বাংলাদেশের নয়া ফসল হিসেবে খুবই লাভজনক হতে পারে কাসাভা। রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় ফসলটি চাষাবাদে বেশ সুফল মিলছে। মূলত কাসাভা উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের আলুজাতীয় ফসল। পৃথিবীর প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে কাসাভা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। গ্রামের মানুষ কাসাভার কন্দকে 'শিমুল আলু' বলে। গাছটির পাতা অনেকটা শিমুল গাছের মতো দেখতে বলেই হয়তো এরকম নামকরণ। রোগজীবাণু ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধ এ ফসল সহজেই অনুর্বর জমি ও খরা প্রবণ এলাকায় চাষ করা যায়।
কাসাভা নতুন কোনো ফসল নয়। বাংলাদেশে কাসাভা শিমুল আলু নামে পরিচিত। কেউ কেউ আবার একে কাঠ আলু বলেও জানে। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক আগে থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে কাসাভার চাষাবাদ হয়ে আসছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ফিলিপাইন থেকে আগত দুটি জাতের কাসাভা চাষ হতে দেখা যাচ্ছে যার একটি লাল; অপরটি সাদাটে। কাসাভার বংশবিস্তার সাধারণত স্ট্যাম কাটিংয়ের মাধ্যমে করা হয়। এর চারা রোপণের ৬ মাস পর থেকে টিউবার সংগ্রহ করা যায় এবং খুব সীমিত পরিচর্যায় সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টন কাসাভা উৎপাদন সম্ভব। খাদ্য হিসেবে কাসাভার পরিষ্কার টিউবার সরাসরি বা সিদ্ধ করে, এমন কি কাঁচাও খাওয়া যায়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কাসাভায় বিদ্যমান ফাইবার দৈহিক ওজন ও দৈনন্দিন খাদ্যগ্রহণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিস এবং স্থূলতা বা মেদ তৈরির বিরুদ্ধে কাজ করে। এ গবেষণার প্রধান গবেষক সহযোগী প্রফেসর ডক্টর চয়ন গোস্বামী জানান, কাসাভা একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল। এটি থেকে খুব সহজে ও কম খরচে খাদ্য উপাদান স্টার্চ পাওয়া সম্ভব- যা খাদ্য শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পের সহজলভ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এর ফাইবার খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করলে রক্তের গস্নকোজ নিয়ন্ত্রণসহ নানাবিধ উপকার পাওয়া যেতে পারে।
উচ্চ শকর্রাসমৃদ্ধ কন্দ জাতীয় ফসল কাসাভা থেকে যে উন্নতমানের স্টার্চ পাওয়া যায়; তা দিয়ে গস্নুকোজ, বার্লি, সুজি, রুটি, নুডলস, ক্ল্যাকার্স, কেক, পাউরুটি, বিস্কুট, পাঁপড়, চিপসসহ নানাবিধ খাদ্য তৈরি করা যায়। এ ছাড়াও বস্ত্র এবং ওষুধ শিল্পে ব্যাপকভাবে কাসাভার স্টার্চ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কাসাভা চাষে নেই কোনো ঝামেলা; পাওয়া যায় অল্প পরিশ্রমে অধিক ফসল। দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় কাসাভা হয়ে উঠতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। ওষুধশিল্পে ব্যাপকভাবে কাসাভার প্রয়োজন হয়, এ কারণে বিভিন্ন কোম্পানি একেবারে গ্রাম পর্যায়ে এসে কৃষকদের উৎপাদিত কাসাভা তারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে এবং কৃষক উৎপাদিত কাসাভা কোম্পানির কাছে পৌঁছে দিতে পারছে। তাদের পরিবহণ খরচ একবারে নেই বললেই চলে। কৃষকের কিন্তু এ থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কাসাভার কিন্তু বিদেশেও প্রচুর চাহিদা রয়েছে, সেক্ষেত্রে আমারা যদি দেশে উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারি তাহলে বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করতে পারব। দেশের কৃষকরা লাভবান হতে পারবে।
কাসাভায় সাধারণভাবে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ শকরা, ১ থেকে ২ ভাগ প্রোটিন, এবং ৫৫-৬০ ভাগ জলীয় অংশ বিদ্যমান। আলুর তুলনায় কাসাভাতে দ্বিগুণেও বেশি শকরা থাকায় এতে আলুর চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিকর। যেখানে আলুতে ১৮ ভাগ শকরার মাত্র ১৬.৩ ভাগ স্টার্চ হিসেবে থাকে সেখানে কাসাভার ৪০ ভাগ শকর্রার ৯০ ভাগ থাকে। এছাড়াও কাসাভাতে ক্রুড ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও ভিটামিন সি উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে পাওয়া যায়। কাসাভার অনেক প্রচলিত ও উন্নত জাত রয়েছে। কৃষকরা খাবার ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে জাত নির্বাচন করে থাকে। খাবারের জন্য অনেক অঞ্চলে মিষ্টি জাতের কাসাভা চাষ করা হয়। ভারতে কাসাভার জনপ্রিয় হাইব্রিড জাতগুলো হলো গ-৪, ঐ-৯৭, ঐ-১৬৫, ঐ-২২৬, ঐ-১৬৮৭, ঐ-২৩০৪ ও ঝ-৮৫৬। ইন্দোনেশিয়ায় অউওজঅ-১,২,৩,৪ থাইল্যান্ডে জঅণঙঘএ-১,২,৩,৬০ ফিলিপাইনে চজ-ঈ ১৩,২৪,৬২ এবং চীনে ঝঈ-২০১,২০৫,১২৪ জাতগুলো জনপ্রিয়। নাইজেরিয়ায় ঞগঝ-৩০০১, ৩০৫৭২, ৫০৩৯৫, ৩০৫৫৫ এবং কলম্বিয়ায় গ.ঈড়ষ.-২২১৫, ১৬৮৪, গ.ইজঅ-৫, ১২ জাতগুলো উলেস্নখযোগ্য।
মাটি উষ্ণ ও নাতিষিতোষ্ণ অঞ্চল কাসাভা চাষের জন্য উপযোগী। অনুবর পাহাড়ি মাটি কিংবা বালি মাটি যেখানে অন্য কোনো ফসল ফলানো যায় না সেখানেও কাসাভা চাষ করা যায়। এটি একটি খরা সহনশীল ফসল। যেখানে ৬ মাস পর্যন্ত খরা বা শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করে সেখানেও কাসাভা সহজে চাষ করা যায়। তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রির সেন্টিগ্রেডের নিচে কাসাভা ভালো হয় না। উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ২৩০০ মিটার উপরেও কাসাভা চাষ করা যায়। গাছ লাগানোর জন্য বীজ কিংবা কাটিং উভয়ই ব্যবহার করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য পরিপক্ব কান্ডের কাটিং ব্যবহার করা হয়। কাসাভা সংগ্রহের সময় সুস্থ্য সবল ও রোগমুক্ত কান্ডগুলো কেটে পরবর্তী বছর লাগানোর জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। লাগানোর সময় কান্ডকে ১৫-২০ সেমি. করে কেটে সোজা করে লাগাতে হবে। প্রতিটি কাটিং এ কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ টা নোড থাকতে হবে।
সাধারণত জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য জমি চাষ করা যেতে পারে। পাহাড়ি এলাকায় কাসাভা চাষ সহজ ও সুবিধাজনক পদ্ধতি। তবে পিটগুলো মাটি থেকে একটু উপরের দিকে উঠানো হলে ফলন ভালো পাওয়া যায়। প্রতি হেক্টর জমিতে ১০ হাজার গাছ লাগানো যায়। একটি গাছ থেকে অন্য গাছের দূরুত্ব ৭৫ থেকে ৯০ সেমি রাখতে হবে। কাটিং মাটিতে লাগানোর সময় ২০ সেমি মাটির নিচে এবং ৫ সেমি মাটির উপরে থাকতে হবে। সাধারণত ১৫-২০ দিনের মধ্যে কাটিং থেকে নতুন কুশি বের হয়। যেসব কাটিং থেকে কুশি বের হবে না সেগুলো তুলে ফেলে সেখানে ৪০ সেমি আকারের নতুন কাটিং লাগাতে হবে।
সারা বছরই গাছ লাগানো যায়। তবে সাধারণত বর্ষার শুরুতে কাসাভার কাটিং লাগানো ভালো। আমাদের দেশে রূপ্রল থেকে মে মাস কাসাভা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। তেমন কোনো সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য হেক্টর প্রতি ১৮০-২০০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৫-২২ কেজি ফসফরাস এবং ১৪০-১৬০ কেজি পটাশিয়াম প্রয়োগ করলে সর্বাধিক ফলন পাওয়া যায়। সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে কাটিং লাগানোর পর গাছ গজানোর জন্য ৩-৫ দিন অন্তর অন্তর কমপক্ষে ২ বার সেচ দিতে হবে। দীর্ঘদিন খরা অবস্থা বিরাজ করলে হালকা সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এতে ফলন বৃদ্ধি পায়।
গাছ লাগানোর পর এক মাস অন্তর অন্তর গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করে গোড়ায় মাটি তুলে দিলে ফলন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। যদিও কাসাভায় রোগবালাই ও পোকামকড়ের আক্রমণ খুবই কম তথাপিও এক ধরনের মাকড়ের আক্রমণে অনেক সময় ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে। সব সময় রোগবালাই ও পোকামাকড় মুক্ত কাটিং লাগাতে হবে এবং মাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হলে আক্রমণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে। অনেক সময় ইঁদুর মাটির নিচের কাসাভা খেয়ে বেশ ক্ষতি সাধন করে থাকে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ও বিষটোপ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করতে হবে।
সাধারণত হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ টন ফলন পাওয়া যায়। তবে ভালো ব্যবস্থাপনায় উন্নত জাত চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৫৫ থেকে ৬০ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। গুদামজাতকরণের সীমাবদ্ধতা কাসাভা উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। শরীরবৃত্তিয় ও অনুজীবীয় পরিবর্তন এবং বিভিন্ন প্রকার ছত্রাকের আক্রমণের কারণে দ্রম্নত পচনশীল কাসাভা সাধারণত গুদামজাত করে সংরক্ষণ করা যায় না। তবে উত্তোলন না করে গাছসহ মাটির নিচে রেখে দিলে কাসাভা নষ্ট হয় না। এজন্য কৃষককে তার প্রয়োজনমতো জমি থেকে কাসাভা সংগ্রহ করতে হবে এবং সংগ্রহের কয়েকদিনের ভেতরই ব্যবহার কিংবা প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। আফ্রিকাতে কৃষকরা তাদের প্রয়োজন মতো ধীরে ধীরে জমি থেকে কাসাভা সংগ্রহ করে। অথবা কাসাভা সংগ্রহের পর টুকরো টুকরো করে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে থাকে। স্টার্চ উৎপাদনের জন্য কাসাভা সংগ্রহের কয়েকদিনের ভেতরই কারখানায় প্রেরণ করতে হয়। তবে আদ্র বালি কিংবা আদ্র কাঠের গুড়ার উপর কাসাভা রেখে দিয়ে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ০.৪% থায়োবেনডাজল দ্বারা কাসাভা আলু শোধন করে পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষণ করলে কাসাভা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকে।
ক্রান্তিমন্ডলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের কাছে কাসাভা মৌলিক খাদ্যের মধ্যে পড়ে কাসাভা। জার্মানির বার্লিন শহরেও কাসাভার ভক্তের সংখ্যা কম নয়। পাহাড়ি জনপদে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কাসাভা আলুর চাষ। কাসাভা আলু স্থানীয়ভাবে শিমলা আলু নামে বেশ পরিচিত। ৬ থেকে ৭ ফুট উঁচু গাছের গোড়ায় মাটির নিচে উৎপাদিত এই আবাদে অনেকটাই খরচ কম হয়। ফলে পরিত্যক্ত জমি এবং পাহাড়ের ঢালে কাসাভা আলু (শিমলা আলু) আবাদ করা হচ্ছে। তাছাড়া বাজারেও এর চাহিদা অনেক ভালো। এ জাতীয় আলু পুষ্টি চাহিদাও মেটায়। এতে প্রচুর শকরা রয়েছে। শিমলা আলু সিদ্ধ করে খাওয়া যায় এবং সবজি হিসেবেও রান্না করে খাওয়া যায়। এগুলো খুবই পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। ফলে পাহাড়ি জনপদের পরিত্যক্ত টিলা ভূমিতে দিন দিন কাসাভা আলু চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে চাষিরা। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার পাহাড়ি জনপদের বড়নাল এলাকায় শতাধিক কৃষক শিমলা আলু তোলা ও সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাদের সঙ্গে আলাপকালে শিমুল আলু চাষি আব্দুর রহিম বলেন, গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয়দের কাছ থেকে অনাবাদি ৭০০ একর জায়গা লিজ নিয়ে শিমুল আলুর চারা লাগাই। চারা গজানোর পর ৩ মাস অন্তর গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করে গোড়ায় মাটি তুলে দিলে ফলন বৃদ্ধি পায়। প্রতি টন ১০ হাজার টাকা করে প্রাণ ও রহমান কোম্পানির কাছে বিক্রি করি। কুমিলস্না, নেত্রকোনা ও পার্বত্য অঞ্চলসহ কিছু এলাকায় কাসাভা নামক ফসলের চাষ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য হিসেবে খুব বড় বাজার তৈরির সম্ভাবনা কম থাকলেও শিল্প খাতে এর ব্যাপক ব্যবহারের সম্ভাবনায় ক্রমশ বাড়ছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শমসের আলী বলেন, খাদ্যের চেয়ে শিল্পে এর ব্যবহার হয় বেশি। বিশেষ করে বস্ত্র ও ওষুধশিল্পের জন্য কাসাভা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।