যারা স্বাস্থ্য সচেতন তারা ডিম কিনতে গিয়ে বাদামি নাকি সাদাটা কিনবেন এ নিয়ে হয়তো বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন। অনেকে মনে করেন বাদামি ডিমে সাদা ডিমের চেয়ে বেশি পুষ্টি থাকে। এমনকি দুটি ডিমের আকার সমান হলেও। বাজারে বাদামি ডিমের দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ার কারণেও এমন একটি ধারণা তৈরি হয়ে থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে সাদা ডিম সবচেয়ে জনপ্রিয়। আবার এর উল্টোটাও রয়েছে। রোজকার ডায়েটে একটা করে ডিম কমবেশি সবাই খেয়ে থাকেন। তবে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে, সাদা ডিম খাব নাকি লাল? প্রশ্নটা স্বাভাবিক। রঙের ভিত্তিতে পুষ্টিমানও তো আলাদা হতে পারে।
বাজারে যেসব মুরগির ডিম পাওয়া যায় তার সিংহভাগই ব্রয়লার মুরগির। এর মধ্যে আবার দুই রঙের ডিম পাওয়া যায়। একটি লাল খোলসের অন্যটি সাদা। ডিমের রং মুরগির জাত ও জিনের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত, সাদা পালকের মুরগির ডিম সাদা এবং গাঢ় রঙের পালকের মুরগির ডিম লাল হয়ে থাকে। বিশেষ করে সাদা লেগহর্ন জাতের মুরগি বিভিন্ন রঙের হলেও তারা সবাই সাদা ডিম পাড়ে। অন্যদিকে, পেস্নমাউথ রকস বা রোড আইল্যান্ড মুরগিগুলো লাল ডিম পেড়ে থাকে। কিছু কিছু জাতের মুরগি সাদা হলেও লাল ডিম পাড়ে।
সাধারণত ডুয়েল ব্রিড অর্থাৎ যেসব মুরগি ডিম ও মাংস দুটি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পালন করা হয় সেগুলো লাল রঙের ডিম পাড়ে। এসব মুরগি আকারে বড় হওয়ায় বেশি পরিমাণ খাবার দিতে হয়। ফলে ডিমের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। অন্যদিকে, সাদা পালকের মুরগির প্রজনন খরচ কিছুটা কম। তারা বাদামি রঙের মুরগির চেয়ে খায়ও কম। এজন্য সাদা ডিমের দাম লাল মুরগির চেয়ে কিছুটা কম রাখা যায়। তবে ডিমের রঙের সঙ্গে এর পুষ্টিগুণের কোনো তারতম্য হয় না। আবার নিউইয়কের্র এক দল গবেষকের মতে লাল ডিমে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড সামান্য বেশি রয়েছে। কিন্তু সেই পার্থক্য এতটাই সামান্য যে তাতে খুব একটা ফারাক হয় না। সেক্ষেত্রে বলা যায়, দুই রঙের ডিমের খাদ্যগুণ প্রায় সমান। তাই ডিম যে রঙেরই হোক আপনি তা নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, একটি ৫০ গ্রাম ওজনের ডিমে ৭২ ক্যালোরি ও ৪.৭৫ গ্রাম ফ্যাট রয়েছে। সাদা ও লাল ডিমে এই পুষ্টিগুণের পরিমাণ প্রায় সমান।
কর্নেল ইউনিভার্সিটির পশু বিজ্ঞান বিভাগের ভিজিটিং ফেলো ট্রো ভি. বুইয়ের মতে, বাদামি ও সাদা ডিমের মধ্যে পুষ্টিগত কোনো পার্থক্য নেই। তবে বাদামি রঙের ডিমে তুলনামূলক বেশি ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড থাকলেও পার্থক্যটা অতি সামান্য বলে মনে করেন তিনি। বাদামি ও সাদা ডিমের পুষ্টিগুণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ গবেষণায় কোনো পুষ্টিগত পার্থক্য দেখা যায়নি।
ওজনব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গার্গি শর্মা মনে করেন, সাদা ডিমের চেয়ে বাদামি ডিম স্বাস্থ্যকর। তার মতে, যারা সঠিক মাত্রায় প্রোটিন, কোলেস্টরেল ও ক্যালোরি গ্রহণে ইচ্ছুক তাঁদের জন্য বাদামি ডিম একটি ভালো বিকল্প। তবে 'পুষ্টিগত দিক থেকে সাদা ও বাদামি ডিমের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে বর্তমানে বাদামি ডিম অর্গানিক এবং স্বাস্থ্যবান হিসেবে মনে করে অনেকে পছন্দ করে থাকেন।'
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি এক্সটেনশন এ প্রক্রিয়ার একটি চিত্র দিয়েছে। তাদের হিসাবে, একটি ডিম তৈরি হতে প্রায় ২৬ ঘণ্টা সময় লাগে। তবে প্রাইম টাইমে অর্থাৎ জীবনের প্রথম দুই বছর মুরগি দৈনিক একটি করে ডিম দিতে পারে। ডিম তৈরির প্রক্রিয়াটি শুরু হয় মূলত কুসুম তৈরির মধ্য দিয়ে। গর্ভে তৈরি হয় এটি। এরপর সেটি চলে যায় অভিডাক্ট টিউবে। এখানে কুসুমের চারদিকে সাদা অংশটি (অ্যালবুমিন) তৈরি হতে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। এরপর খোসার নিচের ঝিলিস্ন তৈরি হয় ৭৫ মিনিটে। এরপর ডিমটি চলে যায় শেল গস্ন্যান্ডে। এখানেই তৈরি হয় উপরের শক্ত খোসা।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের খাদ্য প্রযুক্তির গবেষক ডিনা জোনস বলেন, শেল গস্ন্যান্ডে একটি ডিম সবচেয়ে বেশি সময় অবস্থান করে। খোসা তৈরি হতে কমপক্ষে ২০ ঘণ্টা সময় লাগে। ডিম তৈরির একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে যোগ হয় রং। এটি ঘরে রং করার মতো একটা ব্যাপার। সব ডিমই প্রাথমিকভাবে সাদা হয়। সাদা ডিম রং করার ধাপটি এড়িয়ে যায়। বাদামি ডিমের দাম রবশি হওয়ার পেছনের রহস্য এখানেই। বাদামি রং দিতে বেশি পরিমাণে পুষ্টি ও শক্তি খরচ হয়। এ কারণে বাদামি লেয়ার মুরগি পালনে খাবারের পেছনে খামারির বেশি খরচ করতে হয়। এ কারণেই বাণিজ্যিকভাবে পালন করা বাদামি পালকের মুরগির খাদ্য চাহিদা বেশি। তবে সাদা ও বাদামি ডিমের মধ্যে পুষ্টি ও ক্যালরির দিক থেকে উলেস্নখযোগ্য কোনো পার্থক্য এখনো কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি।
যদিও দুই রঙের ডিমের মধ্যে স্বাদ ও গন্ধে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে বলে অনেকে লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু ডিমের স্বাদ অনেকখানি নির্ভর করে মুরগির খাদ্যের ওপর। ফলে সাদা ও বাদামি মুরগিকে একই ধরনের খাবার দিলে স্বাদে পার্থক্য ধরতে পারাটা কঠিন হবে। অবশ্য বাদামি মুরগির ডিমের কুসুমের রং বেশি গাঢ় দেখায়। এর পেছনের কারণ হলো, ডিম পাড়ার সময় বাদামি মুরগিকে বেশি পরিমাণে শস্য খেতে দেয়া হয়।
লেয়ার মুরগির খামারিদের সংগঠন আমেরিকান 'এগ' বোর্ডের হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্রে সাদা ডিম অত্যন্ত জনপ্রিয়। ২০১৭ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ডিমের বাজারে বাদামি ডিমের হিস্যা মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এর প্রধান কারণ সাদা ডিমের দাম কম, ফলে চাহিদা বেশি। খরচ কম হওয়ায় খামারিও সাদা মুরগি পালনে বেশি আগ্রহী।
যে কোনো মুরগির ডিমের রং নির্ভর করে মুরগির প্রজাতি, খাদ্যাভ্যাস, স্ট্রেস লেভেল ও পরিবেশের ওপর। ডিমের রং যাই হোক না কেন, পুষ্টিগুণে ফারাক নেই কোনো। প্রোটিন, ভিটামিন বি১২, রিবোফ্লাভিন, কোলিন ও সেলেনিয়ামের মতো জরুরি উপাদান ঠিকই আছে। পার্থক্য কি একেবারেই নেই। গবেষণায় জানা গেছে, বাদামি ডিমে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড সামান্য বেশি থাকে। তবে, পার্থক্যটা খুবই সামান্য। সাদা বা বাদামি এই পার্থক্য করে খাওয়ার প্রয়োজন হয় না।