আধুনিক পদ্ধতিতে গম চাষ করলে বেশি ফলন পাওয়া যেতে পারে
ধানের চাষ যতটা প্রসার লাভ করেছে, গম উৎপাদনে ততটা হয়নি
প্রকাশ | ২৩ জুন ২০২৪, ০০:০০
ইমরান ছিদ্দিকি
বিশ্বের অন্যতম দানাদার খাদ্যশস্য গমের অবস্থান বাংলাদেশে দ্বিতীয়। ধানের মতো গম উৎপাদন বাড়েনি। দেশে বছরে গমের চাহিদা কমবেশি ৮৬ লাখ টন। আর দেশে উৎপাদিত গমের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভাতের পরই বাংলাদেশে যে খাদ্যটির চাহিদা বেশি সেটি হলো আটা বা ময়দা। আর আটা-ময়দা আসে গম থেকে। দেশের মানুষের বিশেষ করে শহরাঞ্চলে সকালের নাস্তার একটা বিরাট অংশজুড়ে থাকে গমের আটা বা ময়দার রুটি- পরোটা। যদিও বাংলাদেশে গমের চাষ যতটা প্রসার লাভ করার কথা ছিল ততটা হয়নি, তবুও যে পরিমাণ জমিতে গমের চাষ হয় সেই জমিতে আধুনিক পদ্ধতি মেনে চাষ করলে গমের ফলন বেশি পাওয়া যেতে পারে।
চলতি বছর সারাদেশে গমের চাষ হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টন। দেশে গমের চাহিদা রয়েছে ৮৫ থেকে ৮৬ লাখ টন। প্রতি বছর গম আমদানি করতে হচ্ছে ৭৪ থেকে ৭৫ লাখ টন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে শীতের স্থায়িত্ব কমে যাচ্ছে বলে গবেষকদের মতামত। আর এ কারণে গম আবাদও কমে যাচ্ছে। তবে গম আবাদ বৃদ্ধির জন্য উন্নত জাত, শ্রমিক সংকট, ইঁদুরের উপদ্রব, মাড়াইয়ের সমস্যা, গমের বস্নাস্ট রোগ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এসব বিষয়ে দৃষ্টি দিলে গম আবাদে আবারো সুদিন ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব গম সেক্টরে পড়েছে- কারণ, বাংলাদেশ ইউক্রেন থেকে ৩য় সর্বোচ্চ গম আমদানিকারক দেশ। এফএও'র হিসাব মোতাবেক বিশ্বের যে কয়টি দেশে সবচেয়ে দ্রম্নত হারে গমের আমদানি বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৫৩ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ টন গম আমদানি হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২১ সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে এক কথায় দেশে এই দানা শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। গমের ফলন বৃদ্ধিতে কয়েকটি আধুনিক প্রযুক্তি উদ্বাবন জরুরি।
চলতি বছর গমের ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় হাসি ফুটেছে পাবনার চাটমোহরের চাষিদের মুখে। ইতোমধ্যেই নির্বিঘ্নে গম কেটে ঘরে তুলেছেন তারা। এ বছর গম চাষিরা বিঘা প্রতি লাভ করেছেন প্রায় ১০ হাজার টাকা। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জান গেছে, এ বছর চাটমোহর উপজেলায় গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৩ হাজার ৭১০ হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৪০ হেক্টর জমিতে গম চাষ বেশি হয়েছে। হেক্টর প্রতি গড় ফলন পাওয়া গেছে প্রায় ৩ দশমিক ৮৪ টন। সে হিসেবে উপজেলায় গমের উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ২৪৬ টন।
উপজেলার রামনগর গ্রামের গমচাষি বকুল হোসেন জানান, চাষ, বীজ, সার, সেচ, আগাছা পরিষ্কার, কীটনাশক ও কর্তন শ্রমিক খরচসহ গম চাষে বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে প্রায় সাত হাজার টাকা। বিঘা প্রতি ফলন পাওয়া গেছে ১০ থেকে এগারো মণ। বর্তমান বাজারে প্রতি মণ গম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। সে হিসেবে বিঘা প্রতি কৃষক ১০ হাজার টাকার কিছু কম বেশি লাভ পাচ্ছেন। গম চাষি রেজাউল করিম জানান, এক বিঘা জমিতে গম আবাদে এবার তার খরচ হয়েছিল আট হাজার টাকা। সাড়ে ১১ মণ গম পেয়েছেন তিনি। যার বাজারমূল্য প্রায় ১৯ হাজার টাকা। তিনি আরও জানান, এবার গম চাষে কৃষক বিঘা প্রতি প্রায় ১০ হাজার টাকা লাভ পেয়েছেন।
আগের তুলনায় গমের চাহিদা অনেক বেড়েছে, তবে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে গম চাষ। দেশে গমের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে গম আমদানি করতে হচ্ছে। লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে গম আমদানি করতে হয়। কৃষকরা জানান, তারা গম চাষে আশানুরূপ লাভবান হতে পারছেন না। তাই গম চাষের পরিবর্তে অন্যান্য ফসল চাষ করছেন। কয়েক বছর আগেও কৃষক গম চাষ করতেন। বর্তমানে কম সংখ্যক কৃষক গম চাষ করছেন, তারপরও পরিমাণে কম জমিতে।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও রংপুরে গত বছর গম চাষ হয় ১৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৬৫ হাজার ৬৬১ টন। এর আগের বছর গম চাষ হয়েছিল ২০ হাজার ১৬০ হেক্টর জমিতে। ২০২০ সালে জমির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৬৫০ হেক্টর। ১০ বছর আগে গম চাষ হয়েছিল ৬৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এ স্থলবন্দর দিয়ে প্রতি বছর ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে গম আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত এসব গম স্থলবন্দরে বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এ স্থলবন্দরে এসে আমদানিকারকদের কাছ থেকে গম কিনে নিয়ে যান।
গম বীজ বোনার উপযুক্ত সময় হলো কার্তিক মাসের শেষ থেকে অগ্রহায়ণের তৃতীয় সপ্তাহ বা নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত। এ সময় বোনা যায় এমন জাতের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- কাঞ্চন, আকবর, অগ্রণী, প্রতিভা, সৌরভ, গৌরব, সোনালিকা। কিন্তু কিছু কিছু জাত আছে যেগুলো কিছুটা তাপ সহনশীল, সেগুলো ডিসেম্বর মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত বোনা যেতে পারে। এই জাতগুলো হলো- সুফী, বিজয় ও প্রদীপ। উঁচু ও মাঝারি দোআঁশ মাটি গম চাষের জন্য বেশি উপযোগী। লোনা মাটিতে গমের ফলন কম হয়।?সাধারণত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি গম চাষের জন্য উপযুক্ত- তবে মাঝারি নিচু জমিতেও গম চাষ চলে? দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটি গম চাষের জন্য সর্বোত্তম; সহজে পানি নিষ্কাশিত হয় এমন ভারী অর্থাৎ এঁটেল ও এঁটেল-দোআঁশ মাটিতেও গমের চাষ করা চলে।?
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতেই গমের চাষ বেশি হয়ে থাকে। বৃহত্তর দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর ও ফরিদপুর জেলা ছাড়াও দেশের মধ্যাঞ্চলে (বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ঢাকা ও কুমিলস্না) কমবেশি গমের চাষ হয়ে থাকে। গম চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি জমি বেশি উপযোগী। তবে মাঝারি নিচু জমিতেও গম চাষ করা যায়। দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি গম চাষের জন্য সর্বোত্তম। কারণ, সহজে পানি নিষ্কাশিত হয়, এমন এঁটেল ও এঁটেল- দোআঁশ মাটিতেও গমের চাষ করা যায়।
গমে সাধারণত পোকার আক্রমণ কম হয়। তবে কখনো কখনো কাটুই পোকা, জাব পোকা ও মাজরা পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। জমির শেষ চাষের সময় কার্বোফুরান জাতীয় কীটনাশক প্রয়োগ করে কাটুই পোকা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। উত্তরাঞ্চলের মাটিতে মাঝে মাঝে গমে চিটা দেখা যায় এবং এর ফলে ফলন কমে যায়। অনুমোদিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ এবং বিঘা প্রতি ৮০০ গ্রাম বরিক এসিড বা ১ কেজি ৩০০ গ্রাম বোরাক্স প্রয়োগ করলে চিটা দূর হয়। আক্রান্ত বীজের মাধ্যমে গমের বস্নাস্ট রোগ ছড়ায়। গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময় তুলনামূলক গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় থাকলে এ রোগের আক্রমণ ঘটতে পারে। পাতায় চোখের ন্যায় ধূসর বর্ণের ছোট ছোট দাগ পড়ে। শীষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে। আক্রান্ত স্থানের উপরের অংশ সাদা হয়ে যায়। শীষের গোড়ায় আক্রমণ হলে পুরো শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। আক্রান্ত শীষের দানা অপুষ্ট হয় এবং কুঁচকে যায় এবং দানা ধূসর বর্ণের হয়। পাতাও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে এবং এক্ষেত্রে পাতায় চোখের মতো ধূসর বর্ণের ছোট ছোট দাগ পড়ে।