ঔষধি ভেষজ হিসেবে আকন্দ গাছের রয়েছে অনেক উপকারিতা। প্রাচীন ভেষজ চিকিৎসালয়ের মহৌষধি গুণসমৃদ্ধ উদ্ভিদ আকন্দ। এর পাতা গ্রামাঞ্চলের মানুষের প্রাথমিক সেবাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। পাশাপাশি ফুল, মূল, রসালো আঁটা, চূর্ণ ব্যবহার করে ঘরোয়া, কবিরাজি, আয়ুর্বেদিক, ইউনানি, হোমিও চিকিৎসা ও ওষুধ তৈরিতে ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষের বহুবিধ রোগ মুক্তি বা নিরাময়ে মন্ত্র শক্তির মতো কাজ করত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ভেষজ গুণত্বের অভাবে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আকন্দ গাছ। এক সময় গ্রামীণ মেঠো পথের ধারে আকন্দ গাছ দেখা যেত। প্রকৃতির ইশারায় জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠত অনাদরে।
আকন্দের বৈজ্ঞানিক নাম-ক্যালেট্রপিস, গোত্রের নাম প্রোসিরা এসক্লিপিয়েডিসি। পাতা রোমস ধরনের, পাতা ও ডাল হতে দুধের মতো সাদা রঙের রসালো আঁটা বের হয়। পাতা ব্যথানাশক হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। যুগের পর যুগ এই গাছ নানাবিধ রোগের মহৌষধ হিসেবে কাজ করলেও সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।
আকন্দ এক প্রকার গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এটি একটি মাঝারি ধরনের ঝোপজাতীয় উদ্ভিদ। আকন্দ ফুল দুই রকমের- একটি সাদা, আরেকটি বেগুনি রঙের। ফল সবুজ, বীজ লোমযুক্ত। এর বর্ণ ধূসর কিংবা কালচে। আকন্দ সাধারণত সাত থেকে আট ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় এবং এর পাতা পাঁচ থেকে সাত ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। ফেব্রম্নয়ারি থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি আকন্দ গাছে ফুল ফোটে এবং মে থেকে জুন মাসের শেষের দিকে ফল ধরে। ফল পাকে আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসে।
আসলে আমাদের আশপাশেই এই গাছ জন্মে। আমরা অনাদর অবহেলায় তা কেটে ফেলে দেই। পর্যাপ্ত জ্ঞান ও গবেষণার অভাবে তা কাজে লাগাতে পারি না। আকন্দের কষ তুলায় ভিজিয়ে দাঁতে লাগালে ব্যথা দূর করে। আকন্দ পাতার সোজা দিকে সরিষার তেল মাখিয়ে পাতাটি অল্প গরম করে পেটের উপর রাখলে বা ছেঁক দিলে পেট কামড়ানো বা পেট জ্বালা বন্ধ হয়ে যায়। খোস-পাচড়া বা একজিমার ক্ষেত্রে আকন্দের আঁটার সঙ্গে চার গুণ সরিষার তেল মিশিয়ে গরম করে এই গরম তেলের সঙ্গে কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে খোস পাচড়ায় মাখলে তা ভালো হয়ে যায়।
পা মোচকে গেলে তীব্র ব্যথায় এই আকন্দ পাতা দিয়ে গরম ছেক দিলে ব্যথা উপশম হয়। আকন্দ বাত বেদনা নিবারক ও ফোলা অপসারক। আকন্দ পাতা ও হলুদের তৈরি বড়ি ফালা, পান্ডু রোগ নাশক এবং রস কৃমি নাশক। অম্বল বা এসিডিটি দেখা দিলে: ০.৬৫ গ্রাম পরিমাণ আকন্দ পেড়া ছাই পানিসহ পান করলে সঙ্গে সঙ্গে উপকার পাওয়া যায়। কোনো স্থান ফুলে উঠলে আকন্দ পাতা বেঁধে রাখলে উপকার পাওয়া যায়। নিউমোনিয়াজনিত বেদনায় আকন্দ পাতার সোজা দিক ঘি মেখে ব্যথার জায়গায় বসিয়ে লবণের পুটলি দিয়ে ছেক দিলে উপকার হয়। আকন্দ গাছের মূলের ছাল শুকিয়ে চূর্ণ করে আকন্দের আঁটা দিয়ে মুড়িয়ে বিড়ির মতো করে বানিয়ে সেটি আগুন ধরিয়ে ধোয়া টানলে হাঁপানি লাঘব হয়।
আকন্দ পাতা ওষুধ হিসেবে ব্রণ ফাটাতে সাহায্য করে। আকন্দ পাতা দিয়ে ব্রণ চেপে বেঁধে রাখলে ব্রণ ফেটে যায়। বুকে সর্দি বসে গেলে ভালো করে পুরনো ঘি বুকে মেখে আকন্দের পাতা গরম করে ছেক দিলে সর্দি ভালো হয়। আকন্দ চুলের রোগ, ব্যথা এবং বিষনাশে বিশেষ কার্যকরী। দাদ ও টাকপড়া নিবারণ করে। হাঁপানি রোগের মহৌষধ আকন্দ পাতা। ১৪টি আকন্দ ফুলের মাঝখানে চৌকো অংশটি নিতে হবে। তার সঙ্গে ২১টি গুল মরিচ দিয়ে একসঙ্গে বেটে ২১টি বড়ি বানাতে হবে। প্রতিদিন সকালে পানি দিয়ে ১টি বড়ি খেলে হাঁপানি রোগের উপশম হয়। এই ওষুধ খাওয়ার সময় পথ্য হিসেবে শুধু দুধ ভাত খেতে হয়। এতে শ্বাসকষ্ট কেটে যায়। বিছে পোকা কামড়ালে জ্বালাপোড়া কমাতে আকন্দ পাতা ব্যবহার করলে উপশম হয়। শরীরের কোনো স্থানে ক্ষত হলে সেই স্থানটিতে আকন্দ পাতা সেদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হয়। এতে পুঁজ হয় না
এক সময় গ্রামীণ লোকজন এ গাছের পাতা ভাঙা-মোচকা, হাড়-জোড়, বাত ব্যথা, হাঁপানি শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করত। নতুন প্রজন্ম এ গাছ না চেনা বা বিশদ গুণাগুণ সম্পর্কে না জানায় মহামূল্যবান সনাতনি চিকিৎসা ব্যবস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। ঝোপঝাড়, আগাছা মনে করে এর শেকড় উপড়ে ফেলছে। এক সময় ব্যথানাশক হিসেবে মহাশংকর তেল, কেরোসিন, সরিষা তেল সহনীয় গরম করে মালিশের পর আকন্দ পাতা আগুনে হালকা স্যাক দিয়ে প্রলেপ দিত। তাতে দ্রম্নত ব্যথা উপশম হতো। এ চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল খরচ সাশ্রয়ী ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত। এখন বিলুপ্ত প্রায় আকন্দ গাছ। টুকিটাকি চিকিৎসায়ও খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাংলা নাম আকন্দ। এর আদি জন্ম হিমালয় অঞ্চলের পাঞ্জাব, নেপাল, আসাম ও বিহারে। হিমালয় অঞ্চলে আকন্দ সমতল থেকে তিন হাজার ফুটঁ উঁচুতে জন্মায়। বর্তমানে আরব দেশেও এটি ব্যবহৃত হয়। আকন্দের আরও অনেক নাম আছে। আকন্দের সংস্কৃত নাম-অর্ক, মান্দার। হিন্দি-মাদার। আরবি নাম-খর্ক। আকন্দের কান্ড, পাতা ও ফুলে মোমের প্রলেপ দেখা যায়। আকন্দ এক নাগাড়ে ৭ থেকে ৮ বছর বেঁচে থাকে। বড় আকৃতির আকন্দের কান্ড কিছুটা কাষ্টল, নরম ও ভারী হয়। সব সময় উপরের দিকে বাড়ে, তবে পাতা ও ফুল ও ফলের ভারে কিছুটা নু্যয়ে পড়ে। কান্ড শাদা প্রলেপ দেয়া। চিকচিকে। আকর্ষণীয়। কান্ড এতটাই নরম যে সহজে ভেঙে যায় না বরং মচকে যায়। কান্ডের পাতার কোল থেকে শাখা-প্রশাখা বের হয়। কান্ড বা শাখা-প্রশাখা ভাঙে দুধের মতো সাদা কষ বের হয়, যেগুলোকে আকন্দের আঁটা বলে। আকন্দের ফুল বা পাতা যা-ই ছিঁড়ানো হোক না কেন- আঁটা বের হবেই।
সবুজ রঙের পাতা ভারী। সমান্তরাল শিরবিন্যাস। পাতার উল্টো বা নিচের দিকে মোমের আবরণ বেশি দেখা যায়। পাতা হাতে নিয়ে নাড়লে নরম ও আরাম অনুভূত হয়। পাতা পুরু। অনেকটা বট পাতার মতো আকার আকৃতি। লম্বায় পাতাগুলো ১২ থেকে ১৫ সে.মি. হয়ে থাকে। চওড়ায় হয় ৬ থেকে ৯ সে.মি.। বয়স্ক পাতার কোল থেকে শাখা-প্রশাখা বের হয়। পাতার শেষ প্রান্তে কয়েকটি আলাদা আলাদা ফুল বের হয়। সাদা আকন্দে সাদা রঙের ও লাল আকন্দের লালচে বেগুনি রঙের ফুল হয়।