পুষ্টি আর তৃপ্তিতে ভরপুর তরমুজ
প্রকাশ | ৩১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
নাহিদ বিন রফিক
তরমুজ রসালো ফল। এর পানির পরিমাণ শতকরা প্রায় ৯৬ ভাগ। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ফল হিসেবে স্থান পেলেও কেউ কেউ একে সবজির তালিকায় রাখেন। এর আকার-আকৃতি হরেক রকমের। কোনোটি গোল, কোনোটি লম্বাটে, আবার গোলও নয় লম্বাও নয়। বীজহীন তরমুজও রয়েছে। এছাড়া ত্বক এবং শাঁসের রঙে ভিন্নতা আছে। তবে শাঁসের রঙ বেশ আকর্ষণীয়। গ্রীষ্মের গরমে এক টুকরো তরমুজ খেলে দেহে দারুণ তৃপ্তি এনে দেয়। দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় এর চাষ হলেও পটুয়াখালী, ভোলা এবং যশোরের তরমুজ প্রসিদ্ধ। বাজারে বিভিন্ন জাতের তরমুজ পাওয়া যায়। এগুলোর অধিকাংশ হাইব্রিড জাত। এসব জাতের বীজ চীন, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ানসহ বেশ ক'টি দেশ থেকে আমদানি করা হয়। তরমুজ গ্রীষ্মকালীন ফসল হলেও অল্প পরিসরে বর্ষায়ও চাষ করা যায়। যথেষ্ট চাহিদা থাকায় এর বাজারমূল্য ভালো। তাই চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের।
চৈত্রের গরমে চড়া মূল্য, তার ওপরে আছে বাড়িতে এনে তরমুজ কেটে প্রত্যাশিত রং আর মিষ্টত্বের অভাবে হৃদয় ভাঙার আখ্যান। তবু দাবদাহের এই দিনে, বিশেষত সারা দিন রোজার পরে ইফতারে তরমুজের তুলনাই হয় না। লাল-সবুজের নয়নাভিরাম ও দর্শনধারী, তার ওপরে গুণ বিচারেও তরমুজ কোনো অংশে কম নয়। আদি যুগে দক্ষিণ আমেরিকায় বহুল প্রচলিত এই ফল এখন সারা দুনিয়াতেই ব্যাপক জনপ্রিয়।
১০০ গ্রাম তরমুজে মাত্র ৩০ ক্যালরি আছে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে ফিলার বা কম ক্যালরিতে পেট ভরাতে তরমুজের জুড়ি মেলা ভার। স্বাদে অতুলনীয় এই তরমুজে কোনো ধরনের ফ্যাট নেই; কার্বস আছে মাত্র ৭.৫ শতাংশ। তবে এই কার্বসে সামান্য পরিমাণে চিনি থাকে- যা সহজে রক্তে শোষিত হয়। তাই এতে তাৎক্ষণিক তৃপ্তি পাওয়া গেলেও ডায়াবেটিস রোগীদের তরমুজ খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। তরমুজের টুকটুকে লাল রঙের পেছনে যে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের ভূমিকা রয়েছে, তারই নাম লাইকোপেন। লাইকোপেন শরীরে ভিটামিন এ-এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে তরমুজ শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধের প্রবণতা কমিয়ে আনার ক্ষমতা রাখে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়। তাই এমনিতে গস্নাইসেমিক ইন্ডেক্স বেশি হলেও তরমুজ অন্যভাবে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য উপকারী। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যগুণ আর পুষ্টিমানের নিরিখে তরমুজ এক অনন্য ফল। স্বাদ, রং, রূপ- সব দিক থেকেই তরমুজকে এগিয়ে রাখা যায়। এমনিতে ফল হিসেবে তো বটেই, তরমুজ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন সালাদ, জুস বা শরবতও অত্যন্ত উপাদেয় ও তৃপ্তিদায়ক।
মৌসুমি ফল তরমুজ গরমে পানির চাহিদা মেটানোর জন্য উপযোগী। এতে থাকা নানান পুষ্টি ও খনিজ উপাদান মানবদেহ সতেজ রাখতে সাহায্য করে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি বিটা ক্যারটিন, ভিটামিন বি-১ এবং বি-২ পাওয়া যায়। যা গরমে শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। তরমুজ আয়রনের ভালো উৎস। ১০০ গ্রাম তরমুজে ৭.৯ মি.গ্রাম আয়রন থাকে। এছাড়া ৩.৩ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ০.২ গ্রাম প্রোটিন ও ১.১ মি.গ্রাম ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এছাড়াও ১ মি.গ্রাম ভিটামিন সি, ০.০২ মি.গ্রাম বি-১, ০.০৪ মি.গ্রাম বি-২ এবং ০.৩ মি.গ্রাম অন্যান্য খনিজ উপাদান থাকে। তরমুজে ফ্যাট বা চর্বি নেই বললেই চলে। তাই এটা খেলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও কোলেস্ট্রলের মাত্রা বৃদ্ধির ঝুঁকি কম থাকে।
গরমে জুস করে অথবা কেটে তরমুজ খাওয়া যায়, দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। জলীয় অংশ ও ভিটামিন থাকায় এটা শরীর ও ত্বক সুন্দর রাখতে সাহায্য করে। তাছাড়া ত্বকের যত্ন নিতে নানান রূপচর্চায়ও তরমুজ ব্যবহার করা যায়।
পুষ্টিগুণ: তরমুজ কেবল খেতেই সুস্বাদু নয়, পুষ্টিগুণও আছে যথেষ্ট। এর প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে (আহারোপযোগী) ৭.৯ মিলিগ্রাম লৌহ এবং ১১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে। অন্য পুষ্টি উপাদানের মধ্যে ৩ দশমিক ৩ গ্রাম শর্করা, ০ দশমিক ২ গ্রাম আমিষ, ০ দশমিক ২ গ্রাম চর্বি, ০ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন-বি২, ভিটামিন-সি ১ মিলিগ্রাম, ০ দশমিক ৩ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ০ দশমিক ২ গ্রাম আঁশ এবং খাদ্যশক্তি আছে ১৬ কিলোক্যালরি।
ভেষজগুণ: তরমুজে রয়েছে ভেষজগুণে ভরপুর। নিয়মিত তরমুজ খেলে কিডনির কার্যকারিতা বাড়ে। প্রস্রাবের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। তরমুজে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। সেই সঙ্গে আছে লাইকোপেন। এ ক্যানসা জন্য ফুসফুসের ক্যানসার, কোলনর, ব্রেস্ট ক্যানসার এবং প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। হার্ট ও লিভার ভালো রাখে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রক্তে অতিরিক্ত জমাটবাঁধা প্রতিরোধ করে। যক্ষ্ণা, পেটের আলসার, কোষ্ঠকাঠিন্য, অ্যাজমা, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, দাঁতের অ্যালার্জি, মুখে ঘা, টনসিল, ফোড়া, চোখওঠা, রাতকানা, জ্বর, সর্দি, হাঁচি-কাশি, কফসহ আরো অনেক রোগের জন্য উপকারি। তরমুজ প্রজননতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। রক্তবাহী ধমনিকে শীতল রাখে। অকাল বার্ধক্য প্রতিরোধ করে। সহসা চামড়ায় ভাঁজ পড়ে না। রূপচর্চায় তরমুজ অনন্য। এর রস ব্যবহারে ত্বকের ময়লা পরিষ্কার করে উজ্জ্বলতা বাড়ায়। চুল হয় সুন্দর, মোলায়েম। মুখে কোনো দাগ হলে তরমুজের টুকরো দিয়ে ঘষতে হবে। ব্রণ দূর করতে এর রস লাগিয়ে ১৫/২০ মিনিট পর কুসুম গরম পানিতে ধুয়ে ফেলতে হবে। এভাবে দু'সপ্তাহ নিয়মিত ব্যবহার করলে ব্রণ চলে যাবে। তাই আসুন, তরমুজ খেয়ে শরীরে পুষ্টি এনে দেই। রোগ প্রতিরোধে দেহকে রাখি সতেজ-তরতাজা।
জাত: এক সময় এ দেশে পতেঙ্গা এবং গোয়ালন্দ নামের দুইটি তরমুজের জাত চাষ হতো। এখন অধিকাংশ কৃষকরা হাইব্রিড জাত ব্যবহার করছেন। তরমুজের উন্নতমানের গ্রীষ্মকালীন জাতগুলো হচ্ছে- গ্রিন ড্রাগন, ওয়ার্ল্ড কুইন, চ্যাম্পিয়ন, টপ ইল্ড, সুগার অ্যাম্পায়ার, ওশান সুগার, বঙ্গ লিংক, ফিল্ড মাস্টার, গেস্নারি, সুইট বেবি, সুগার বেলে, বিগটপ, মিলন মধু, মোহিনী, ভিক্টর সুপার, অমৃত, মোহিনি, কানিয়া, আমরুদ, আধারি, এবং কঙ্গো। উপকূলীয় এলাকার জন্য পাটনাগরা ও মধু এফ ওয়ান। বর্ষাকালের জন্য জেসমিন-১, জেসমিন-২, জেসমিন-৩, বস্নাক বক্স, বস্নাক বেবী, বস্নাক প্রিন্স অন্যতম। এছাড়া রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত জাত বারি তরমুজ-১ এবং বারি তরমুজ-২।
চাষপদ্ধতি: গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষের উপযুক্ত সময় ফেব্রম্নয়ারি থেকে এপ্রিল মাস। তবে বীজবপনের কাজ ফেব্রম্নয়ারির প্রথম দিকেই যেন হয়। আগাম ফসলের জন্য জানুয়ারি মাসের মধ্যে বপনকাজ সেরে ফেলা উচিত। বপনের আগে বীজ শোধন করে নিলে ভালো হয়। এর মাধ্যমে বীজবাহিত রোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করা সম্ভব। এজন্য কেজিপ্রতি ২.৫ গ্রাম হারে প্রোভেক্স অথবা ভিটাভেক্স কিংবা অটোস্টিন বীজের সঙ্গে ভালোভাবে ঝাকিয়ে শোধন করতে হবে। তরমুজের বীজ মাদায় সরাসরি লাগানো যায়। তবে চারা তৈরি করে রোপণ করা উত্তম। মাদায় ৩/৪ টি বীজবপন করা ভালো। আর চারা তৈরির ক্ষেত্রে ১টি বীজ ব্যবহার করতে হবে। পলিথিন ব্যাগে গোবর এবং বালি সমান অনুপাতে ভর্তি করে বীজ লাগাতে হয়। পলিব্যাগের তলদেশে অবশ্যই ২/৩ টি ছিদ্র থাকা দরকার। চারার বয়স ১ মাস (৫-৬ পাতা বিশিষ্ট) হলে মাদায় রোপণের উপযুক্ত হয়। বেডের প্রশস্ত ২ মিটার আর দৈর্ঘ্য হবে জমি অনুযায়ী। মাদা থেকে মাদার দূরত্ব ২ মিটার। দুই মাদার মাঝে ৩০ সেন্টিমিটার নালা থাকা চাই। মাদার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা হবে ৫০ সেন্টিমিটার করে। তরমুজের আশানুরূপ ফলন পেতে জমিতে সুষম সার ব্যবহার করতে হয়। এজন্য পরিমাণমত জৈব এবং অজৈব সার দিতে হবে। আর রোগপোকার প্রতিকার হিসেবে নিতে হবে দ্রম্নত ব্যবস্থা।
বিশেষ পরিচর্যা: অন্যান্য লতানো উদ্ভিদের মতো তরমুজগাছে অনেক শাখা-প্রশাখা বের হয়। তাই ফলের সংখ্যা এবং গুণগতমান বজায় রাখতে গাছপ্রতি ৩/৪ টি শাখা রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলতে হবে। প্রতিটি শাখায় একটির বেশি ফল না রাখা উত্তম। ফলের ওজন ৫০০-৬০০ গ্রামের মতো হলে এর নিচে অবশ্যই খড় কিংবা পস্নাস্টিকের শিট বিছিয়ে দিতে হবে। আবার পরিপক্ব হওয়ার ১০-১২ দিন আগে ফলটি খুব সাবধানে উল্টিয়ে দিতে হবে। এমন ব্যবস্থা করলে পুরো তরমুজ একই রঙ ধারণ করবে। নইলে যে অংশটি মাটির সঙ্গে লেগে থাকবে, সে অংশটুকু সাদাটে হয়ে যাবে। এতে বাজারমূল্য কমে যাবে।
ফসল সংগ্রহ এবং ফলন: তরমুজের পরিপক্বতা এর জাত এবং আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। আর তা জাতভেদে ৮০-১১০ দিন সময় লাগে। তবে ফল পেকেছে কিনা তা কিছু লক্ষণ দেখে অনুমান করা যায়; যেমন: তরমুজের যে অংশ মাটির সঙ্গে লেগেছিল তা যদি হলুদ রঙ ধারণ করবে, ফলের বোঁটার সঙ্গে থাকা আকর্ষী বাদামি রঙে পরিণত হয়, আঙুল দিয়ে টোকা দিলে ড্যাব ড্যাব শব্দের মতো মনে হবে, এমন হলে বুঝতে হবে ফল পরিপক্ব হয়েছে। তখন মাঠ থেকে ফল সংগ্রহ করতে হবে। হেক্টরপ্রতি তরমুজের ফলন ৫০-৭০ টন।
নাহিদ বিন রফিক: কর্মকর্তা, কৃষি তথ্য সার্ভিস ও পরিচালক, কৃষি বিষয়ক আঞ্চলিক অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ বেতার, বরিশাল।