রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

বৈচিত্র্যে ভরপুর কৃষি

ডক্টর এস এম শহীদুলস্নাহ
  ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০
বৈচিত্র্যে ভরপুর কৃষি

ভূখন্ড ছোট হলেও বৈচিত্র্যে ভরপুর কৃষির এই বাংলাদেশ। আর কৃষির সিংহভাগ দখল করে আছে ধান। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য হিসেবে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এর প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। প্রকৃতপক্ষে, ধান আমাদের জীবনের নিত্য অনুষঙ্গ এবং বলা যায়, গ্রামে এখনো 'ধানই ধন' বলে মনে করা হয়। এ দেশে বছরব্যাপী বিভিন্ন পরিবেশ ও বিভিন্ন মৌসুমে নানা প্রকারের ধান চাষ হয়ে থাকে। মোটাদাগে বলতে গেলে ৫৬ লাখ হেক্টর জমিতে রোপা আমন, ৪৭ লাখ হেক্টরে বোরো, ৯ লাখ হেক্টরে আউশ এবং ৪ লাখ হেক্টরে জলি আমন ধানের আবাদ হয়। জলি আমন ধানের পুরো এলাকাই বপন পদ্ধতির আওতায় রয়েছে। তাছাড়া আউশ মৌসুমের ধান চাষেও প্রায় এক-চতুর্থাংশ জমিতে বপন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই দুইটি অংক বাদ দিলে বাকি প্রায় ১১০ লাখ হেক্টর জমিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে একমাত্র রোপণ পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়। সফলভাবে ধান উৎপাদনের জন্য প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ লাখ গুছি প্রয়োজন হয়।

বীজ কৃষির প্রথম এবং প্রধান ভিত্তি। ফসল উৎপাদনের অন্য সব কৃষি উপকরণের কমতি, ঘাটতি বা অনুপস্থিতিতেও ভিন্নমাত্রায় ফলন আসে। কিন্ত বীজ ব্যতিত কোনো ফলনই আশা করা যায় না। কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদনে বীজের স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ অন্যতম প্রধান শর্ত। আমাদের দেশের কৃষকরা প্রচলিত ধারায় ফসল উৎপাদন করে এবং এর সঙ্গে উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা সুনিশ্চিত করে বীজ উৎপাদন কৌশল সম্পর্কে আপামর কৃষক এখনো পূর্ণ সচেতন নন।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিএডিসির ডিলার, বিশুদ্ধ কোম্পানি, ডিলার, নিকটাত্মীয়, বিশ্বস্ত বীজ উৎপাদনকারী থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ তলায় সঠিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে চারা উৎপাদন করলে একটি চারাই একটি গুছির জন্য যথেষ্ট হয়। সুতরাং, এক হেক্টর জমি রোপণের জন্য ৩ লাখ চারা ব্যবহার করলেই চলে। সে হিসাবে ৩ লাখ বীজধান বীজ তলায় বপন করতে হবে। বর্তমানে যেসব জাতের ধান চাষ করা হয় সেগুলিতে একটি বীজের ওজন সর্বোচ্চ ২৫ মিলি গ্রাম হয়ে থাকে। তাই উলিস্নখিত প্রয়োজনীয় বীজের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭.৫ কেজি। মাঠ পর্যায়ে ংধভবঃু ধষষড়ধিহপব হিসেবে সাধারণত ২০ শতাংশ অতিরিক্ত বীজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এক হেক্টর জমিতে ধান রোপণ করতে সর্বোচ্চ ৭.৫দ্ধ১.২০=৯ (নয়) কেজি বীজ প্রয়োজন।

এখন জাতীয় পর্যায়ে সারা বাংলাদেশের চিত্র অবলোকন করা যেতে পারে। প্রতি হেক্টর জমিতে ধান রোপণের জন্য বীজ তলায় যে পরিমাণ বীজবপন করা হয় তার পরিমাণ গড়পড়তা নূ্যনতম ৫০ কেজি। প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা অত্যন্ত ক্ষীণ ও দুর্বল হয়। তাই প্রতি গুছিতে ৪ থেকে ৭টা চারা রোপন করা হয়। এতে করে প্রতি হেক্টরে ৪১ কেজি বীজ অতিরিক্ত ব্যবহার করে শুধুই অপচয় করা হচ্ছে। সারাদেশে ১১০ লাখ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ করতে ৪.৫১ লাখ টন বীজ ধান অযথাই মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশে চাল আমদানির পরিসংখ্যানে সর্বশেষ বার্ষিক আমদানির পরিমাণ ৩ লাখ টন। পক্ষান্তরে অপচয়কৃত বীজ ধান থেকে ঠিক ৩ লাখ টন চাল পাওয়া সম্ভব ছিল। অর্থাৎ অপচয় এবং আমদানির পরিমাণ একেবারেই সমান সমান। এ অপচয় রোধ করতে পারলে দেশে আপাতত চাল আমদানি করা দরকার হবে না।

এখন প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে: এ অপচয় কেন করা হচ্ছে। উত্তর খুবই সহজ। ধানের বীজ অত্যন্ত সহজ লভ্য ও সস্তা বিধায় কৃষক ভাইয়েরা এটাকে কিছুই মনে করেন না এবং এটা যে অপচয় তা মেনে নিতেও নারাজ। এটি হচ্ছে সাধারণ চিত্র।

এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে: এ অপচয় রোধ করা কি সম্ভব? এ পশ্নের উত্তর হচ্ছে হঁ্যা। তবে প্রথম প্রশ্নের মতো এত সহজ নয়। একজন কৃষকের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ চিন্তা করার দরকার নেই এবং তার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। এ ভাবনাটি জাতীয় পর্যায়ের। গবেষক, সম্প্রসারণ কর্মী এবং নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী থেকে সম্মিলিতভাবে এ প্রয়াস চালাতে হবে। এ প্রস্তাবনা শুধুই একটি কল্পনা বিলাসী গাণিতিক মডেল নয়। এটি যে বাস্তব এবং কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন তা সহজেই চোখে আংগুল দিয়ে দেখানো যেতে পারে। কিছু কিছু হাইব্রিড ধানের বিভিন্ন জাতের চাষ হচ্ছে দেশের সর্বত্রই। উৎপাদনকারী কোম্পানি তাদের বীজ বিপণন করার স্বার্থে এ স্স্নোগান স্বার্থকভাবে প্রয়োগ করেছে- একটি মাত্র বীজ থেকে একটি সুস্থ সবল চারা, আর একটি মাত্র চারা থেকে একটি গুছি। হাইব্রিড ধানের বীজ যেহেতু অনেক চড়া দামে বিক্রির টার্গেট নেয়া হয়েছে তাই চাষিদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য আগেভাগেই তারা এ প্রযুক্তির সফলতা প্রমাণ করেছে। আর সুকৌশলে কৃষককে একটি অশুভ বার্তাও পৌঁছে দিয়েছে যে, এ প্রযুক্তি শুধুই হাইব্রিড ধানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর দুঃখজনকভাবে এ বার্তাটিকে কৃষকসহ সর্বস্তরের সংশ্লিষ্ট মহল খুব ভালোভাবেই গিলেছে। কোম্পানির পক্ষে স্স্নোগান দেয়া বুদ্ধিজীবীর কোন অভাব হয় না। দেশ ও জাতির পক্ষে এ বিষয়টি দেখার জন্য কি কেউ দাঁড়াবে?

লেখক: সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, রাইস ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ, ব্রি, গাজীপুর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে