পাটের তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্যের রপ্তানিও বেড়েছে। পাটের তৈরি টব, খেলনা, জুট ডেনিম, জুয়েলারি, ম্যাটস, নারী-পুরুেেষর জুতা স্যান্ডেল, বাস্কেট, পাটের শাড়ি, পাঞ্জাবি ও পাটের তৈরি গৃহস্থালি নানা সরঞ্জাম বিদেশে চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রধানত আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোয় এই জাতীয় পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। সোনালি আঁশের খ্যাতি হারিয়েছিল আমাদের পাট। দুর্দিন জেঁকে বসেছিল এক সময়ে অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই শিল্প খাতে। তবে সেই দিন কাটিয়ে আবারও সোনালি আঁশের সেই সোনালি দিন ফিরে আসছে। সোনালি আঁশ, সোনালি দিনের হাতছানি দিচ্ছে আবার। এরই মধ্যে পাটের উৎপাদনে এসেছে গতি। পাটজাতীয় পণ্যের উৎপাদনও বাড়ছে উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে।
পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে পাটের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ খাতে গবেষণা বাড়ানো, নতুন পাটনীতি প্রণয়ন, জুটমিল করপোরেশনকে সংস্কারের আওতায় আনা, পাট পণ্যের ব্যবহার উদ্বুদ্ধ করতে পলিথিনের ওপর ইকো ট্যাক্স আরোপ ইত্যাদি উদ্যোগ নিয়ে সরকার কাজ করছে। পাটজাত পণ্যের ব্যবহার দেশে বাড়ানোর পাশাপাশি এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানির দিকেও মনোযোগ রয়েছে সরকারের। এর মাধ্যমে এ খাতের বিশাল বাজার তৈরি করে কর্মসংস্থান বাড়াতে চায় সরকার।
পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। পাটের রয়েছে নানান ব্যবহার। বাংলাদেশকে এক সময় সোনালি আঁশের দেশ বলা হতো। এর কারণ বাংলাদেশের পাটের বিশ্বময় সুখ্যাতি ছিল। এ ছাড়া বৈদেশিক আয়ের সিংহভাগই আসত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে। কিন্তু কালের চক্রে পাটের সেই সোনালি দিন হারিয়ে গেছে। পস্নাস্টিকসহ বিকল্প অনেক পণ্যের ব্যবহার বাড়ায় পাটপণ্য হারায় তার আভিজাত্য। ফলে এক এক করে এক সময়ের অনেক পাটকলই বন্ধ হয়ে যায়।
এর মধ্যে পাটজাত রপ্তানিপণ্যে সরকারি প্রণোদনার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পাট এমন এক পণ্য- যার চাহিদা শেষ হওয়ার নয়। দেশের সম্পদ খুবই সীমিত। কাজেই এটিকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব পাটজাত পণ্যের ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। পাটশিল্প রপ্তানির জন্য বিশ্বে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিতে হবে। সোনালি আঁশ, সোনালি দিনের হাতছানি দিচ্ছে। তাই রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে পাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পাট থেকে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। পাট থেকে উৎপাদিত রপ্তানিপণ্যে প্রণোদনা দেবে সরকার।
পাটখড়ি থেকে তৈরি হচ্ছে কম্পিউটা ও ফটোকপির মূল্যবান কালি। বিশ্বের ১৩৫টি দেশে ২৮২টি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়। এ ছাড়াও প্রায় ৫০ ধরনের পাটের কাপড় রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বে। বিশ্বখ্যাত বিলাসবহুল গাড়িতে ব্যবহার করা হচ্ছে পাট। উড়োজাহাজের ইন্টেরিয়রও তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। পাট পাতার সু্যপ ও পাটের কফিন ইউরোপের দেশগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। বিশ্বে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক এই তন্তুর বহমুখী ব্যবহার বাড়ছে। জলবায়ু পরির্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাঁধ ও নদী ভাঙনরোধে পাটের বস্তা ব্যবহার হচ্ছে। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার ২৮২টি বহুমুখী পাটপণ্য বিক্রি করছে।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরা (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, বিগত ১২ বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে চারবার। প্রথমবার ২০১০-১১ অর্থবছরে ১১১.৪৯ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়। দ্বিতীয়বার ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১০৩.০৬ কোটি ডলার, তৃতীয়বার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০২.৫৫ কোটি ডলার ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬.১৪ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় হয় ৯১ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চামড়াকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিয়েছে পাট খাত। চলতি অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১১৬ কোটি ৭০ লাখ আয় করার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। ৮ মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রম্নয়ারি সময়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ৯৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার। সেই লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
পাটে সুদিন ফেরাতে সরকার ইতোমধ্যে ৩৭ হাজার ৬৪৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের পাট উৎপাদন উপযোগী ৪৬ জেলার ২৩০টি উপজেলায় উন্নতমানের উচ্চফলনশীল পাট উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে খরার কারণে কৃষকরা পাট জাগ দিতে পারছেন না। এ জন্য দেশের ২৮ জেলার ১০০টি উপজেলায় পাট পচন গ্রিন হাউস করা হয়েছে। এছাড়াও উচ্চফলনশীল পাট বীজ উৎপাদনের জন্য দেশের ৩৬টি জেলার ১৫০টি উপজেলায় উন্নত পাট চাষ করা হচ্ছে। চলতি বছর সরকার পাট উৎপাদনে সাড়ে ৭ কোটি টাকার প্রণোদনা দিচ্ছে। এর আওতায় দেশের ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬০০ জন ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষক বিনামূল্যে পাটের বীজ পাবেন।
বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ২০১০ সালে গবেষণা দল পাটের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ।? এর ফলে, বাংলাদেশ উন্নত মানের পাট চাষ এবং বীজ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে পাটের জন্ম রহস্য আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। এরপর পাটের তিনটি জিনোম কোড পায় বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মানের পাট উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখের বেশি কৃষক পাট উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ পাট খাতের ওপর নিভর্রশীল।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রজনন বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ডক্টর মো. আল-মামুন বলেন, ১৯৯০-এর দশকে দেশে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। পাট শিল্প খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ভালো ব্যবসা করলেও লোকসান গুনছে সরকারি পাটকল। লোকসান বৃত্ত থেকে বের হতে সরকারি পাট কলকে বেসরকারি খাতে লিজ দিচ্ছে সরকার। মহামারি করোনাকাল থেকে সরকারি ২৫টি পাটকল বন্ধ রয়েছে। পাটের পাতা শাক ও সু্যপ হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। ভেষজ হিসেবে পাট পাতার ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকেই। পাটশাক ব্যাপক পুষ্টিগুণ ও বিভিন্ন ঔষধিগুণে গুণান্বিত। শুকনো পাটপাতা গুঁড়া করে পানির সঙ্গে মিশিয়ে রোগ মুক্তির জন্য এবং কাঁচাপাতা শাক হিসেবে বহুকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এছাড়া শুকনো পাট পাতার পানীয় 'চা' হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে।
পাট পাতার রস রক্ত পিত্তনাশক, বাত নিরোধক, ক্ষুধাবৃদ্ধি কারক, আমাশয়, উদারাময় ও অম্স্ন রোগের মহৌষধ। সবজি মেস্তা উচ্চপুষ্টি ও ঔষধিমানের জন্য বিখ্যাত- যার একগুচ্ছ স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই সবজি মেস্তার বাণিজ্যিক চাষ করা হয়। এর আকর্ষণীয় রং, অনন্য টক স্বাদ এবং বহুমুখী ব্যবহার এটিকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সবজিমেস্তা বা রোজেলার নির্যাস উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-প্রলিফারেশন, অ্যান্টি-কার্সিনোজেনিক, অ্যান্টি-হাইপার সেনসিটিভ হাইপারসেনসিটিভ, অ্যান্টি-হাইপার লিপিডিমিক, হেপাটো-প্রতিরক্ষামূলক, মূত্রবর্ধক এবং অন্যান্য অনেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে বাণিজ্যিকভাবে পাট পাতা রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। থাইল্যান্ড ও চীন ও জাপানে এ সু্যপের বেশ খদর রয়েছে।
কাঁচা পাটের পাশাপাশি জুট ইয়ার্ন, টুওয়াইন, চট ও বস্তার পর এবার বিশ্ব বাজারে পাটের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। পাটের ২২ জাতের সুতা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৪ দেশে। পাটকাঠি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে উচ্চমূল্যের অ্যাক্টিভেটেড চারকোল। এই চারকোল দেশের বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে- যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন পস্ন্যান্ট, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। পাটের চারকোল রপ্তানি হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে। পাট থেকে তৈরি চোখ ধাঁধানো শোপিস, চেয়ার, দরজা, ফুলদানি, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, সু্যট-প্যান্ট, চাদর, এমনকি ডেনিমও পাট থেকে তৈরি হচ্ছে। জুতা, স্যান্ডেল, বাসকেট আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে।