রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

কাজুবাদাম চাষে হতে পারে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত

ইমরান ছিদ্দিকি
  ০৯ জুন ২০২৪, ০০:০০
কাজুবাদাম চাষে হতে পারে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত

জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির উর্বরতা হ্রাস, একই জমিতে পুনঃপুন চাষ এবং ফসলের উন্নত জাত ব্যবহার না করার ফলে জুমভিত্তিক চাষাবাদ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসছেন চাষিরা। অন্যদিকে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির সহজ বাজার তৈরি, লাভজনক ফল-ফসলের ব্যাপক ফলন, প্রাচীন বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে দেশের কৃষকদের। কৃষি ও কৃষির সব উপ-খাতে সাফল্য অর্জন করেছে বাংলার কৃষকরা। এবার পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়াও সমতলে কাজুবাদাম চাষ হতে পারে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত।

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কৃষির সম্ভাবনাময় ফসল কাজুবাদাম। কাজুবাদাম অত্যন্ত সুস্বাদু একটি নাট বা বাদাম জাতীয় বিদেশি ফসল। বৃক্ষজাতীয় ফসলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কাজুবাদামের স্থান তৃতীয়। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল কাজুবাদামের আদি জন্মস্থান। বর্তমানে উষ্ণমন্ডলীয় দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, কেনিয়া, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, মাদাগাস্কার প্রভৃতি দেশে প্রধানত কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়ে থাকে। দেশের তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িসহ চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিলস্না, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, বৃহত্তর সিলেট, টাঙ্গাইল, শেরপুরের পাহাড় ও টিলা এলাকায় এর প্রচুর চাষ উপযোগিতা রয়েছে।

কাজুবাদাম পাহাড়ি আদিবাসীদের অন্যতম পছন্দের খাবার। পাহাড়ি এলাকায় দিন দিন বন উজাড়ের কারণে প্রতিবেশের চরম ক্ষতি হচ্ছে এবং ফলশ্রম্নতিতে পাহাড়ি জনগণ প্রতিনিয়ত ভূমিক্ষয় এবং ভূমিধসসহ নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। সেই সঙ্গে বন্য পশুপাখির খাবার ও আবাস সংকটের কারণে এদের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কাজুবাদাম বানর জাতীয় প্রাণীদের প্রিয় খাবার। তাছাড়া অনেক বন্যপাখি কাজুবাদাম খেয়ে বাঁচে এবং এর গাছে বাসা বানিয়ে বংশবিস্তার করে। সুতরাং কাজুবাদাম চাষ করে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমি যার প্রায় ৭০ শতাংশ তিন পার্বত্য জেলায়। পাহাড়ি এলাকায় বেকারত্ব প্রকট ও অধিকাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

আমাদের দেশে একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে কাজুবাদাম চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু বাদাম হিসেবেই নয়, কাজু ফলের খোসারও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এ থেকে উৎপাদিত তেল দিয়ে উৎকৃষ্ট মানের জৈব বালাইনাশক তৈরি করা সম্ভব যা নিরাপদ ফসল ও খাদ্যোৎপাদনে অত্যন্তত্ম জরুরি। কাজু ফলের জুসও বেশ জনপ্রিয়। ফলের রস সংগ্রহের পর অবশিষ্ট মন্ড বা ছোবরা দিয়ে জৈবসার উৎপাদন করা যায়। ফলে সবদিক থেকেই কাজুবাদাম একটি লাভজনক কৃষিপণ্য। খাদ্যমানের দিক দিয়ে কাজুবাদাম অতি পুষ্টিকর ফল।

বিশেষজ্ঞদের মতে কাজুবাদামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এন্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার সেলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এটি হৃদপিন্ডের শক্তিদায়ক হিসেবে কাজ করে। ফলে হৃদপিন্ড নানাবিধ রোগ থেকে নিরাপদ থাকে। কাজুবাদামে রয়েছে ওলিসিক নামে এক ধরনের মনো-অ্যানস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড। এটি দেহে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। ফলে নিয়মিত এটি খেলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কাজুবাদামে কপার খনিজ পদার্থ রয়েছে যা চুলের উজ্জ্বল্য বাড়ানোর পাশাপাশি চুলের গোড়াকে শক্তপোক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রোটিন এবং ফাইবার সমৃদ্ধ এ খাবারটি নিয়মিত খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেই সঙ্গে অবসাদ দূর করাসহ শরীরের কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত কাজুবাদাম খেলে শরীরে নানা পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পূরণ হয় এবং সেই সঙ্গে রক্তশূন্যতা দূর হয়।

বর্তমানে দামি হোটেলে ও রেস্তোরাঁয় খাবারের স্বাদ বাড়াতে কাজুবাদাম এখন বেশ জনপ্রিয়। অতি সম্প্রতি কাজুবাদামের সুস্বাদু আচার জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। পুষ্টিগুণের বিবেচনায় চিকিৎসকরা প্রতিদিন একমুঠো করে কাজুবাদাম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী আগামী দিনের কৃষিকে খোরপোষের কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিণত করার জন্য সদা সচেষ্ট।

আগামী এক দশকের মধ্যে এই কাজুবাদাম উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। ইতোমধ্যে অনেক উদ্যেমী তরুণ কাজুবাদাম চাষ করে নতুন স্বপ্ন বোনা শুরু করেছে, আগামীতে তা আরো ভালো হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির উর্বরতা হ্রাস, একই জমিতে পুনঃপুন চাষ এবং ফসলের উন্নত জাত ব্যবহার না করার ফলে জুমভিত্তিক চাষাবাদ-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসছেন পাহাড়িরা। আধুনিক চাষবাস চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বান্দরবানসহ দেশের সব পাহাড়ি এলাকায়। সেখানকার উদ্যোগতারা সনাতন পদ্ধতির জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল না থেকে আধুনিক ও 'লাভজনক' কৃষি ফসলের দিকে ঝুঁকছেন।

শেরপুরের গারো পাহাড়ে এবার পরীক্ষামূলকভাবে উচ্চমূল্যের কাজুবাদামের চাষ হচ্ছে। চাষিদের মুখে হাসিও ফুটতে শুরু করেছে। ফলে সীমান্তের পাহাড়িদের মনে আশার আলো জেগে উঠেছে। অবহেলিত পাহাড়ি জনপদের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরে যেতে পারে এ উচ্চমূল্যের কাজুবাদাম চাষে। বাংলাদেশের সুনিষ্কাশিত বেলে-দোঁআশ মাটিতে বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলের লাল মাটিতে কাজুবাদাম চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কাজুবাদাম চাষ খুব সহজ। বীজ এবং কলম উভয় পদ্ধতিতেই কাজুবাদামের বংশবিস্তার করা যায়। কলমের মধ্যে জোড়াকলম, গুটিকলম, চোখকলম ইত্যাদি প্রধান। বীজ থেকে পলিব্যাগে চারা তৈরি করে কিংবা কলম প্রস্তুত করে জমিতে রোপণ করা হয়। চারা রোপণের ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে ফল ধরা শুরু করে। ১০ থেকে ১২ বছরের ১টি গাছ থেকে বছরে গড়ে ১০ থেকে ১২ কেজি কাঁচা কাজুবাদাম পাওয়া যায়। কাজুবাদাম গাছ ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে এবং ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। চারা রোপণের আগে ৭-৮ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে ১ ঘনমিটার আয়তনের গর্ত তৈরি করে গর্তে সবুজ সার এবং পরিমাণ মতো ইউরিয়া ও টিএসপি সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ১৫ দিন পর চারা লাগাতে হয়। পাহাড়ে, পাহাড়ের ঢালে এবং সমতলভূমিতে হেক্টরে ১৫০ থেকে ১৮০টি চারা রোপণ যথেষ্ট। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি ফুল ফোটার সময়। এপ্রিল থেকে জুন মাস কাজুবাদাম সংগ্রহের সময়। গাছ থেকে সুস্থ ফল সংগ্রহ করে খোসা ছাড়িয়ে বাদাম সংগ্রহ করে তারপর ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে ভেজে প্যাকেটজাত করা হয়। ১ কেজি ফল প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে গড়ে ২৫০ গ্রাম কাজুবাদাম পাওয়া যায়। অধিক বৃষ্টিপাত ও মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ফলনের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। এই গাছ ছায়া সহ্য করতে পারে না, এজন্য পর্যাপ্ত সূর্যালোক প্রয়োজন হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে