রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে কাঁঠাল

আলতাব হোসেন
  ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে কাঁঠাল

জাতীয় ফল হিসেবে কাঁঠালকে চেনেন সবাই। কেউ আবার বলেন, গাছ পাঠা। নাম যাই হোক, উপকারিতা কিন্তু ঢের কাঁচা কাঁঠালের। এর উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। কাঁচা কাঁঠালকে নিরামিষ মাংস বলা হয়। বাঙালি বাড়িতে হরেক রকমভাবে খাওয়া হয়। কেউ পাঁচমিশালী সবজি দিয়ে রান্না করেন, কেউবা শুধু ডাল দিয়ে। আবার কাঁচা কাঁঠালের বার্গার কিংবা বিরিয়ানির মতো পদগুলোও মাঝেমধ্যে ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। স্বাদে অতুলনীয় এই সবজির গুণাগুণও কিন্তু কম নয়। রপ্তানি বাণিজ্যেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে কাঁঠাল।

কাঁঠাল স্বাস্থ্যকর খাবার। পাকা ও কাঁচা, কাঁঠাল দুইভাবেই খাওয়া যায়। অনেকেই কাঁঠালের এচোড় (কচি কাঁঠাল) ফ্রিজে জমিয়ে রেখে কয়েক মাস ধরে খেতে ভালোবাসেন। নানাভাবে তরকারি হিসেবে খাওয়া হয় কাঁঠাল। কাঁচা কাঁঠাল স্বাদে আর গুণে কম যায় না। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয় অনেক গুণ। এমনকি কাঁঠালের বিচিতেও আছে শকর্রা। এটি চাইলে খেতে পারবেন তরকারি, হালুয়া বা ভর্তা হিসেবে। কাঁঠালের বিচি গুঁড়া করে সকালে জুস হিসেবে খেতে পারেন। কাঁঠালের বিচি ফেলনা নয়। এটি চাইলে খেতে পারবেন হালকা নাশতায়, সালাদ, তরকারি, হালুয়া বা ভর্তা হিসেবে। কাঁঠালের বিচিতে থাকা প্রোটিন মাংসপেশি গঠনে ভূমিকা রাখে।

দেশের রপ্তানির তালিকায় ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে পাকা কাঁঠাল ও কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত পণ্য। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনকারী ও বণিক সমিতির (বিএপিপিএমএ) অধীনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাঁঠাল থেকে তৈরি অসমোটিক ডিহাইড্রেটেড খাবার এবং কাঁঠালের বীজের পাউডার ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফুড চেইনে রপ্তানি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ টু আই প্রকল্পের মাধ্যমে জাতীয় ফলের ভৈলু্য সংযোজনের জন্য কাঁচা কাঁঠাল থেকে মাংসের বিকল্প চিপস প্রক্রিয়াকরণে বেসরকারি খাতকে জড়িত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে লাল মাংসের বিকল্প হিসেবে সিদ্ধ ও প্রক্রিয়াজাত কাঁচা কাঁঠালের খাবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। কাঁঠালে আছে অধিক পরিমাণে আমিষ, শকর্রা ও বিভিন্ন ভিটামিন- যা মানবদেহের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালে খাদ্য-আঁশ থাকে দুই গ্রাম, শকর্রা ২৪ গ্রাম, চর্বি দশমিক ৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৪ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ৩৭ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৩০৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ ২৯৭ আইইউ ও ভিটামিন-সি ৬ দশমিক ৭ মিলিগ্রাম। কাঁঠাল আপনার বয়স ধরে রাখতে সাহায্য করবে। মুখে বলিরেখা পড়তে বাধা দেয়। এটি ত্বকের জন্য ভালো। এর মধ্যকার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রোগ সৃষ্টিকারী মুক্ত উপাদানের বিরুদ্ধে লড়াই করে। প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম থাকায় হাড়ের ক্ষয় ঠেকাতে পারে কাঁঠাল। ভিটামিন এ, সি ও বি৬: কাঁঠালে আছে নানারকম ভিটামিন। কাঁঠাল বহুগুণসম্পন্ন। কাঁঠালে থাকা ভিটামিন 'এ'র কল্যাণে মাথার চুল ভালো থাকে, দৃষ্টিশক্তি বাড়ে ও চোখের সমস্যা কমে। এতে থাকা ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, অ্যাজমা, কাশি, সর্দি ও ক্যানসারের মতো রোগ দূর করে। এর ভিটামিন বি৬ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমায়।

কাঁঠালে কোনো কোলস্টেরল নেই বললেই চলে। তাই কাঁঠাল খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। যে কোনো বয়সের মানুষ এটা খেতে পারেন। এটি শক্তির ভালো উৎস। এতে আছে ভালো শকর্রা। নাশতা হিসেবে বা অন্য খাবারের বিকল্প হিসেবে কাঁঠাল খেতে পারেন। পেটের নানা রকম পীড়া থেকে মুক্তি দিতে পারে কাঁঠাল। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এবং অন্ত্রের নড়াচড়া বাড়াতে সাহায্য করে। এতে যে আঁশ থাকে, তা কোলন ক্যানসার প্রতিরোধ করে। পেটের অম্স্নতা ও আলসার ঠেকাতে কাঁঠাল খেতে পারেন। এতে চর্বির পরিমাণ খুব কম। তাই বেশি খেলেও ওজন বাড়ার শঙ্কা নেই। বরং পেট ভরে রেখে ওজন কমাতে সাহায্য করে কাঁঠাল।

গবেষকদের মতে, কাঁঠালের মতো পুষ্টিকর অন্য কোনো ফল নেই। কাঁঠাল থেকে কোনো কিছুই নষ্ট হয় না এবং পৃথিবীতে আর কোনো ফল বা ফসলের এমন বৈচিত্র্যময় ব্যবহার উপযোগিতা নেই। কৃষিবিজ্ঞানীরা কাঁঠালকে একটি অলৌকিক ফসল হিসেবে অভিহিত করেছেন- যা সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে অনাহার থেকেও বাঁচাতে পারে। যেহেতু দেশে বর্তমানে উৎপাদিত কাঁঠালের অর্ধেকই পাকার পর নষ্ট হয়ে যায় তাই এর ব্যবহারে পরিবর্তন আনা জরুরি। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, কাঁঠালের সংগ্রহোত্তর অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ। আর, এই বিশাল অপচয় রোধের সহজ উপায় হচ্ছে কাঁচা কাঁঠালের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্যব্যবস্থায় যুক্ত করা। সেই সঙ্গে কাঁচা ও পাকা কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করে তা দেশীয় ও দেশের বাইরের বাজারে সরবরাহ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।

দেশে ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদিত কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়াতে পারলে এ জাতীয় ফলটি দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। জাতীয় ফল হবে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরানোর একটি উপযুক্ত নিয়ামক। যেহেতু কাঁঠাল গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল যা ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জন্মে না। ফলে এর বিভিন্ন ধরনের ওষধিগুণ, প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজের উৎস সেই সঙ্গে এটির চাষে কোনো রাসায়নিক প্রয়োজন না হওয়ায় এই সমস্ত দেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ভারত তার বেশিরভাগ কাঁচা কাঁঠাল যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে রপ্তানি করা হয় এবং বিশ্বে কাঁচা কাঁঠালের অনেক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বে কাঁচা কাঁঠাল রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া ৪.১৭ বিলিয়ন ডলারের লাল মাংসের বিকল্প কাঁচা কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার দখল করেছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এর বাজার ৭.৫৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাজেই বিশ্বের দ্বিতীয় কাঁঠাল উৎপাদনকারী বাংলাদেশ এখানে একটি বড় বাজার দখল করতে পারে।

কাঁঠালের স্বাদ, গন্ধ ও রসালোতার দিক থেকে মাংসের সঙ্গে তুলনীয়। নিরামিষ খাদ্যের জন্য বিশ্বব্যাপী চাহিদা বাড়ছে এবং ভবিষ্যতে এই খাতে উলেস্নখযোগ্য রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি বছর দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে প্রায় ১০০০ টন পাকা কাঁঠাল রপ্তানি হচ্ছে। দেশের মাটিতে উৎপাদিত জাতীয় ফল কাঁঠালের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বছরজুড়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সেইসঙ্গে কাঁচা ও পাকা উভয় ধরনের কাঁঠালের সরাসরি এবং প্রক্রিয়াজাত কাঁঠাল পণ্য বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া জরুরি- যার মাধ্যমে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। দেশের সম্ভাবনাময় এই জাতীয় ফলকে নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য ব্যবস্থায় কাঁঠালের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের বাইরে কাঁচা ও পাকা কাঁঠাল এবং কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

দেশের প্রায় সব এলাকায় কম-বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয়। অঞ্চলগুলোর মধ্যে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, রাজশাহী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, যশোর, খুলনা, সুনামগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রামে উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ ও উন্নত মানের কাঁঠাল উৎপাদন হয়। ভরা মৌসুমে দেশের আনাচে-কানাচে, ভ্যানে-রিকশায়, অটোরিকশা-টেম্পোতে, ট্রাক ও রাস্তার মোড়ে এবং বাজারে ক্ষুদ্র চাষি, ব্যবসায়ী, আড়তদার, বেপারি ও পাইকারি বিক্রেতাদের স্তূপ করে রেখে বিক্রি করতে দেখা যায়। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে বছরে প্রায় ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়- যার অধিকাংশই উৎপাদন হয় ভারতে (১৮ লাখ টন)। এর পরের অবস্থানে বাংলাদেশ (১০ লাখ টন)। পুষ্টি বিবেচনায় চীন, জাপান, মালয়েশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করায় বিভিন্ন দেশ থেকে তা আমদানিও করছে। এক্ষেত্রে উন্নতমানের ও সুনির্দিষ্ট জাত উদ্ভাবন এবং সঠিক পরিপক্বতা নির্বাচনের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে- যা দেশের কৃষক ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করবে। উপমহাদেশে কাঁঠালের জাতের মধ্যে পরিচিত গালা, খাজা ও দোরসা বা রস খাজা। কাঁঠাল জনপ্রিয় এবং এর যথাযথ ব্যবহারের প্রয়াসে বিএআরআইয়ের তিনটি জাত যেমন- বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২ ও বারি কাঁঠাল-৩ উদ্ভাবন করেছে।

দেশে উৎপাদিত কাঁঠালের খুব অল্প পরিমাণ বিদেশে রপ্তানি হয় এবং এর ক্রেতা অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশি। ডিএইর তথ্যমতে, কাঁঠাল রপ্তানি আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে এবং তা আরো বাড়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। হবিগঞ্জের বড় ও ভালো মানের কাঁঠাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে দেশগুলোর মধ্যে কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট জাত নির্বাচন, প্যাকিং হাউস সুবিধাসহ যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে জাতীয় ফল কাঁঠাল দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব- যা কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি যেমন নিশ্চিত করবে, তেমনি অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সর্বোপরি খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা বিধানসহ দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে