পানির অপর নাম জীবন। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচসহ সব কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। সুপেয় ও চাষাবাদের পানির চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যবহার হয় ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষ সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন। বাংলাদেশে আমন চাষ সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এখন কোনো কোনো বছর ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মিলে না। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ। দেশে আমন মৌসুমে ডিজেল চালিত ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল মাটির নিচ থেকে পানি তুলে। এগুলো ২০ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচ থেকেও পানি তুলতে পারতো। কিন্তু বর্তমানে অনেক এলাকায় মাটির ৩০ ফুট নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির এ দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের সেচ খরচ।
কৃষিবিদ আব্দুস সালাম বলেন, দেশের মূলত মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ৩১ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর এক ফুট নিচে চলে গেলে কৃষকদের বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। এক ফুট বেশি দেবে গেলে বেশি হর্সপাওয়ারের সেচ পাম্প দরকার হয়। এতে জ্বালানি তেল বা বিদু্যৎ বেশি প্রয়োজন হয়। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে বসানো হতো। এখন ১৫০ ফুট নিচে বসানো হলেও পানি মিলছে না।
বোরো মৌসুমে এক কেজি ধান উৎপাদনে দেড় হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এ পানির জোগান আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুধু বোরো উৎপাদনে সেচবাবদ নয় হাজার ৮৭ কোটি টাকার জ্বালানি ব্যয় হচ্ছে। এতে বাড়ছে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়। দেশের কৃষক সেচের পেছনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। ধান উৎপাদনে এ খরচ বিশ্বে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ধান উৎপাদনে পানি প্রয়োজনের বিষয়ে ব্রি ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ সালের তথ্য পর্যালোচনা করেছে। সেখানে দেখা গেছে, ধান উৎপাদনে সর্বোচ্চ গড় ১ হাজার ৩০০ এবং সর্বনিম্ন ১ হাজার ২০০ লিটার পানির প্রয়াজন হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০-৮১ সালে এক কেজি ধান উৎপাদনে সেচের পানির প্রয়োজন হতো ৮ হাজার লিটার। এরপর ২০০৬-০৭ সালে তা কমে ৩ হাজার লিটারে দাঁড়ায়। সর্বশেষ তা দেড় হাজার লিটারে ওঠেছে। প্রতি বছরই ধান উৎপাদনে পানির ব্যয় বাড়ছে। বিশেষ করে হাইব্রিড ধানের ব্যবহার বাড়ায় পানির প্রয়োজন বাড়ছে। কৃষকরাও ভালো ফলনের আশায় অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসির হিসাবে, বর্তমানে দেশে কৃষিকাজে ব্যবহার করা পাম্প আছে ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৩০টি। এর মধ্যে ডিজেল চালিত ১১ লাখ ৯২ হাজার ৬৩০টি। বিদু্যতে চলে মাত্র ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০টি। অগভীর নলকূপ বিদু্যতে চলে ১ লাখ ৫০ হাজার। ডিজেলে চলে ১০ লাখ ৭০ হাজার। গভীর নলকূপের মধ্যে ১২ হাজার ডিজেলে এবং ২৬ হাজার বিদু্যতে চলে। বোরো মৌসুমে ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল কার্যকর থাকে।
কৃষিবিদ ডক্টর আকবর হোসেন বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে, বাড়াতে হবে সেচ দক্ষতা। সে সঙ্গে পানির উৎস্য তৈরি করতে হবে। নদী-নালা খনন ও বড় বড় জলাশয় তৈরি করতে হবে। যত্রতত্র পানি ব্যবহারের ফলে কৃষকের সেচ খরচ বাড়ছে। পানি কম লাগে এমন জাতের উদ্ভাবন করতে হবে। পানি ধরে না রাখতে পারলে আগামীতে ভয়াবহ সেচ সংকটের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। আউশ ও আমন ধানের উৎপাদনে সরকারকে জোর দিতে হবে। এ দুটি ফসল উৎপাদন খরচ কম। বৃষ্টির পানিতে আবাদ করা যায়। অথচ বোরো ধান আবাদে নিয়মিত সেচ দিতে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটে পড়ছে দেশ।
সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। সেচ পাম্পের মাধ্যমে সেচের পানি তুলতে গিয়ে চাপ পড়ছে বিদু্যৎ ও জ্বালানি তেলের ওপর। হাজার কোটি টাকার জ্বালানি ব্যয় হচ্ছে। এতে বাড়ছে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়। এ দেশের কৃষক সেচের পেছনে মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৬২ শতাংশ অর্থ খরচ করে থাকেন। ভয়াবহ হচ্ছে ভূগর্ভস্তরের পানির সংকট, নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। ফসল চাষকে লাভজনক করতে প্রকৃতিনিভর্র আমন ও আউশ উৎপাদনে জোর দিতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ব্রির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বোরো ধান চাষে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রম্নত নিচে নামছে। এতে এক কেজি বোরো ধান উৎপাদনে প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার ৬০০ লিটার সেচের পানির দরকার হয়।
বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে সুপেয় খাবার পানি অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। গ্রীষ্মের শুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামগুলোতে খাবার পানির সংকটে ব্যাহত হয় জনজীবন। ক্রমেই পানি সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে বরেন্দ্র অঞ্চল। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং নাটোরসহ বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিয়দংশ এলাকা জুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল অবস্থিত। সুপেয় খাবার পানি নিয়ে সংঘাতে প্রাণহানিও হয়েছে একাধিকবার। পানি না পেয়ে এলাকা ছাড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ।
পানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের অন্যতম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভয়াবহ সেচের পানি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই সারাদেশে কৃষি কাজে ব্যবহৃত প্রায় আড়াই লাখ শ্যালো টিউবওয়েলে সেচের পানি ওঠেছে না ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে।
ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন আঘাত হানছে। ফলে লবণাক্তত বেড়ে নষ্ট হচ্ছে মিষ্টি পানির আধার। খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় সুপেয় পানি প্রায় দুষ্পাপ্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানি এখন সোঁনার হরিণ। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওরাঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যাপক সংকট রয়েছে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ৫৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছেন। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরাম 'দ্য এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পানি সংকট ভয়াবহ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৯টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশেই পানি সংকট রয়েছে। এর মধ্যে সুপেয় পানির সংকট ভয়াবহ রূপ পেতে চলেছে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ায়।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) 'গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ' অনুযায়ী- গত কয়েক বছরে দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে সেচের পানি সংকট। দেশের অধিকাংশ এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। মহুরি সেচ প্রকল্প, জিকে প্রকল্প, বরেন্দ্র সেচ প্রকল্প এবং মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প বন্ধ হওয়ার পথে। রংপুর, রাজশাহী, খুলনা অঞ্চলেও সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহীতে পানির স্তর গড়ে ২০ থেকে ২৫ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নরসিংদী ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে প্রায় ২৫ ফুট। সবচেয়ে বেশি নেমেছে রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায়।
বিশ্বব্যাংকের পানি বিষয়ক গবেষক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে আগামী ৮০ বছরের মধ্যেই গলে যাবে হিন্দুকুশ ও হিমালয় পবর্তমালার বরফ দুই তৃতীয়াংশ গলে যাবে। দুই পবর্তমালার হিমবাহগুলো অন্তত আটটি দেশের পানির প্রধান উৎস। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমবাহ গলে গেলে চরম ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে এ অঞ্চলের দুইশো কোটিরও বেশি মানুষ। কেউ কেউ আগামী দিনে পানি নিয়ে বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও করছেন।
বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০২০ সালেই বিশ্বের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ পানির স্বল্পতার শিকার হয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ পানির অভাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ধান ও ভুট্টার ফলন দশ শতাংশ কমে যাবে। পানির অভাবে এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানে ইতোমধ্যে শস্যের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমে গেছে।