মাঠে মাঠে সবজি উৎপাদনে বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশ
বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার সবজি রপ্তানি হয়
প্রকাশ | ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ইমরান ছিদ্দিকি
মাঠে মাঠে এখন সবজি আর সবজি। চোখ ধাঁধানো দৃশ্য। কৃষকরা সারা বছর মাটি নেড়েচেড়ে রকমারি সবজি উৎপাদন করছেন। সবজি আবাদ ও উৎপাদনকে ঘিরে বহুগুণে বেড়েছে মাঠে মাঠে কর্মচাঞ্চল্যতা। মাঠ ভরে গেছে সবজিতে। হাটবাজারেও প্রচুর সবজি উঠছে। মাঠে সবজির ফলন দেখে চাষিদের বুক ভরে যাচ্ছে। বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। দেশের মোট ফসলি জমির প্রায় ৫ শতাংশ অর্থাৎ আবাদযোগ্য জমির প্রায় ১০ শতাংশ সবজি উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত এক যুগে দেশে রীতিমতো সবজি বিপস্নব ঘটে গেছে।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। চীন ও ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। দেশে সবজির উৎপাদন গত ১২ বছরে বেড়েছে ৭ গুণ। আর পাঁচ বছরেই সবজি উৎপাদন বেড়েছে ৫৪ লাখ টন। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদন হয় ১ কোটি ৪৪ লাখ টন। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৯ হাজার টনে। ১৯৭০ সালে উৎপাদন হতো মাত্র ৭ লাখ টন। ৫ বছরে সবজি উৎপাদন বেড়েছে ৫৪ লাখ টন। বছরে দেশে ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হয়। বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার সবজি রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বে।
কৃষি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত। এ খাত থেকে জিডিপির ১৩ দশমিক ২৯ শতাংশ আসে। বর্তমানে ১ কোটি ৯৭ লাখ টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৮ হাজার টন সবজি উৎপাদিত হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে সবজি উৎপাদন হয় ১ কোটি ৮৪ লাখ ৪৭ হাজার টন। সরকারি ও বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো সারা বছর চাষের উপযোগী হাইব্রিড বা উচ্চফলনশীল (উফশী) সবজি বীজ উদ্ভাবন এবং তা বাজারজাত করার ফলে সবজি চাষে সাফল্য ও বৈচিত্র্য এসেছে। দেশে বর্তমানে প্রায় ১০০ ধরনের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে, যার সঙ্গে জড়িত ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার।
অল্প পরিমাণ জমি থেকে বিপুল জনগোষ্ঠীর সবজি চাহিদা মেটানো হচ্ছে। দেশে প্রায় ১০০টি জাতের সবজি উৎপাদন হচ্ছে। দেশে প্রায় ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবার কমবেশি সবজি চাষ করছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে গত চলিস্নশ বছরে বাংলাদেশে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ গুণ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর তথ্য মতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৫০ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার টাকার সবজি রপ্তানি হয়েছে এবং রপ্তানির পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। দেশের রপ্তানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যাচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশের সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু উদ্যোক্তারা চাহিদার মাত্র ২ থেকে ৫ শতাংশ রপ্তানি করতে পারছে।
কৃষিতে আশাতীত সাফল্যের দেশ বাংলাদেশ। দেশে লোকসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়লেও সে তুলনায় বাড়েনি কৃষিজমি বরং প্রতি বছর এক শতাংশ হারে কমেছে। এর পরও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বেড়েছে পুষ্টির নিরাপত্তাও। তাতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে। বাংলাদেশের কৃষিকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করছে বিশ্ব।
খাদ্যশস্য, সবজি, ফলসহ বিভিন্ন শস্যে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। কয়েক দশক আগেও হাতেগোনা কিছু সবজির বাণিজ্যিক উৎপাদন হতো। পাশাপাশি সবজি রপ্তানি করেও মিলছে বৈদেশিক মুদ্রা।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। এক সময় দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরেই কেবল সবজির চাষ হতো। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। এখন দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার স্ট্যাটিসটিক্যাল ইয়ারবুক-২০২০ অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে বাংলাদেশে। সবজি উৎপাদনের বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশ। পাশাপাশি একই সময়ে সবজির মোট উৎপাদন বৃদ্ধির বার্ষিক হারের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে ১০ বছর আগে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়া বা ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) হিসাবে, গত বছর দেশে মাথাপিছু সবজি ভোগের পরিমাণ হয়েছে প্রায় একশ' গ্রাম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, যদিও দেশে মোট আবাদির মাত্র নয় ভাগ জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে এবং এক কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার এই সবজি উৎপাদন করছে। বছরে প্রায় দুই কোটি টন সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত শাকসবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বজোড়া। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ প্রায় ৫০টি দেশে সবজি রপ্তানি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মতো ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি বাড়ছে। রপ্তানি খাতে যোগ হচ্ছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য।
প্রতিনিয়ত রপ্তানি খাতে যোগ হচ্ছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। চাহিদা মেটাতে দেশের শতাধিক প্রতিষ্ঠানে তৈরি হচ্ছে বিস্কুট, জ্যাম-জেলি, সরিষার তেলসহ প্রায় ৮০০ ধরনের পণ্য। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ১৪৪ দেশে রপ্তানি হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার খাদ্যপণ্য। অথচ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি বলছে, শুধু প্রতিবেশী দেশগুলোতে ১২ হাজার কোটি টাকার কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করতে পারে বাংলাদেশ। রপ্তানি অবকাঠামো তৈরিতে পিছিয়ে থাকায় সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মনে করেন খাত সংশিষ্টরা। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। অথচ এডিবি বলছে, সম্ভাবনা রয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকার। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
দেশের প্রক্রিয়াজাত কৃষি খাদ্যপণ্য রপ্তানি খাত দিন দিন বড় হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, নেপাল ও আফ্রিকার দেশগুলোর পর ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি শুরু হয়েছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের। এখন ইউরোপের মধ্যে তিন দেশ যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও ইতালিতে বেশি যাচ্ছে এসব পণ্য। ইউরোপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতেও প্রক্রিয়াজাত কৃষি খাদ্যপণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে বাংলাদেশের ৫০ জাতের সবজি ও ফলমূল রপ্তানি হয়। তবে যেসব দেশে বাংলা ভাষাভাষীরা বসবাস করছে সেসব দেশে বাংলাদেশের সবজি রপ্তানির চাহিদা বেশি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রবৃদ্ধির এ হার বজায় থাকলে আগামীতে সবজি রপ্তানি খাতে আয় ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। দেশের রপ্তানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে যায়। এসব সবজির মধ্যে করলা, কাকরোল, টমেটো, পেঁপে, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, লাউ, কচুরলতি, কচুরমুখী, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, কাঁঠাল, শসা, চিচিঙ্গা, লালশাক, পুইশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচামরিচ, পটল, ঝিঙা প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য। এছাড়াও প্রক্রিয়াজাত সবজির মধ্যে রয়েছে- ডাঁটা, কচুরলতি, শিমের বিচি, কাঁচকলা, কলার ফুল, কচুশাক, কাঁঠালের বিচি প্রভৃতি।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যে অভিঘাত দৃশ্যমান তার সবচেয়ে স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হলো বাংলাদেশ। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি প্রভৃতি চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন বাংলাদেশ। এরূপ বাস্তবতায় এসডিজিতে ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে কৃষি সম্পর্কিত অন্যতম অভীষ্ট ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার। এখানে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সবজির উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। সময় বাকি মাত্র ৭ বছর। পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে পতিত জমিতে সবজি, শাকসবজি উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই।
এসব উৎপাদিত ফল ও সবজি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে আরো বেশি রপ্তানি করা সম্ভব। কিন্তু উৎপাদিত সবজি ও ফলের সঠিক গুণগত মানের অভাব, নিরাপদ উৎপাদনের অভাব, গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিসের (জিএপি) অভাব, অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার, চুক্তিভিত্তিক কৃষক না থাকা (কন্ট্রাক্ট ফার্মিং), অ্যাক্রেডিটেশন ল্যাবরেটরি না থাকা, তদারকি ও মান সনদের দুষ্প্রাপ্যতা, রপ্তানির জন্য বিশেষ অঞ্চল না থাকাসহ ২১ ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এ ক্ষেত্রে।
দেশে প্রচুর চাহিদা থাকায় নিজ তাগিদে বিদেশি সবজি চাষ করছেন কৃষকরা। এসব চাষে কোনো প্রশিক্ষণ নেই তাদের। নিজেরাই বীজ সংগ্রহ করে নেমে পড়েছেন চাষে। বিদেশি এসব সবজি সাধারণ মানুষ যেমন কেনে পাশাপাশি রেস্টুরেন্টগুলোতেও চাহিদা রয়েছে। ফলে কৃষকরা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। সরবরাহ করছেন সারাদেশে। লেটুসপাতা, চায়নিজ পাতা, ক্যাপসিকাম, বিট রুট, ব্রম্নকলি, রেড ক্যাবেজ, স্কোয়াশ, ফ্রেঞ্চ বিন, সুইট কর্ন, বেবি কর্ন, থাই আদা, থাই তুলসী, লেমনগ্র্যাস, স্যালারি পাতা, শিমলা মরিচ, চায়নিজ ক্যাবেজ- ক্ষেতের পর ক্ষেতজুড়ে চলছে এসব বাহারি বিদেশি সবজির চাষ।