রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোক্তারা

পাকা নয়, বিক্রি হচ্ছে কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম

ইমরান ছিদ্দিকি
  ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০
পাকা নয়, বিক্রি হচ্ছে কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম

রাজধানীর ফুটপাত থেকে শুরু করে কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর-১০ নম্বর ফলপট্টি, শেওড়াপাড়া ফলবাজার, পুরানা পল্টন, হাতিরপুল, যাত্রাবাড়ীসহ সব বাজারেই আম বিক্রি হচ্ছে। বাজারে যে আম পাওয়া যাচ্ছে, তা স্বাভাবিকভাবে পাকা নয়। অপরিপক্ব কাঁচা আম কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে বিক্রি হচ্ছে। এসব আমের পচন ঠেকাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফরমালিন। ক্রেতার কাছে আকর্ষণীয় করতে মেশানো হচ্ছে কৃত্রিম রং। পাকা আমের মতো দেখতে হলেও এতে নেই পাকা আমের স্বাদ।

ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের আমের সঙ্গে দেশীয় অপরিপক্ব কাঁচা আম কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে বিক্রি হচ্ছে। কৃত্রিমভাবে পাকানো এ আম মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। চড়া দামে এসব আম কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। রাজধানীর বিভিন্ন ফলের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাতক্ষীরার আম প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। আর বারোমাসি আম ২০০ থেকে ২৩০ টাকা। ভারতের গোপাল ভোগ আম বিক্রি হচ্ছে- ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। এছাড়া কাঁচা টক-মিষ্টি আম বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে।

চিকিৎসকরা বলছেন, আম পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড ইনজেকশন দেওয়া হয়। আর্দ্রতার সংস্পর্শে এলে এটি অ্যাসিটিলিন নামক গ্যাস ছড়ায়। এতে আম দ্রম্নত পাকে। এটি আমাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। ত্বকের জ্বালা, শ্বাসকষ্ট এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যাগুলো দেখা দেয়। আবার ফল ব্যবসায়ীরাও আম পাকাতে 'ইথিলিন ট্রিটমেন্ট' ব্যবহার করেন। এ সময় ফলকে ইথিলিন গ্যাসের সংস্পর্শে আনা হয়। এই গ্যাস একটি প্রাকৃতিক উদ্ভিদ হরমোন। যা ফল দ্রম্নত পাকতে সাহায্য করে। আমের মাধ্যমে এসব রাসায়নিক উপাদান শরীরে গেলে ত্বকের ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার, লিভার ও কিডনির সমস্যা, মস্তিষ্কের ক্ষতির মতো মারাত্মক রোগ হওয়র ঝুঁকি বাড়ে।

কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো আম উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় হয়। এসব আম সব দিকে সমানভাবে পাকবে। গাছ পাকা আমের সব দিক কখনই সমানভাবে পাকে না। এসব আম গাছপাকা আমের মতো মিষ্টি গন্ধ থাকবে না। প্রাকৃতিকভাবে পাকা ফলের চামড়ার ওপর এক ফোঁটা লবণ দিলে তা গাঢ় নীল অথবা কালো বর্ণের হয়ে যায়। আর কেমিক্যালে পাকানো ফলে লবণ দিলে রঙ অপরিবর্তিত থাকে।

ব্যাংকার আমজাদ হোসেন বলেন, আমের স্বাদ ও লোভনীয় ঘ্রাণ মুগ্ধ করে সবাইকে। বাজারে ফলের দোকানে, রাস্তার ধারে হকারের ডালায় সাজানো থাকে আম। কিন্তু এই আম খেতে গেলেই মানুষের মনে একটা আতঙ্ক কাজ করে- রাসায়নিকে পাকানো নয় তো! বাস্তবতা হচ্ছে, অধিক মুনাফার আশায় গাছ থেকে অপরিপক্ব আম পেড়ে কার্বাইড বা ওই জাতীয় রাসায়নিক প্রয়োগ করেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এতে আম পেকে সুন্দর রং ধারণ করে। বিক্রির উদ্দেশ্যে এই আম অন্তত ৮ থেকে ১০ দিন সংরক্ষণ করা যায়। মৌসুমের প্রথমেই আম ব্যবসায়ীরা কৌশলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অতি উৎসাহী ক্রেতাদের হাতে পাকা আমের নামে অপুষ্ট আম তুলে দেন। এই আম খেতে মোটেও সুস্বাদু নয়। অপরিপক্বতার কারণে আম রসালো হয় না, সুগন্ধের ক্ষেত্রেও পূর্ণতা পায় না।

মিরপুর বাংলা স্কুলের শিক্ষক আশরাফ হোসেন বলেন, খালি চোখে সব আম দেখতে সুন্দর হলেও এতে অনেক সময় রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়। এমন অভিযোগ উঠছে বহুদিন ধরেই। আর রাসায়নিক বিষ মেশানো ফল খেয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। আম এমন একটি ফল যা সবাই খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ী রাসায়নিক পদ্ধতিতে আম পাকিয়ে বিক্রি করেন। কিন্তু এই রাসায়নিক দিয়ে পাকানো আমে তেমন স্বাদ থাকে না। সেই সঙ্গে রাসায়নিকের পাকা আম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

তিনি আরও বলেন, কমিক্যালযুক্ত আম সেটা বাইরে থেকে বোঝা কঠিন। তবে ক্রেতারা যদি কোন মৌসুমে কোন আম পাওয়া যায় সে বিষয়ে সঠিক ধারণা রাখেন এবং রাসায়নিক দেওয়া আম কেনা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে অনেকাংশেই অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতারণা থেকে বাঁচা সম্ভব। এ ছাড়া বাজার ও আড়তে অভিযান চালিয়ে কেমিক্যালযুক্ত আম ধ্বংসসহ অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে প্রশাসনকে।

গ্রীষ্মকাল অর্থাৎ গরম হলো আমের মৌসুম। আর কয়েকদিন পরই পুরোদমে বাজারে পাকা আমের গন্ধে মৌ মৌ করবে। কিন্তু, পাকা আমের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রয়কারীরা কৃত্রিমভাবে ফরমালিন দিয়ে আম পাকানো শুরু করে। ইনজেকশন দিয়ে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক আমে ঢুকিয়ে দ্রম্নত পাকানো হয়। রাসায়নিক দিয়ে পাকা আম আকারে ছোট হবে। আম কেনার সময় পানিতে ডুবিয়ে দেখুন। যে আমগুলো পানিতে ডুবে যায় সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই পাকা আম। কিন্তু যেগুলো না ডুবে ভাসমান অবস্থায় থাকে, সেগুলো রাসায়নিকভাবে পাকানো হয়েছে।

আম কেনার পর কিছুক্ষণ রেখে দিন। গাছ পাকা আম হলে গন্ধে মৌ মৌ করবে চারপাশ। ওষুধ দেওয়া আমে এই মিষ্টি গন্ধ হবে না। পাকা আম সাধারণ হলুদাভ হয়। লক্ষ্য করুন আমের গায়ে মাছি বসছে কিনা। কেননা ফরমালিনযুক্ত আমে মাছি বসবে না। কার্বাইড বা অন্য কিছু দিয়ে পাকানো আমের শরীর হয় মোলায়েম, দাগহীন ও আগাগোড়া হলদেটে। কারণ, আমগুলো কাঁচা অবস্থাতেই পেড়ে ফেলে ওষুধ দিয়ে পাকানো হয়। অন্যদিকে, গাছ পাকা আমে দাগ পড়বেই।

আম নাকের কাছে নিয়ে ভালো করে শুঁকে তারপর কিনবেন। গাছ পাকা আম হলে অবশ্যই বোটার কাছাকাছি ঘ্রাণ থাকবে। ওষুধ দেওয়া আমে মিষ্টি গন্ধ তো থাকবেই না, উল্টো বিচ্ছিরি গন্ধ বের হবে। আম খাওয়ার সময় যদি টক, মিষ্টি কোনো স্বাদ না পেয়ে পানসে স্বাদ পান, তাহলে বুঝবেন আমে ওষুধ দেওয়া। আমের খোসা কুঁচকে গেছে এমন আম কিনবেন না। হিমসাগর ছাড়াও নানা জাতের আম আছে, পাকলেও সবুজ থাকে এবং মিষ্টি হয়। ওষুধ দিয়ে পাকানো হলে আমের শরীর হয় মসৃণ ও সুন্দর। প্রাকৃতিকভাবে পাকা আম কাটলে এর ভেতরের শাঁসটি হবে লালচে হলুদ রঙের কিন্তু ফরমালিনযুক্ত আমের ভেতরের অংশটি হবে হালকা অথবা গাঢ় হলুদ রঙের। এর মানে হলো বাইরে থেকে আমটি পাকা দেখালেও ভেতরটি পাকা নয়।

এ বিষয়ে পুষ্টি বিশেষজ্ঞ হাইটেক হাসপাতালের চিকিৎসক আফরোজা নাসরিন বলেন, কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল গ্রহণে লিভারের সমস্যাসহ ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া আগুনের তাপ বা কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফলে পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়, এতে স্বাদ এবং ফুড ভ্যালু থাকে না। রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে পাকানো আম শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্যই বেশি ক্ষতিকর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে