রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ভাতের পর দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু

বিশ্বের ১১ দেশে রপ্তানি হচ্ছে আলু
আলতাব হোসেন
  ২৬ মে ২০২৪, ০০:০০
ভাতের পর দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু

বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্যগুলোর মধ্যে আলু প্রথম স্থানে। এটি বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়। ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশে আলু প্রধান খাদ্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। পৃথিবীর আলু ফসলের প্রায় ৯০ শতাংশ জন্মে ইউরোপে। আলু সম্ভবত আমেরিকার স্থানীয় ফসল। গোলআলুর আদিজাত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। পরবর্তী সময়ে তা পর্তুগীজ ব্যবসায়ী ও নাবিকদের হাত ধরে ইউরোপে আলুর চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০০ বছর আগে পর্তুগীজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলায় প্রথম আলুর আবাদ শুরু হয়।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চাষ করা আলুগুলোর ৯৯ শতাংশ এরও বেশি জাত দক্ষিণ-মধ্য চিলির নিম্নভূমিতে উদ্ভূত হওয়া জাত থেকে এসেছে। এটি ইউরোপে, বিশেষ করে উত্তর এবং পূর্ব ইউরোপে একটি অপরিহার্য ফসল হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও নেদারল্যান্ডসের মানুষ প্রত্যেকটা খাবারে আলু ব্যবহার করে। বিশ্বে কয়েকশত জাতের আলু চাষ হয়। এগুলোর পার্থক্য বাহ্যিকরূপ, কন্দের গঠন, আকার ও বর্ণ, পরিপক্কতার সময়, রান্না ও বাজারজাতকরণ গুণাবলি, ফলন, রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

সতেরো শতকের গোড়ার দিকে পর্তুগীজ নাবিকরা ভারতে প্রথম আলু নিয়ে আসে। পুষ্টিগুণের বিচারে আলু ভাতের চেয়েও অধিক পুষ্টিকর। পৃথিবীতে মানুষের প্রধান খাদ্য হিসেবে ভাতের পরই আলুর অবস্থান। বিশ্বের অনেক দেশেই প্রধান খাদ্য হিসেবে আলু খাওয়ার প্রচলন আছে। তবে আমাদের দেশে আলু এখনো সহায়ক খাবার। আলু নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজ লবণের চাহিদা মেটায়। অন্যদিকে, খাদ্যে আঁশ থাকায় আলু হজমে সহায়ক এবং রক্তে শকর্রার হার ঠিক রাখে। ভিটামিন-সি থাকায় আলু শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

বহু বছর ধরেই আলুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষিপণ্যটির মাথাপিছু ভোগ। ব্যবহার বেড়েছে খাদ্য ও ফিড শিল্পেও। গবেষণা বলছে, দেশে আলু উৎপাদনে ঘটেছে নীরব বিপস্নব। উৎপাদন বেড়েছে ১৭-১৮ গুণ। মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে ৬-৭ গুণ। সেই সঙ্গে আলুর বহুমুখী বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ছে। আলু এখন বাণিজ্যের নানা খাতে আশার আলো দেখাচ্ছে। দেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ২২ কেজি আলু খায়। সেক্ষেত্রে আলু থেকে তৈরি নানা পণ্য উৎপাদন আর বাজারের আকার বড় করা গেলে এই পণ্যটি প্রধান অর্থকরী ফসলের তালিকার শীর্ষে উঠে আসবে।

প্রতি বছর দেশে প্রায় ৫ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়। উৎপাদিত এ খাদ্যপণ্যটি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, কাতারসহ বিশ্বের ১১ দেশে রপ্তানি হচ্ছে। যা থেকে গত ২০২২-২৩ সালে রপ্তানি আয় আসে ৩৩০ কোটি টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে গড় আলুর চাহিদা ৮০ থেকে ৯০ লাখ টন।

তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আলু রপ্তানি হয়েছে ২৯ হাজার ১৫৩ টন ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৩৪৪ দশমিক ৪৭৬ টন আলু। বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি হয়ে থাকে কয়েকটি দেশে। এর মধ্যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, আরব আমিরাত, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, ভিয়েতনাম ও ব্রম্ননাই অন্যতম। এসব দেশে আলু রপ্তানি করে আয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।

আলু ছাড়া রান্না ভাবা যায় না। এমনকি অনেক খাবার আলু ছাড়া তৈরি হয় না। হাতে সময় না থাকলে, শুধু আলু সিদ্ধ করে বা পুড়িয়ে খাওয়া যায়। রাস্তা ঘাটে একটু নজর দিলেই দেখা মিলবে আলু দিয়ে তৈরি হাজার, হাজার জিনিস। ধান ও গমের পর আলু সমগ্র পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ফসল। ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু। কৃষি বিজ্ঞানীদের অদম্য প্রচেষ্টা ও চাষিদের পরিশ্রম আর কৃষি বিভাগের অনুকূল সহায়তায় বাংলাদেশে নীরবে ঘটে গেছে আলুর বিপস্নব। গত ৫০ বছরে আলুর উৎপাদন বেড়েছে ৩০ গুণ। আর মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য ও খাদ্যশক্তির উৎস হচ্ছে আলু। আলু উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য থেকে এটি এখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশে উৎপাদিত আলু দেশের চাহিদা পূরণ করে বর্তমানে ইউরোপের ১১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আলু হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে বাংলাদেশের খাদ্যশক্তির দ্বিতীয় প্রধান উৎস আলু। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি করে আলু খায়- যা ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। আলু খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলেও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ভর্তা-ভাজি আর তরকারির গন্ডি ছাড়িয়ে আলু এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পটেটো চিপস বা পটেটো ফ্লেক্স হিসেবে প্যাকেটজাত হয়ে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। গত এক যুগে দেশে ৫০টিরও বেশি আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছ। এর মধ্যে অন্তত আটটি কোম্পানি আলু থেকে উৎপাদিত চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিদেশে রপ্তানি করছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ আলুর উৎপাদন বিষয়ক পরিসংখ্যান বলছে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের ওপরে আছে চীন, ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে বছরে দেড় কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদন হচ্ছে। গত এক যুগে দেশের বিজ্ঞানীরা প্রায় ৭০টি আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। মূলত ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে আলু উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। ইউরোপে যেখানে আলুর সঠিক ফলন পেতে পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগে, সেখানে বাংলাদেশে আলু পেতে তিন মাস লাগে। এখানকার মাটি, পানি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যাওয়ায় আলুর উৎপাদন সময়কাল কমেছে।

আশির দশকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা নেদারল্যান্ডসের জাতগুলোকে উন্নত করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করার প্রচেষ্টা শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আলুর জাত নিয়ে কৃষকরা আবাদ শুরু করেন। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা ছাড়া দেশের সব স্থানেই আলুর চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলু ফলে মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর অঞ্চলে।

সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আলু ভর্তার গন্ডি থেকে বেরিয়ে এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিপস হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে আলু। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি করে আলু খায়। যা ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। আলু খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও। এতে বাংলাদেশের মানুষের ভিটামিন ও কার্বোহাইড্রেটের চাহিদার অনেকাংশ পূরণ করছে। বর্তমানে দেশে আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য যেমন চিপস, ফ্লেক্স, অন্যান্য খাদ্য ও পণ্য উৎপাদন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্যাটালিস্টের হিসাবে দেশে অন্তত ৩০টি আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেক কোম্পানি আলু থেকে উৎপাদিত চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রপ্তানি করছে।

ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু। অন্য যে কোনো শস্যের চেয়ে আলুর ফলনও বেশি হয়। আলুতে ভিটামিন 'এ', 'বি' ও 'সি' আছে। এ ছাড়া আলুর খোসায় আছে ভিটামিন 'এ', পটাশিয়াম, আয়রন, অ্যান্টি-অক্সাইড, ফাইবারসহ আমরা প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট পাই। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা কেন্দ্রের (ইফ্রি) এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আলু উৎপাদনে নীরব বিপস্নব ঘটেছে। উৎপাদন বেড়েছে ২৬ গুণ। মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ২৩ কেজি আলু খায়- যা ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। সিঙ্গাপুরে বছরে দুই লাখ টন এবং শ্রীলংকা বছরে ১ দশমিক ৫ লাখ টন আলু আমদানি করে। তাই রপ্তানিতে অপ্রচলিত পণ্যের তালিকায় আলুকেও সংযোজন করার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া এসব দেশের আলুরবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের আলুবাজার প্রায় সম্পূর্ণ ভারতের নিয়ন্ত্রণে। চলতি মৌসুমে দেশে ৪ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে ৯০ লাখ টন গোলআলু উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, গোলআলু উৎপাদনে এখনো বড় বাধা উন্নত বীজ ও এর আবাদ প্রযুক্তি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-বারির বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন মাঠপর্যায়ে কৃষকের কাছে উন্নত জাতের বীজ ও এর আবাদ প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করা গেলে দেশে আলুর উৎপাদন আগামী পাঁচ বছরে ২ কোটি টন অতিক্রম সম্ভব। তাদের মতে, উন্নত বীজ এবং পরিমিত জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহারসহ সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশে হেক্টরপ্রতি ৩০-৪০ টন পর্যন্ত গোলআলু উৎপাদন সম্ভব বলে।

আলু উৎপাদনের এ সাফল্যের মূল কারিগর কৃষকই। মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, নাটোর, নওগাঁ, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নীলফামারী, রংপুরের বদরগঞ্জ, পঞ্চগড়, যশোর, বগুড়া, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ ও লালমনিরহাট জেলায় প্রায় প্রতি বছর আলুর বাম্পার ফলন হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪০টি জাতের উন্নত আলুর চাষাবাদ হচ্ছে কৃষকপর্যায়ে। উচ্চফলনশীল জাতের আলুবীজ সম্প্রসারিত হয়েছে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি আবাদি এলাকায়। এক দশক আগেও উৎপাদন ছিল ৫০ হাজার টনের নিচে। এখন তা এগোচ্ছে দুই কোটি টনের দিকে। সরকারও আলুর উৎপাদন বাড়াতে নানাভাবে উৎসাহিত করেছে- কৃষককে দেয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে