বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। দেশে মাছ, গরু, উট, হরিণ, ছাগল, মহিষ, ভেড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী চাষ করা হয়। আর এরই অংশ হিসেবে প্রাণিজগতের অন্যতম নাম কুমির চাষ দেশে এখন ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দ্রম্নত ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে বাংলাদেশ ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কুমির চাষ। কয়েক বছরের মধ্যেই কয়েকগুণ মুনাফা আয় সম্ভব। তাই বাংলাদেশের রপ্তানি তালিকায় নতুন সম্ভাবনার নাম কুমির চাষ। বিশ্ববাজারে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে কুমির চাষ। কুমির খামার থেকে কুমির রপ্তানি করে বছরে প্রায় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ কুমির রপ্তানি খাত থেকে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশে আবহাওয়া কুমির চাষের জন্য যেমন উপযোগী তেমনি বিদেশেও কুমিরের প্রচুর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। একটি কুমির সর্বাধিক ৮০টি ডিম দেয় এবং বেশিরভাগ ডিম পাড়ে ঘাস ও কাদাযুক্ত মাটিতে। পুরুষ কুমিরের উৎপাদন চামড়ার কদর বেশি তাই এক্ষেত্রে তাপমাত্রা বেশি দিয়ে পুরুষ কুমিরের উৎপাদন বাড়ানো যায়। কুমির সাধারণত বর্ষাকালে প্রজননে মিলিত হয় এবং এর এক সপ্তাহের মধ্যে ডিম দেয়। একটি কুমির ২০ থেকে ৮০টি ডিম দেয়। চীন, থাইল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কুমিরের মাংসেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব দেশে প্রতি কেজি কুমিরের মাংস প্রায় ১৭৫ মার্কিন ডলার থেকে ২০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। কুমিরের কিছুই ফেলনা নয়। কুমিরের পাকা চামড়ার চাহিদা রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নত বিশ্বে। কুমিরের চামড়ার ব্যাগ আন্তর্জাতিক বাজারে কমবেশি প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি হচ্ছে। কুমিরের হাড় দিয়ে প্যারিসে তৈরি হচ্ছে দামি সুগন্ধি। দাঁত থেকে তৈরি হচ্ছে মূল্যবান গহনা। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, ব্যাংকক, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, পাপুয়া নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ নানা দেশে বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষ হচ্ছে।
বাংলাদেশে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড দেশে প্রথম কুমির চাষ শুরু করে। এরপর আকিজ গ্রম্নপ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে ৫০টি কুমির দিয়ে আরেকটি বাণিজ্যিক খামার শুরু করেছে। কুমিলস্নায় একটি কুমির খামারের প্রস্তুতি চলছে।
বিশ্ব বাজারে বিপুল চাহিদা থাকায় কুমিরকে বলা হয় সোনালি লোহা। আন্তর্জাতিক বাজারে কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খামারে এই কুমিরের চাষ করে ব্যাপক আন্তর্জাতিক মুদ্রা আয় করছে। বাংলাদেশেও রয়েছে এমন সম্ভাবনাময় একটি প্রকল্প। যার নাম রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। ময়মনসিংহের ভালুকার উথুরা ইউনিয়নে অবস্থিত এই প্রকল্পটি। প্রকল্পটি ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে কুমিরের সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে ৩ হাজার। ২০১০ সালে ৬৭টি কুমির (হিমায়িত অবস্থায়) জার্মানিতে রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ কুমির রপ্তানি শুরু হয়। রেপটাইলস ফার্ম লি. খামার থেকে বছরে প্রায় ১৫ কোটি টাকার চামড়া বিদেশে রপ্তানি সম্ভব।
আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি কুমির সংরক্ষণের পরিকল্পনা করলে সুন্দরবনে কুমিরের সংখ্যা ২০০ থেকে বৃদ্ধি করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব যখন খামারিরা বন বিভাগের কাছ থেকে ডিম সংগ্রহ করতে পারবে। এর জন্য প্রথমত সুন্দরবনে কুমিরের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ২০০৯ সালে প্রথমবার কুমিরের খামার স্থাপন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করে বন বিভাগ।
সাধারণ চামড়া দিয়ে যেসব পণ্য তৈরি হয়, কুমিরের চামড়া দিয়েও একই পণ্য তৈরি করা সম্ভব। কাঁচামাল হিসেবে কুমিরের চামড়ার মূল্য বেশি হওয়ায়, কুমিরের চামড়া দিয়ে তৈরি পণ্যের মূল্য অনেক বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত কুমিরের পেটের চামড়া সবচেয়ে মূল্যবান, একটি লোনা পানির কুমিরের উন্নতমানের কাঁচা চামড়ার মূল্য ১০০০ ডলার হতে পারে। কুমিরের মাংস ও অন্যান্য উপকরণ বিক্রির মাধ্যমে আরও ২০০ ডলার আয় করা সম্ভব। ধারণা পাওয়ার জন্য এখানে উলেস্নখ্য ইন্টারনেটে নোনা পানির কুমিরের চামড়ার তৈরি আইফোনের কভার বিক্রি হয় ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার মূল্যে।
কুমির চাষ করা হয় মূলত কুমিরের চামড়ার জন্য। তা ছাড়া কুমিরের মাংসের একটা বিরাট বাজার আছে। অস্ট্রেলিয়ার শুধুমাত্র নর্দার্ন টেরিটরিতে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে কুমির চাষ করে আয় করেছে ২৯.৩ মিলিয়ন ডলার। সেখানে মাত্র আটটি খামার থেকে এই পরিমাণ আয় হয়েছে। রেপটাইলস ফার্ম ২০১৪ সালে ৪৩০টি, ২০১৫ সালে ৪০০টি, ২০১৬ সালে ২০০টি এবং এই বছর ২০১৯ সালে ২২৬টি চামড়া রপ্তানি করেছে জাপানে। কুমিরের ২৪টি প্রজাতির মধ্যে নোনা পানির কুমিরের চামড়ার মূল্য সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব বাজারে ২০০৩ সালে যেখানে ২৬,৫৬৪টি নোনা পানির কুমিরের চামড়া বিক্রি হয়েছে, সেখানে বারো বছরের ব্যাবধানে ২০১৫ সালে ৭১,১৪২টি চামড়া বিক্রি হয়েছে। ৭১,১৪২-এর মধ্যে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ৪০০। ৭১,১৪২-এর সিংহভাগ রপ্তানি করেছে অস্ট্রেলিয়া ও পাপুয়া নিউগিনি। যথাক্রমে ৩৪,৮৭৮ ও ১২,৫৩২টি।
নোনা পানির কুমিরের পেটের চামড়া একেবারে মোলায়েম, তবে বয়স পাঁচের বেশি হলেই চামড়ার নিচে মাছের আঁশের মতো একটি পদার্থ জমাট বাঁধে, এতে করে চামড়া শক্ত হয়ে যায়। বাণিজ্যিক কাজে চামড়া আহরণের ক্ষেত্রে তা পাঁচ বছর বয়সের আগেই করা হয়। তিন বছর বয়সের একটি কুমির থেকে গড়ে এক বর্গ ফুট চামড়া আহরণ করা সম্ভব। কুমিরের উপরের দিকে ঘাড় থেকে শুরু করে লেজ পর্যন্ত লম্বা করে কাটা চামড়া দিয়ে তৈরি হয় মূল্যবান বেল্ট। পাগুলো দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন সুভেনির। ২০১৩-২০১৪ সালে পাপুয়া নিউগিনি, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ৭০,০০০ কুমিরের দাঁত রপ্তানি করেছে। কুমিরের দাঁত দিয়ে তৈরি হয় অলঙ্কার। একই সময় অস্ট্রেলিয়া থেকে কুমিরের মাংস রপ্তানি হয়েছে ৫৭ টন। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোই মূলত কুমিরের মাংসের আমদানিকারক। উন্নতমানের কুমিরের চামড়ার মূল বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা।
কুমিরের চামড়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। বাংলাদেশে কুমিরের চামড়া প্রক্রিয়া করার সব প্রযুক্তি আছে। সমন্বয় এবং নীতিমালা সংশোধনের মাধ্যমে নতুন একটি শিল্প খাত গড়ে উঠতে পারে। আমাদের বাংলাদেশের চামড়া শিল্প অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, এর সঙ্গে কুমিরের চামড়াজাত পণ্য নতুন সংযোজন হতে পারে। শুধুমাত্র কাঁচা চামড়া রপ্তানি মাথায় না রেখে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে চামড়া জাত পণ্য তৈরি করে, তৈরি পণ্য রপ্তানির দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। কুমির একটি নবায়নযোগ্য সম্পদ, প্রতি বছর গড়ে ৩০টি ডিম দেয়, প্রায় ২৫০০ ডিম পারে তার আয়ুষ্কালে। বাংলাদেশের আবহাওয়া লোনা পানির কুমির প্রজনন ও লালন-পালনের জন্য অনুকূল। বন বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে এবং আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মেনে ক্ষুদ্র আকারে কুমিরের বাণিজ্যিক খামার গড়ে তোলা সম্ভব।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় দেশে কুমিরের প্রজনন ও চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের মধ্যে বয়ে যাওয়া নদীগুলোসহ সুন্দরবন অঞ্চল ও কুয়াকাটায় গড়ে ওঠা পর্যটন শিল্পাঞ্চলকে ঘিরে আধুনিক খামার স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষের যথেষ্ট উপযুক্ততা রয়েছে। খামার স্থাপন ও প্রাকৃতিক পরিবেশে সংরক্ষণের মাধ্যমে কুমিরের উৎপাদন বাড়ানো যায়। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোর দু'পাশে তারের জালের বেড়া দিয়ে কুমির চাষ হতে পারে। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কুয়াকাটাসহ বেশ কিছু স্থানে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। এসব অঞ্চলে কুমিরের খামার স্থাপন করা সম্ভব হলে ওসব পর্যটন শিল্প আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। যা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশে কুমিরের চাষ সহজ হবে।
অন্যান্য খাতে বিভিন্ন ভাইরাল রোগের চরম আতঙ্ক থাকলেও এই সেক্টরে তা একেবারেই নেই। তাই অপার সম্ভাবনার কুমির শিল্পকে বাংলাদেশে জোরদার করে এবং চামড়া প্রক্রিয়াজাত করলে পোলট্রি ও গার্মেন্টস সেক্টরের মতো এই সেক্টর হতেও ব্যবসায়িকভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
কুমিরের সাধারণত রোগবালাই হয় না বললেই চলে। ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা ভালো থাকলে সারা বছর বিনা চিকিৎসায় কুমিরকে সুস্থ রাখা সম্ভব। ছোট কুমিরের ছত্রাক জাতীয় রোগ বেশি হয়। তবে, এই দীর্ঘ ৫ বছরে এ ফার্মে এ ধরনের কোনো রোগ দেখা যায়নি। প্রজনন মৌসুমে ও খাবার প্রতিযোগিতার সময় কুমির আহত হতে পারে। এছাড়াও খেয়াল রাখতে হবে যে, মানসিক ও শারীরিকভাবে ছাড়াও স্থানান্তর ও পরিবহণের সময় যাতে কুমিরের ওপর কোনো স্ট্রেস না পড়ে। দেশে অর্থনীতির মূল শক্তি রপ্তানি। যে দেশ যত বেশি পরিমাণে পণ্য রপ্তানি করতে পারে, সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত শক্তিশালী। এক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে কুমির চাষ।