রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

বিশ্বে রপ্তানি হচ্ছে পান চাষেও লাভ বেশি

ইমরান ছিদ্দিকি
  ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০
বিশ্বে রপ্তানি হচ্ছে পান চাষেও লাভ বেশি

অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি পান চাষ শুরু করেছেন কৃষকরা, অর্থকরী ফসল হিসেবে পান চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে। খরচের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় আবাদ বাড়ছে। অনন্য স্বাদের পানের চাহিদা দেশের সীমানা পেরিয়ে রপ্তানিও হয় দেশের বাইরে। বৈশ্বিকভাবে এই পানের প্রধান ক্রেতা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। তাছাড়া, ইউরোপের কয়েকটি দেশেও রপ্তানি হয় এই পান। মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান ক্রেতা কুয়েত, সৌদি আরব, মালেশিয়া, দুবাইসহ আরও নানা দেশে পানের রয়েছে বিশাল চাহিদা।

আর্য এবং আরবের মানুষ পানকে তাম্বুল নামে অভিহিত করত। পানে কিছুটা মাদকতার আনন্দও বিদ্যমান। প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের মানুষ পান খায়। প্রাচীন অভিজাত জনগোষ্ঠীর মাঝে পান তৈরি এবং তা সুন্দরভাবে পানদানিতে সাজানো লোকজ শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেত। পান উৎপাদনের ক্ষেত্রে দিনাজপুর, রংপুর, মেদিনীপুর (পশ্চিমবঙ্গে), চট্টগ্রাম ইত্যাদি জেলা ছিল বিখ্যাত। বাংলাদেশ ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে ইউরোপে পান পাঠানো শুরু হয়। সৌদি আরবে পান পাঠানো হয় ১৯৯১ সাল থেকে। মূলত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের লোকজনই বিদেশে বাংলাদেশের পান কিনে খায়। ঢাকাই খিলিপান বাংলাদেশ ও উপমহাদেশে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য।

অধরসিক্ত হয় তাম্বুল রসে। লালে লাল হয়ে যায় ঠোঁট। পানাভ্যাসের ইতিহাস অতি প্রাচীন বলেই বাংলার গ্রামাঞ্চলে আজও তার অবস্থান অদ্বিতীয়। অতিথি আপ্যায়নে তার ব্যবহারও প্রাচীন কালেরই। মধ্যযুগের কাব্যেও তার উলেস্নখ আছে। আধুনিককালে কাব্যে না হোক গানে তার বিচরণ বেশ সুমধুর। 'যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম, মইশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম'- শেফালী ঘোষের গাওয়া এ গানের মতোই জনপ্রিয় মহেশখালীর পান। কিংবা 'পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম'- গানের এই কলিগুলো এখনও শহর-নগর-গঞ্জ গ্রামে ধ্বনিত হয়। পানের অপর নাম তাম্বুল। একটি পাতা মাত্র। কিন্তু তার চাহিদা ও গুণপনা অত্যধিক।

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেও দেখা মেলে পানের জনপ্রিয়তার চিত্র। এই উপমহাদেশে ভ্রমণ করতে আসা অনেক পর্যটকের লেখায়ও উঠে এসেছে পানের কথা। আগেকার দিনে রাজা বাদশাদের খাবারের তালিকায় পান ছিল অন্যতম রাজকীয় খাবার। ভারতবর্ষের রাজা-বাদশাদের অন্দরমহলে পান খাওয়ার প্রচলন ছিল বলেও জানা যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান অন্দরমহলের নারীদের কাছে পান খাওয়া জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। শুধু রাজা-বাদশাহের দরবারে নয়, পানের গুণগান গাওয়া হয়েছে মধ্যযুগের অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখায়। আগেকার দিনে পান রাজা-বাদশাদের রাজকীয় খাবার থাকলেও, পান খাওয়ার প্রচলন এখন রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেই।

খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে পান এই উপমহাদেশে প্রায় সবার কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। তাদের কাছে পানের আবেদন যেন চিরদিনের। বিয়ে-বাড়িতে, বাসায় মেহমানদারিতে, আড্ডায়, ধর্মীয় উৎসবে পান একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আলাদাভাবে। পান ছাড়া আচার-অনুষ্ঠান যেন অসম্পূর্ণ। আবার, সনাতন ধর্মের লোককথা অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ পান খেতে পছন্দ করতেন বলে পানপাতাকে শুভ বা কল্যাণকর এবং পবিত্র বলে মানা হয়। তাই তো পুজো-পার্বণেও দেখে মেলে পানের বিশাল সমাহার।

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসেও দেখা মেলে পানের জনপ্রিয়তার চিত্র। এই উপমহাদেশে ভ্রমণ করতে আসা অনেক পর্যটকের লেখায়ও উঠে এসেছে পানের কথা। আগেকার দিনে রাজা-বাদশাদের খাবারের তালিকায় পান ছিল অন্যতম রাজকীয় খাবার। ভারতবর্ষের রাজা-বাদশাদের অন্দরমহলে পান খাওয়ার প্রচলন ছিল বলেও জানা যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান অন্দরমহলের নারীদের কাছে পান খাওয়া জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। শুধু রাজা-বাদশাহের দরবারে নয়, পানের গুণগান গাওয়া হয়েছে মধ্যযুগের অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখায়। আগেকার দিনে পান রাজা-বাদশাদের রাজকীয় খাবার থাকলেও, পান খাওয়ার প্রচলন এখন রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেই। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে যে চাহিদা রয়েছে, তার জোগান দিতে পর্যাপ্ত পান পাওয়া যায় না।

রাজধানী ঢাকায় প্রায় সব এলাকার পান এলেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে মহেশখালীর পান অবস্থান করছে বলেই অনেক বিক্রেতার দাবি। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি পান আসে রাজশাহী থেকে। রাজশাহীর এই পানের অন্যতম গুণ হলো তা মহেশখালীর পানের তুলনায় মোটা এবং অনেক দিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। ফলে বাজারে সারা বছরই পাওয়া যায় এই পান। ঢাকার শ্যামবাজারের পাইকারি পান বিক্রেতা কামাল বলেন, মহেশখালীর পান অন্যান্য এলাকার পানের তুলনায় ক্রেতারা পছন্দ করে বেশি। কিন্তু এই পান আমরা সারা বছর পাই না। রাজশাহীর পান সারাবছর ঢাকায় পাওয়া গেলেও, মহেশখালীর এই পান ঢাকায় পাওয়া যায় কেবল দুইমাস। এই পানের যে চাহিদা আছে সে অনুযায়ী পানের জোগান নেই বললেই চলে।

শুধু খাবারের অনুষঙ্গ নয়, পানের রয়েছে বিভিন্ন ভেষজ গুণও। গবেষকদের মতে, হজম শক্তি বাড়াতে পানের কোনো বিকল্প নেই। তেমন আবার রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও খুব কার্যকরী। এমনকি পান পাতায় আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট- যা ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় ও দেহে ক্যানসার সৃষ্টি প্রতিরোধ করে। হজমে সাহায্য করার পাশাপাশি মুখের দুর্গন্ধ দূর করা, সর্দি উপশম করা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা, মাথাব্যথা কমানো, গলা ও দাঁতের ব্যথা দূর করা ইত্যাদি সব কাজ করে থাকে পান। অনেকেই মনে করেন গুরুপাক বা ভারী খাবার খাওয়ার পর হজমের সমস্যা হয় বলেই হয়তো যে কোনো উৎসব ও অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশনের শেষে পান পরিবেশন করা হয়- যা খেলে ওসব খাবার দ্রম্নত হজম হয়ে যায়।

পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালীর এই পান দেশ-বিদেশে পরিচিত 'মহেশখালীর মিষ্টি পান' নামে। তাই তো মহেশখালীর কথা আসতেই পানের দৃশ্যই যেন ভেসে ওঠে সবার সামনে। নিয়মিত পান না খেলেও শখের বশে পান খাননি, এমন মানুষের দেখা মেলা ভার! সেই পান যদি হয় মহেশখালীর মিষ্টি পান তবে তা যুক্ত করে অন্যরকম মাত্রা। মহেশখালীর সঙ্গে পানের সম্পর্ক চিরদিনের। এই দুটি শব্দ যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালীতে মিষ্টি পানের জন্য প্রায় সবার কাছেই জ্ঞাত একটি নাম। এই দ্বীপের আবহাওয়া, মাটি এবং পানি ইত্যাদি পান চাষের উপযোগী বলেই প্রতি বছর বিদেশে রপ্তানি হওয়া পানের একটি বড় অংশ মহেশখালী থেকেই উৎপাদিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির পান চাষ হলেও মহেশখালীর এই পান মানুষের কাছে বেশি জনপ্রিয় এর মিষ্টি স্বাদের কারণে। অনেকের মতে উপকূলীয় এলাকার মাটির গুণগত পার্থক্যের কারণেই এই পান মিষ্টি হয়ে থাকে। অনেকে বলেন, এখানের যে লবণাক্ত আবহাওয়া সেটাই এই পানকে মিষ্টি করে। এই পান ঝাঁঝালো না হওয়ার আরও একটি কারণ হলো এই পান অনেক পাতলা। খেলেই গালে সহজে মিশে যায়। তাছাড়া এখানের মাটিই এমন যে পানগুলো মিষ্টি হয় খেতে।

এই পানের মিষ্টি স্বাদ ছাড়াও আকারের পরিবর্তনের সঙ্গে ঘটে দামেরও পরিবর্তন। পান যত বড় দামও তত বেশি। ২৫ বছর ধরে পান চাষে যুক্ত আব্দুল করিম বলেন, পান বরজ থেকে তুলে আনার পর সেগুলোকে আমরা ৩ ভাগে ভাগ করে ফেলি। বড়, মাঝারি ছোট- এইভাবে ভাগ করে দাম নির্ধারণ করে থাকি। বড় পানের দাম 'বিরা' পতি ৫০০-এর উপরে হয়ে থাকে। পান বিক্রি করা হয়ে থাকে বিরা হিসেবে। এক বিরায় পান থাকে ৮০টি। তবে চাষিরা এখানে পান বিক্রি করেন গন্ডা হিসাবে। তারা ৫০ গন্ডা পান যে দামে বিক্রি করেন ঢাকায় বা অন্যান্য জায়গায় সেই একই দামে বিক্রি করে ২০ গন্ডা পান। অর্থাৎ যারা তাদের কাছ থেকে কিনে নেন পান তারা বাজারে সেসব পান বিক্রি করেন দ্বিগুণ লাভে। ৫০ গন্ডা বড় পান বিক্রি হয় ৪৫০-৫০০ টাকা, মাঝারি পানের দাম হয়ে থাকে ৩০০-৪০০ টাকা এবং ছোট পানের দাম হয়ে থাকে ১০০-১৫০ পর্যন্ত। ৪৪০ থেকে ৫০০ টাকা দামে বিক্রি হয়। সাধারণত এক গন্ডায় থাকে ৪টি পান। ৫০ গন্ডা পানকে এক বিরা হিসাব করে চাষিরা পান বিক্রি করেন। পান চাষ করেন যারা তারাই এই পান বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। ফলে, কিছুটা হলেও ন্যায্যমূল্য পেয়ে থাকেন তারা। সপ্তাহে দুইবার পানের বাজার বসলে চাষিরা খুচরা এবং পাইকারি দুইভাবেই বিক্রি করেন পান। শীতকালে পানের উৎপাদন কম হয় বলে দাম বেশি থাকে আর গ্রীষ্মকালে পান বেশি হয় বলে দাম কম থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে