতে পারে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে : বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের ৮৬ ভাগ বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত।

ইলিশ গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে ইলিশের আহরণ প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ইলিশ আছে- বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে ১০টিতেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশের উৎস বাংলাদেশ। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দাবি করছে বর্তমানে বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশে। মাত্র চার বছর আগেও এই উৎপাদনের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। সরকারের নানা কার্যকর পদক্ষেপের ফলে ধারাবাহিকভাবে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বলে মনে করছেন মৎস্য গবেষকরা।

মাছ বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরতীরের ভারত-মিয়ানমার, আরব সাগর তীরের বাহরাইন-কুয়েত, পশ্চিম মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মেকং অববাহিকার ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া, চীন সাগরের পাশে চীন ও থাইল্যান্ডে ইলিশের বিচরণ কমছে। আর বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের প্রায় ৮৬ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। ভারতে ৮ শতাংশ, মিয়ানমারে ৩ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোতে বাকি ইলিশ ধরা পড়ে।

বিশ্বে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৮৬ ভাগের বেশি বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। ইলিশের আকার ও স্বাদ বাড়ছে। সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে প্রতি বছর বছর ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে। ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালে কোনোভাবেই দেশের জলসীমায় ইলিশ আহরণের অবৈধ প্রচেষ্টা সফল হতে দেওয়া হয়নি। ইলিশের প্রজনন মৌসুমে কোনোভাবেই মা ইলিশ আহরণ করতে দেওয়া হয়নি। খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় চলতি বছর জেলেদের জন্য ১০ হাজার ৫৬৬ টন ভিজিএফ চাল বরাদ্দ করা হয়। ৩৬টি জেলার ১৫২টি উপজেলায় মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৪২টি জেলে পরিবারের জন্য ২০ কেজি হারে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়।

বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইলিশের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। দেশের মোট মাছের ১২ শতাংশের উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে। যার অর্থমূল্য আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদিত ইলিশের যেটুকু রপ্তানি হয় তাতে ১৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। প্রায় পাঁচ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ পরিবহণ, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।

ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশের ইকোফিশ প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক ডক্টর এম এ আবদুল ওহাব যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশের মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশ যৌথভাবে ইলিশের জিনগত বৈশিষ্ট্য ও গতিবিধি নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছে। গত ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। বাংলাদেশে ইলিশের জনপ্রিয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাদের কারণে পাশের দেশেও বাংলাদেশের ইলিশের কদর অনেক। বিশ্বব্যাপী এই রুপালি ইলিশের কদর রয়েছে। ওয়াল্ড ফিস সেন্টারের তথ্যমতে ২৫টি ভাষায় ইলিশের ১১০টি স্থানীয় নাম রয়েছে। এই 'মীনসন্তান' নানা দেশে নানা নামে পরিচিত। তাই এক ইলিশের হরেক নাম।

চাঁদপুরের মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের ইলিশ গবেষক আনিসুর রহমান বলেন, ইলিশ মূলত নোনা পানির মাছ। তবে প্রজনন মৌসুমে ডিম পাড়তে নদীর উজানের দিকে আসে ইলিশ। ফলে, দেশের বৃহৎ নদীসমূহ যথা পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ইত্যাদি নদীতে ধরা পড়ে রুপালি ইলিশ। ইলিশ মূলত বাংলাদেশের মাছ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৮০ শতাংশ ইলিশের উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। তিনি বলেন, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। মাছের রাজা হিসেবে পরিচিত ইলিশ। একটি পরিপক্ব ইলিশ প্রতিদিন স্রোতের বিপরীতে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে যেতে পারে। ইলিশ নিয়ে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন সোয়া দুই লাখ টন থেকে বেড়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ডক্টর ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সুরক্ষিত হওয়ায় এবং জাটকা ধরা থেকে জেলেদের বিরত রাখার কারণে ইলিশের উৎপাদন পর্যায়ক্রমে বাড়ছে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও ইলিশ গবেষক সুগত হাজরা এক গবেষণায় বলেন, ইলিশ মাছের মধ্যে ওমেগা-৩ নামে একধরনের তেল রয়েছে- যা হৃদরোগসহ বেশ কিছু রোগের ওষুধ হিসেবে বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি মাছে এই তেল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইলিশ মাছের সু্যপ অনেক দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বিশ্বের সব দেশই ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে চাইছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

সম্প্রতি অধ্যাপক ওহাবের গবেষণা প্রবন্ধটিতে বলা হয়, মা ইলিশ রক্ষা অভিযানের অংশ হিসেবে প্রতি বছর ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে এই মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এ কর্মসূচিও ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ওয়ার্ল্ড ফিশ, মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুধু পরিমাণের দিক থেকেই নয়, আকৃতির দিকে থেকেও কোনো দেশ বাংলাদেশের ইলিশের ধারে কাছে নেই। যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইলিশ মাছের সু্যপ অনেক দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বিশ্বের সব দেশেই ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে চাইছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে