শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে আম

বিশ্বের ৩৪টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলার আম
আলতাব হোসেন
  ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে আম

আম বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও সবার কাছে পরিচিত একটি ফল। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হওয়া ফলের নামও আম। স্বাভাবিকভাবে মানুষ সুস্বাদু যে ফলটি বেশি খায় তার নামও আম। আমের কদর শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে। বাংলাদেশের জাতীয় ফল না হলেও আমের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। বরং দিন দিন অন্যান্য ফলের চেয়ে আমের উৎপাদন যেমন বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে এর চাহিদাও। পাশাপাশি সুযোগ বাড়ছে আম রপ্তানি আর আমজাত খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন ও বাজার বিস্তার।

বাংলাদেশের আমের সুনাম আছে বিশ্বে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে যখন আম পাকে তখন বিশ্ববাজারে আর কোনো আম পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের মাটি, জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থান উপযোগী হওয়ায় এবং শ্রমিকের সহজলভ্যতা থাকায় গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট আম উৎপাদন সম্ভব। উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি ও পরিচর্যার মাধ্যমে রপ্তানির উপযোগী আমের উৎপাদন বৃদ্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এবার আম রপ্তানির লক্ষ্য ৪ হাজার টন। বিশ্বের ৩৪ দেশে রপ্তানি হচ্ছে আম, অর্থনীতিতে রাখছে বিশাল অবদান।

বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৩৪টি দেশে আম রপ্তানি হচ্ছে। গত বছর ৩৪টি দেশে মোট দুই হাজার ৭০০ টন আম রপ্তানি হয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় এক হাজার টন বেশি। এর আগের বছর ২৮টি দেশে মোট এক হাজার ৭৫৭ টন আম রপ্তানি হয়েছিল। আম হচ্ছে একটি খুবই সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও দৃষ্টি নন্দন জনপ্রিয় ফল। পৃথিবী জুড়েই এর চাষাবাদ হয়। এসব অঞ্চলেই বিভিন্ন ধরনের আমের চাষাবাদ দেখা যায়- যা বিভিন্ন শ্রেণির ভোক্তাদের চাহিদা পূরণে ফ্রেশ ফল হিসেবে অথবা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে আম। বর্তমানে মানুষের আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মানুষ মৌলিক খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি অধিক পুষ্টিকর ও অন্যান্য গুণাগুণ সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের দিকে ঝুঁকছে।

আমভিত্তিক শিল্প স্থাপনে বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান এমনকি সৌদি আরবও আমজাত পণ্য নিয়ে গবেষণা করে আমভিত্তিক শিল্পের ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশও আমের রস, আমের মোরব্বা, আমের স্কোয়াশ, আমের জেলি, আমের পাল্প, আমের ট্রফি, আমের মধু, আমসত্ত্ব, আমের বরফি, আমের আচার, আমের জ্যাম, আমের পাউডার প্রভৃতি আমভিত্তিক খাদ্যদ্রব্য তৈরির উদ্যোগ নিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের প্রধান আম উৎপাদনকারী উত্তরাঞ্চলের তিনটি জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী এবং নাটোর ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলাসহ অন্যান্য জেলায়ও এখন ব্যাপক হারে আম চাষ হচ্ছে। দেশে আমের এই মৌসুম খুবই অল্প সময়ের জন্য। অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা এবং রপ্তানির সুযোগ কম থাকায় চাষিরা আমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে আম চাষ আরো বৃদ্ধি পাবে। এর সুফল ঘরে তুলতে ব্যাপক প্রচার চালানো দরকার। এজন্য প্রথমে আমাদের স্থানীয় বাজারে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার আমভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠায় বেসরকারি সেক্টর যাতে এগিয়ে আসতে পারে, এ জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আম থেকে জুস এবং অন্যান্য আইটেমের মতো খাদ্য বহুমুখীকরণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

দেশে আম উৎপাদনে প্রথম চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং দ্বিতীয় অবস্থানে সাতক্ষীরা জেলা। আম উৎপাদন বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্টরা এখন ফলটির হেক্টরপ্রতি ফলন বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছেন। অন্যদিকে, ফলটি উৎপাদনে এখন প্রক্রিয়াজাত শিল্পের সংশ্লিষ্টতাও বাড়ছে। পৃথিবীতে আম উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম। সাম্প্র্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে আমের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমের চাষ বেড়েছে অনেক গুণ। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই আমের ফলন হলেও রাজশাহীর আমের আছে অনেক সুনাম আছে। মৌসুমি ফল আমকে কেন্দ্র করে দেশের কয়েক লাখ মানুষেরও কর্মসংস্থান হয়। মৌসুমে আমকেন্দ্রিক পরিবহণ ব্যবস্থাও থাকে বেশ জমজমাট। বাংলাদেশে শতাধিক প্রজাতির আম রয়েছে। এর মধ্যে ৫০টির মতো প্রজাতি টিকে আছে। এসব প্রজাতির মধ্যে ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরসাপাতি (গোপালভোগ), হিমসাগর, লক্ষ্ণণভোগ, মোহনভোগ ও বোম্বাই এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এছাড়া দেশে গবেষণার ভিত্তিতে উদ্ভাবিত উন্নত জাতের আম হলো বারি-১, বারি-২, বারি-৩ ও বারি-৪। এখন নতুন যোগ হয়েছে আম্রপালি ও মলিস্নকা। দিনাজপুরের সূর্যপুরীও বিখ্যাত হচ্ছে। দেশে এখন প্রায় এক লাখ একর জমিতে আম উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি আবাদ হচ্ছে বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামভুক্ত জেলায়। দেশের প্রায় সব জেলায়ই আম উৎপাদন হয়। উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও এখন মিষ্টি আমের চাষ হচ্ছে। পার্বত্য জেলার জুম চাষ এলাকায়ও এখন উন্নত জাতের আম ফলছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৮০০ জাতের আম চাষের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১১টি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ২১টি আমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে আম্রপালি সবচেয়ে জনপ্রিয়।

গত বছর বিশ্বের ৩৪টি দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্যে এক হাজার ২৫৬ টন, ইতালিতে ২৯৬ টন, সৌদি আরবে ২৬০ টন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৩৭ টন, কাতারে ১১১ টন, সিঙ্গাপুরে ৫৫ টন, সুইজারল্যান্ডে ১৪ টন, জার্মানিতে ৭০ টন, ফ্রান্সে ৮৫ টন, সুইডেনে ৬৫ টন, কুয়েতে ২১৮ টন এবং কানাডায় ৪০ টন আম রপ্তানি করা হয়েছে। দেশে বছরে প্রায় ২৫ লাখ টন আম উৎপাদন হয়। কিন্তু উৎপাদনের তুলনায় রপ্তানির পরিমাণ অনেক কম। ২০১৭-১৮ সালে মাত্র ২৩২ টন, ২০১৮-১৯ সালে ৩১০ টন, ২০১৯-২০ সালে ২৮৩ টন, ২০২০-২১ সালে ১৬৩২ টন, ২০২১-২২ সালে এক হাজার ৭৫৭ টন আম রপ্তানি হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর এবং আশ্বিনা জাতের আম রপ্তানি হচ্ছে। তবে বারি আম-২ এবং বারি আম-৭ বিদেশে রপ্তানির জন্য সম্ভাবনাময় জাত। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমের জুস এখন রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা মেটাতে ফলটি প্রক্রিয়াজাত করে জুস তৈরিতে সচেষ্ট রয়েছেন উদ্যোক্তারা। দেশে অভ্যন্তরে ও রপ্তানি মিলে জুসের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার। জুসের বাজারে প্রাণ, আকিজ, একমি, সজীব, ট্রান্সকম ও পারটেক্স গ্রম্নপ এগিয়ে আছে। জুসের বাজারে প্রাণ গ্রম্নপের ব্র্যান্ড ফ্রুটো, আকিজের ফ্রুটিকা, একমি গ্রম্নপের একমি, সজীব গ্রম্নপের সেজান, ট্রান্সকমের স্স্নাইস ও পারটেক্স গ্রম্নপের ড্যানিশ প্রভৃতি। বাংলাদেশের আমের জুস রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ আরব আমিরাত, আবুধাবি, দুবাই, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান ছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইতালি, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের বাজারে। আশা জাগানিয়া খবরটি হলো- বাংলাদেশের ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয়েছে। এফএও'র মতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আম রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনাটি হলো- বাংলাদেশের আম যখন পাকে তখন বিশ্ববাজারে অন্য কোনো দেশের আম আসে না। যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু ফল হিসেবে বাংলাদেশের আমকে বেশ পছন্দ করছে। গুণে ও মানে অতুলনীয় হওয়ায় বিশ্ববাজারে দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশের আমের চাহিদা। রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট কোম্পানি এই আম রপ্তানি করবে জার্মান, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। এ কারণে সরকার আম উৎপাদনে মাঠ পর্যায় তদারকি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকমান বজায় রেখে উৎপাদন করতে পারলে বছরে ১ হাজার টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে।

ফলের মধ্যে দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ফলের রাজা আম। কাঁচা ও পাকা আম ছাড়াও ফ্রুট ড্রিংকস, জুস, আচার, চাটনি, আমসত্ত্ব, চকোলেটসহ নানা ধরনের পণ্য তৈরিতে আমের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে আম ও আমভিত্তিক শিল্প সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে আমের ফলন বাড়ছে। দেশেও ধারাবাহিকভাবে ফল উৎপাদনের শীর্ষে থাকছে আম। বর্তমানে দেশে আম এবং প্রক্রিয়াজাত আমভিত্তিক পণ্যের বাজার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার। বর্তমানে বাংলাদেশের আম বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে আমের রপ্তানি আরও প্রসারিত হবে। বর্তমানে দেশে বছরে ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়। সারাদেশে বারোমাসি আমের চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমের উৎপাদন দেড় থেকে দুই গুণ বাড়ানো সম্ভব।

বিশ্বে আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম স্থানে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আগে অনেকে শখের বশে আমের বাগান করলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে আমের বাগান বা আম চাষে নিবিষ্ট হয়েছে। এতে ব্যক্তি যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি লাভবান হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এমনকি এতে করে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানও। একটি আমবাগানকে কেন্দ্র করে অনেকের কর্মস্থান হচ্ছে। আমাদের দেশে সাধারণত গোপালভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি, চোষা, ক্ষীরসাপাতি, আম্রপালি, হাঁড়িভাঙাসহ বিভিন্ন উন্নত জাতের সুস্বাদু আম চাষ হচ্ছে। আনন্দের খবর হলো, দেশের চাহিদা যথাযথভাবে মিটিয়ে এখন এসব আম বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর এক হাজার টনের বেশি আম রপ্তানি হচ্ছে।

এমন চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ, অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের আমের চাহিদা অনেক বেশি। বিদেশে বাংলাদেশের আমের বিপুল চাহিদার অন্যতম প্রধান কারণ বাংলাদেশের আম অন্য দেশের আমের চেয়ে অনেক বেশি সুস্বাদু। তাই প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশিদের কাছেও বাংলাদেশের আমের চাহিদা বাড়ছে। আম শুধু এখন আর একটি ফল নয়। দেশের একটি অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবেও আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। কেননা, দিন দিন আমের চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে