কোরবানির গরু মোটাতাজা করতে ব্যবহার হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক

প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে ঘিরে সারাদেশে একটি চক্র কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজাকরণের বাণিজ্যে মেতে ওঠে। ঈদের এক থেকে দুই মাস আগে অল্প দামে নানা রোগে আক্রান্ত গরু-বাছুর কিনে বিষাক্ত হরমোন, ইনজেকশন ও রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করে গরুকে মোটাতাজা করে। বেশি মুনাফার লোভে অসাধু খামারিরা এসব গরু কোরবানির বাজারে তুলে। অনেক সময় এসব গরু কোরবানির হাটেই মারা যায়

প্রকাশ | ১২ মে ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন

এক শ্রেণির অতি মোনাফা লোভী গরু ব্যবসায়ী আসন্ন কোরবানিকে সামনে রেখে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে মাঠে নেমেছেন। ঈদুল ফিতরের পর পর তারা শীর্ণকায় ও নানা রোগে আক্রান্ত গরু কমদামে নিতে থাকেন। এরপর গরুকে নাদুসনুদুস ও মোটাতাজা করতে অবাধে ব্যবহার করেন বিষাক্ত রাসায়নিক। অতিদ্রম্নত মোটাতাজা হতে গরুকে ঝুঁকিপূর্ণ ডোজ প্রয়োগ করেন। কোরবানির ঈদের আগেই অল্পদিনে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তাজা করতে গরুকে পাম ট্যাবলেট, নিষিদ্ধ ডেক্সামেথাসনের মতো ভয়ানক ক্ষতিকারক ওষুধ এবং স্টেরয়েড দেয়া হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। কোরবানির ঈদের বাজার ধরতে এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে গরু মোটাতাজাকরণ। নরসিংদী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ ও ঢাকার আশপাশের এলাকা কেরানীগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, বসিলা, ডেমরা, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও রূপগঞ্জে ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ করে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। এ বছর দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে ক্ষতিকারক পাম বড়ি গরুর খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে সেবনের মাধ্যমে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে। প্রাণিস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আল আমিন বলেন, এ ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক ওষুধে গরুর দেহে অধিক মাত্রায় পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এতে গরুর শরীর ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং স্বাস্থ্যবান দেখায়। অতি কম সময়ে গরু মোটাতাজা হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এতে গরুর কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হয়। এ কারণে গরুর হূৎপিন্ড ও যকৃত মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব গরুর মাংস খেলে মানুষের লিভার, কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে ঘিরে সারাদেশে একটি চক্র কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজাকরণের বাণিজ্যে মেতে ওঠে। ঈদের এক থেকে দুই মাস আগে অল্প দামে নানা রোগে আক্রান্ত গরু-বাছুর কিনে বিষাক্ত হরমোন, ইনজেকশন ও রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করে গরুকে মোটাতাজা করে। বেশি মুনাফার লোভে অসাধু খামারিরা এসব গরু কোরবানির বাজারে তুলে। অনেক সময় এসব গরু কোরবানির হাটেই মারা যায়। বাংলাদেশে স্টেরয়েড হরমোন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার নিষিদ্ধ। তারপরও দেশের সব এলাকায় ফার্মেসি ও মুদি দোকানে এ ধরনের ওষুধ সুলভে পাওয়া যাচ্ছে। খামারিরা চা-পান-বিড়ির দোকান থেকেই এ ধরনের রাসায়সিক ওষুধ কিনে গরুর শরীরে প্রয়োগ করছে। ২০ থেকে ১০০ টাকা এসব ওষুধ পাওয়া যায়। এক খামারি বলছেন, প্রতিবেশী দেশ থেকে চোরাইপথে এসব ওষুধ দেশে আসে। এই ব্যবসার সঙ্গে প্রাণী চিকিৎসকরাও জড়িত রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডক্টর আব্দুল কালাম বলেন, অসচেতন গরু ব্যবসায়ী ও খামারিরা ১০ থেকে পনেরো শতাংশ গরুর শরীরে স্টেরয়েড হরমোন ব্যবহার করছে। খামারিরা অতিলাভের আশায় শীর্ণকায় গরু কিনে কোরবানির ঈদের আগ পর্যন্ত খাবারের সঙ্গে ক্ষতিকারক পাম বড়ি খাওয়াচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এই বিষাক্ত বড়ি মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান থেকে অবৈধভাবে আমদানি করে বিভিন্ন ওষুধের দোকানসহ গোখাদ্য বিক্রেতাদের দোকানে দেদারচে বিক্রি হচ্ছে। হাতুড়ে চিকিৎসক ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কর্মীদের প্ররোচনায় গরুর গায়ে বিষাক্ত স্টেরয়েড প্রয়োগ করছে। এ ছাড়াও হরমোন, উচ্চমাত্রার রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রানিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরুকে নিয়ম মাফিক চাহিদা মতো খাদ্য দিয়ে মোটা-তাজা করলে তার মাংস ক্ষতির কারণ হয় না। কিন্তু স্টেরয়েড বা বিষাক্ত কোনো ডোজ দিয়ে মোটা করার গরুর মাংস ক্ষতিকর। স্টেরয়েড মূলত হাঁপানির চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়। কিন্তু এ জাতীয় ওষুধ যেমন- ডেক্সামেথাসন বা ডেকাসন, বেটামেথাসন ও পেরিঅ্যাকটিন অতিরিক্ত মাত্রায় দিলে গরুর কিডনি ও যকৃতের কার্যকারিতা নষ্ট হয়। এ কারণে গরুর শরীর থেকে পানি বের হতে পারে না। তাই দূষিত হয়ে পানি সরাসরি গরুর মাংসে চলে যায়। ফলে গরুকে মোটা দেখায়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ওষুধ বিক্রেতা আলাল জানান, এসব ট্যাবলেট কিনে নিয়ে ব্যাপারীরা গরুকে খাওয়ায় দ্রম্নত মোটাতাজা করার জন্য। একটি ট্যাবলেটের দাম পড়ে ১ টাকা। প্রেসক্রিপশন ছাড়া এসব ওষুধ বিক্রির নিয়ম না থাকলেও বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে ইনজেকশন। এক একটি ইনজেকশন বিক্রি হয় ২৫ টাকায়। যেখানে সপ্তাহে একটি খাওয়ানোর কথা, সেখানে অসাধু খামারিরা দিনেই ৪ থেকে ৫টি বড়ি সেবন করাচ্ছে গরুকে। স্টেরয়েড ও হরমোন দিয়ে বড় করা গরু অসুস্থতার কারণে সব সময় নীরব থাকে। কৃত্রিমভাবে মোটা করা এসব গরুকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাই না করলে মারা যায়। মোটাতাজা গরুর মধ্যে পাবনা ব্রিড, অস্টেলিয়ান-ফ্রিজিয়ান ব্রিড, ইন্ডিয়ান হরিয়ানা ব্রিড, পাকিস্তানি সাহিয়াল ব্রিডসহ স্থানীয় ব্রিডিং প্রদ্ধতি যা লোকাল ক্রস ব্রিড নামে পরিচিত। এসব ব্র্যান্ডের সব গরুই মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় বড় করা হয়। এসব গরুগুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যায়, এগুলো প্রাকৃতিকভাবে নয়, কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক খাদ্য ও উপায়ে বড় করা গরুর যেমন তেজি ও গোয়ার প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে, রাসায়নিক প্রয়োগ করে মোটাতাজা গরু ধীর ও শান্ত হয়। শরীরে ও আচরণে কোনো তেজি ভাবই দেখা যায় না। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের চিকিৎসক ডক্টর সাহেদ আলী বলেন, গরু মোটাতাজাকরণ একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রচলিত প্রদ্ধতি। এটি একটি লাভজনক ব্যবসা। এই প্রদ্ধতি যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে গরু মোটাতাজাকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে গরু মোটাতাজা করে লাখ লাখ বেকার যুবক ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গরুকে মোটাতাজা করতে একটি প্রদ্ধতি হচ্ছে- দুই থেকে আড়াই কেজি ইউরিয়া সার, লালিগুড় ও খড়ের একটি বিশেষ ধরনের মিকচার করে খায়ানো যায়। ১০ দিন কোনো পাত্রে এ মিকচার মুখবন্ধ করে রেখে তা পুনরায় রোদে শুকিয়ে গরুকে খাওয়াতে হয়। এক থেকে দুই মাস এই খাবার খাওয়ালে গরু অতিদ্রম্নত মোটাতাজা হয়ে ওঠে। এটা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত প্রদ্ধতি। তিনি আরো বলেন, কিছু প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শে গরু দ্রম্নত মোটাতাজা করতে ক্যাটাফস, বার্গাফ্যাট, বায়োমিঙ্গ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ায়। এ ধরনের ওষুধে গরুর দেহে অধিক মাত্রায় পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এতে গরুর শরীর ফুলে ফেঁপে ওঠে। এ ধরনের গরুর মাংস খেলে মানবদেহে সরাসরি ক্ষতিকর স্টেরয়েডের প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। দীর্ঘদিন ফ্রিজে রেখে এ বিষাক্ত মাংস খেলে সুস্থ মানুষকেও অসুস্থ করে তুলতে পারে।