হপস নামক এক ধরনের থোকা থোকা ফুলবিশিষ্ট গাছের ডগা 'হপ শুটস' নামে পরিচিত, যার দাম শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠবে! হপ শুটস যেমন বিশ্বের সবচেয়ে দামি সবজি, তেমনই এর পুষ্টিগুণও অনেক। হপ- হিউমুলাস লুপুলাস গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম। যদিও খুব কম মানুষই এই নামটির সঙ্গে পরিচিত। এটি একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এটির বৈশিষ্ট্য জানার আগ পর্যন্ত উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের অধিবাসীদের কাছে এটি আগাছা হিসেবে পরিচিত ছিল হপ। হপ শুটসের ফুলকে বলা হয় 'হপ কোনস'। এই ফুল বিয়ার প্রস্তুত করতে কাজে লাগে। আর বাকি অংশ সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই গাছের ফুল হপ নামে পরিচিত। এই ফুল দিয়ে বিয়ার তৈরি করা হয়। কোনো পানীয়তে সুগন্ধী দেওয়ার কাজেও লাগে এই ফুল। হপ ফুল দিয়ে তৈরি বিয়ার সহজে নষ্ট হয় না। মূলত পানীয় তৈরিতেই প্রথম এই গাছের ব্যবহার সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে এর ঔষধি গুণ সামনে আসতে শুরু করে।
হপ শুটস যেমন বিশ্বের সবচেয়ে দামি সবজি, তেমনই এর পুষ্টিগুণও অনেক। হপ শুটসকে মনে করা হয় এক ধরনের ভেষজ ঔষধ- যার মধ্যে রয়েছে এসেনশিয়াল অয়েল, ভিটামিন ও খনিজ। হপ শুটসে থাকা ভিটামিন ই, ভিটামিন বি৬ ও ভিটামিন সি'তে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান- যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে (ইমিউন সিস্টেম) আরও সক্রিয় করে তোলে এবং রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে আনে।
হপ শুটসে থাকা প্রাকৃতিক তেল ও খনিজগুলোর ত্বকের ওপর একটি অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি প্রভাব রয়েছে এবং সারফেস বস্নাড ভেসেল কমাতে ব্যবহৃত হয়- যার ফলে ত্বকে লালচেভাব ও জ্বালাপোড়া কমাতেও সাহায্য করে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, চুল ধুতে বিয়ার ব্যবহৃত হয়, কারণ এতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং হপস- যা চুল পড়া হ্রাস করে ও খুশকি কমায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পেশি ও শরীরের ব্যথা কমাতে হপস ব্যবহৃত হয়। হপস শরীরের মেটাবলিজমকে (বিপাক) ত্বরান্বিত করে এবং খাবার দ্রম্নত হজম হতে সাহায্য করে।
কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, হপস সবজিতে প্রচুর এসেনশিয়াল অয়েল থাকায় এটি সুখকর নিদ্রায় সাহায্য করে। হপসে থাকা এসেনশিয়াল অয়েলে রয়েছে ব্যথা প্রশমনের মতো উপাদান এবং এর সিডাটিভ ইফেক্ট (উপশমকারী) নারীদের ঋতুস্রাবের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। সিডাটিভ গুণের কারণে এটি শরীরের পেশিগুলোকে আলগা করে এবং ব্যথা কমায়। এই সবজি একবার খেলে সারবে অনেক রোগ, তবে দাম 'একটু' বেশিই, লাখ টাকা মতো।
সারা বিশ্বের কাছে এই গাছটির অবশ্য আলাদা একটি পরিচয় রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে দামি সবজির গাছ এটি। এর ১ কেজির দাম ১ লাখ টাকার কাছাকাছি! বাজারে চাহিদা না থাকায় বাংলাদেশ-ভারতে এই সবজির চাষ হয় না। মূলত ইউরোপ এবং আমেরিকায় এর বহুল উৎপাদন হয়ে থাকে। আর সবজিটির নাম হপ শুটস। সবজিটি দেখতে অনেকটা অ্যাসপারাগাসের মতো। খেতেও অনেকটা সে রকমই। অ্যাসপারাগাস যেভাবে রান্না করে খেতে হয় এই সবজিটিও সেভাবেই খেতে পারবেন। এ ছাড়া আরও অনেক ব্যবহার রয়েছে এর।
ওই সবজিটি প্রথম চাষ হয় ৭৩৬ সালে জার্মানিতে। তবে প্রথম হপ শুটস পানীয়তে ব্যবহার করা হয় ১০৭৯ সালে। পরবর্তী সময়ে হপ শুটস-এর আরও অনেক ঔষধি গুণের কথা সামনে আসে। এর বিশেষ অ্যান্টি-ব্যাকটিরিয়াল গুণ রয়েছে। টিবি রোগীদের ওষুধ তৈরিতে, ক্যানসারের চিকিৎসায় কাজে লাগে হপ শুটস। এই সমস্ত কারণেই হপ শুটসের এমন আকাশছোঁয়া দাম।
হপ শুটসের মধ্যে থাকা অ্যাসিড ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলোকে নষ্ট করে দেয়। ক্যানসারের ওষুধ তৈরিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই হপ শুটস নিয়ে বহু গবেষণাও চলছে। এই গাছটি মূলত ঝোপ প্রকৃতির। ফুলগুলো সবুজ রঙের আর খুব নরম। তাই খুব সাবধানে গাছ থেকে তুলতে হয় সেগুলো। তোলার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আর বিক্রির যোগ্য থাকে না।
হপস চাষাবাদের জন্য আদর্শ মাটি হলো এমন মাটি যার মধ্য দিয়ে হপের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। তবে মাটি শুকনা হওয়া জরুরি। হপ শুটসের শিকড় ৪ থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত মাটির গভীরে যায়। বসন্ত ও গ্রীষ্মে গাছের বৃদ্ধির জন্য পানি সেচ দিতে হবে। হপস শুটসের বীজ মাচের আগেই লাগাতে হয়। মার্চের শেষে বীজ অংকুরিত হয়ে গাছ ঝোপালো আকার ধারণ করলে তখন ডালপালা ছাঁটাই করে দিতে হবে। তবে বীজ লাগানোর আগে জমি ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হবে। হপ শুটস উৎপাদনের জন্য শীত প্রয়োজন হয়। হপ শুটসের মুকুলগুলো ২৪ থেকে ২৫ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে না। তবে বাংলাদেশে শীতকালে সঠিক পরিবেশ তৈরি করে এই সবজি চাষ করা সম্ভব। এই সবজি রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
'হপ শুটস' নামের বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সবজি নিজের জমিতে উৎপাদন করেছেন ভারতের বিহার রাজ্যের এক কৃষক। এই সবজি চাষ করেছেন কৃষক অমরেশ সিং। তিনি বিশেষ প্রকারের সবজি এক লাখ রুপি কেজিতে বিক্রি করে দেশটিতে হইচই ফেলে দিয়েছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে বিশ্বের ব্যয়বহুল এই সবজির খবর দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আইএএসের নারী কর্মকর্তা সুপ্রিয় সাহু নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি সংবাদ ও হপ শুটসের ছবি টুইট করে লিখেছেন, ?'এই সবজির প্রতি কেজির দাম এক লাখ, ভারতীয় কৃষকদের জন্য গেম চেঞ্জার হতে পারে এই সবজি।' এনডিটিভি বলছে, বিহারের আওরঙ্গবাদ জেলার করমনিধ গ্রামের ৩৮ বছর বয়সি অমরেশ সিং ভারতে প্রথম কৃষক হিসেবে ওই সবজি চাষের ঝুঁকি নিয়েছেন। বারানসিতে অবস্থিত ভারতীয় সবজি গবেষণা কেন্দ্র থেকে এই সবজি সংগ্রহ করেন তিনি।
গবেষকরা বলছেন, যক্ষ্ণার প্রাকৃতিক প্রতিষেধক হিসেবেও হপস শুটসের সম্ভাবনা রয়েছে। সবজিটির অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট মানুষের ত্বকও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। উদ্বেগ, অনিদ্রা এবং হতাশা পশমনের জন্য পরিচিত হপস শুটস।
হপ শুটস সাধারণত শীতপ্রধান অঞ্চলে জন্মায় এবং সর্বোত্তম বৃদ্ধির জন্য অন্তত ৫ থেকে ৬ সপ্তাহ হিমায়িত তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে। তবে পাঠক জেনে অবাক হবেন যে, মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও কম তাপমাত্রায়ও হপ গাছ বেঁচে থাকতে পারে! সে কারণেই এ সবজির দাম আকাশচুম্বী।