গ্রাম-বাংলার অতি পরিচিত একটি জলজ উদ্ভিদ কচুরিপানা। তার মধ্যে যে ফুল ফোটে, তা দেখতে সত্যি খুব সুন্দর। এটা প্রকৃতির আপন খেয়ালে বেড়ে ওঠা এক অবহেলিত প্রাকৃতিক শোভা। পানিতে ভেসে থাকা এক জলজ উদ্ভিদ কচুরিপানা। এর সবুজ গাছ ও বেগুনি বা নীলচে রঙের ফুল সবাইকেই মুগ্ধ করে। জানেন কি? পানি পরিশুদ্ধিকরণে এই জলজ উদ্ভিদ কতটা উপকারী। এমনকি স্বাস্থ্য, ত্বক ও চুলের যাবতীয় সমস্যার সমাধান রয়েছে এই কচুরিপানায়। এ ছাড়াও কচুরিপানা হচ্ছে মাছের প্রিয় আবাসস্থল।
দৃষ্টিনন্দন এই কচুরিপানা ও তার ফুল অবহেলায় পড়ে থাকলেও এর ঔষুধি উপকারিতা রয়েছে প্রচুর। জলজ আগাছা ভাবেন? ডায়াবেটিস থেকে ক্যানসারের মতো একাধিক জটিল রোগকে দূরে রাখে কচুরিপানা। সেদ্ধ, রান্না কিংবা রস যে কোনোভাবেই খাওয়া যায় এই জলজ উদ্ভিদ। ছোট থেকে বড় সব খাল, বিল, ঝিল ও ডোবায় দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন এই কচুরিপানা ও ফুল। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক শংকর কুমার চন্দ্র জানান, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের রিপোর্ট অনুযায়ী, কচুরিপানায় অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান রয়েছে। বার্ধক্য রোধ করতেও ব্যবহার করা যায় কচুরিপানার রস। এছাড়া ক্যানসারের বিরুদ্ধেও লড়াই করার উপাদানও রয়েছে কচুরিপানার মধ্যে।
কচুরিপানার রস শরীরকে শক্তিশালী ও সুস্থ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। কচুরিপানার রস কিংবা খাবার পেটের স্বাস্থ্যের দারুন উপকারি। জলজ এই গাছ ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব এবং পেট ফাঁপা নিয়ন্ত্রণের জন্যও পরিচিত। এমনকি এই উদ্ভিদ পেটের জন্য খুবই উপকারী বলে মনে করা হয়। কচুরিপানার রস গলাব্যথা এবং ফোলার উপশম করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও এই রস গলা ও কানের সমস্যাও নিরাময় করতে দারুণভাবে সক্ষম। যৌন রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও কচুরিপানা দারুণ কার্যকর। মহিলাদের জন্য উপকারী এই জলজ উদ্ভিদ। নতুন মায়েদের স্তনের দুধের পরিমাণ বৃদ্ধিতে দারুণ উপকারি কচুরিপানার রস বা খাবার। এছাড়া এই গাছের ফুলের রস অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা খুব সহজে দূর করে।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের রিপোর্ট অনুযায়ী, কচুরিপানায় অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কলেরা, গলাব্যথা এবং সাপের কামড়ের চিকিৎসার জন্য কচুরিপানার ব্যবহার করা হয়। কচুরিপানার শিকড়, পাতা ও ফুল বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে। দেখা গিয়েছে যে, কচুরিপানায় অনেক রাসায়নিক উপাদান রয়েছে- যা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে সক্ষম। কচুরিপানা শরীরকে শক্তিশালী ও সুস্থ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। যৌন রোগের চিকিৎসাতেও কচুরিপানা খুবই কার্যকরী হতে পারে।
এশিয়া মহাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলের খাবারের মেনু্য দখল করে রয়েছে কচুরিপানা। এটি সিদ্ধ করে নানা পদে রান্না করা হয়ে থাকে। এটি শুধু একটি স্বাস্থ্যকর খাবারই নয় এটি সুপার ফুড হিসেবেও বিবেচিত। কারণ এতে থাকা বিভিন্ন পুষ্টিগুণ আপনার শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারে। ২১০ গ্রাম কচুরিপানায় রয়েছে-৭২২ ক্যালোরি, ফ্যাট ৪ গ্রাম, সোডিয়াম ৪৪ মিলিগ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১২৮ গ্রাম, প্রোটিন ৫০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৭ শতাংশ ও আয়রন ৫৯ শতাংশ।
কচুরিপানা ত্বকের বিভিন্ন কালচে দাগ এমনকি রোদে পোড়া ভাবও কমিয়ে দিতে পারে। এর রস ফেসপ্যাক হিসেবে ব্যবহার করলে ত্বক কোমল ও মসৃণ হয়। জানেন কি? আজকাল অনেক নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীতে কচুরিপানা প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একজিমা হলে ত্বক চুলকায়, শুষ্ক হয় এবং আক্রান্ত স্থানটি লাল হয়ে যায়। এমন সময় ভরসা রাখুন কচুরিপানায়। এতে থাকা প্রদাহবিরোধী উপাদান একজিমা সারাতে সাহায্য করে। কচুরিপানা চুলের জন্য অপ্রন্ত কার্যকরী এক দাওয়াই। আপনি চাইলেই জলজ এই উদ্ভিদের রস চুলে ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে চুল তো পরিষ্কার হবেই পাশাপাশি ঝলমলে ও কোমল ভাব আনবে। চাইলে কচুরিপানার রস এসেনশিয়াল অয়েল বা আমন্ড অয়েলের সঙ্গে মিশিয়ে চুলে ব্যবহার করুন।
কচুরিপানার পাতায় থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান দাঁত ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। কচুরিপানার কয়েকটি পাতা পানিতে ফুঁটিয়ে গার্গেল করুন। দাঁতের ব্যথা মুহূর্তেই কমে যাবে। দাঁত ব্যথার মতোই গলা ব্যথাতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে কচুরিপানা। এতে থাকা প্রদাহবিরোধী উপাদান গলার বিভিন্ন সংক্রমণ দূর করে ব্যথা কমায়। এক্ষেত্রে কচুরিপানার পাতা পানিতে ফুটিয়ে সেই পানি পান করুন। কচুরিপানায় রয়েছে হাইপোকোলেস্টেরোলেমিক উপাদানসমূহ। যা রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে নিয়মিত কচুরিপানা সিদ্ধ করা পানি পান করতে পারেন। পাশপাশি এর বিভিন্ন পদ রান্না করেও খেতে পারেন। এতে রয়েছে প্রচুর ডায়েটারি ফাইবার। যা ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন কচুরিপানার পাতা ফুটিয়ে চায়ের মতো পান করলে ওজন দ্রম্নত কমবে।
কচুরিপানায় প্রচুর পরিমাণে আয়রন আছে। আছে ভিটামিন 'এ, বি, সি ও ক্যালসিয়াম। যেটুকু বিছুটি (যা ক্ষারজাতীয়) আছে, তা তেঁতুল বা টমেটোয় দিলে দূর হওয়ার কথা। একটু বেশি তেলে চিংড়ি দিয়ে রান্না হলে উপাদেয় হবেই। শুঁটকিতেও জমতে পারে। ইলিশ হলে সোনায় সোহাগা। নোনা ইলিশেও মজাদার খাবার হবে। চাইলে নারকেলের দুধ দিয়েও কচুরির ডাঁটা রাঁধতে পারেন। কচুরির ফুল ডিমের সঙ্গে ভেজে খাওয়া যায়। বেসন দিয়ে পাকোড়াও সুস্বাদু। যারা কুমড়ো ও বকফুল ভাজা খেয়েছেন, তারা কচুরির ফুল ডিম দিয়ে বা বেসনসহকারে পাকোড়া করে খেয়ে দেখতে পারেন। কচুরিপানা যে সুখাদ্য এবং পুষ্টিতে ভরপুর, তাতে সন্দেহ নেই।
কচুরিপানার বৈজ্ঞানিক নাম ঊরপযযড়ৎহরধ
পৎধংংরঢ়বং। আইকর্নিয়া নামটি এসেছে রানির নাম থেকে। রানি এই ফুলের রূপে মুগ্ধ ছিলেন। বিলাসী রানির টবে চাষ হতো এই ফুল। এক বর্ষার রাতে টব থেকে এর একটি চারা বাইরে ভেসে যায়। ভাসতে ভাসতে নদীতে। নদীর স্রোতে গেল ভেসে বহুদূর। ব্রিটিশ আমলে যশোরে এমন ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল যে অর্ধেক মানুষই শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। যশোর শহর বিরান হয়ে গিয়েছিল। সরকারি কর্মচারীরা ম্যালেরিয়ার ভয়ে যশোরে পোস্টিংই নিতে চাইতেন না। বিশ শতকের প্রথমার্ধে জানা গেল, মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়। তার নিরাপদ আশ্রয় এই কচুরিপানায়।
মাছ চাষে কচুরিপানার ব্যবহার আছে। গরমে পানি শীতল রাখে। মাছ কচুরিপানার নিচে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। কচুরির দাড়ির মতো শিকড়ের ভাঁজে ভাঁজে মাছ আশ্রয় নেয়। চিংড়ি, কই মাছের খুব প্রিয় আবাস এই কচুরিপানা।