ভাতের পর দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু
নীরবে ঘটে গেছে আলুর বিপস্নব রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১১ দেশে
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ ২০২৩ সালের উৎপাদন পর্যালোচনার তথ্য অনুযায়ী, আলু উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে চীন। দেশটিতে ৯ কোটি ৪৩ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়। এছাড়া ভারত ৫ কোটি ৪২ লাখ ৩০ হাজার টন ও ইউক্রেন ২ কোটি ১৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩২০ টন উৎপাদন করে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ১ কোটি ৮৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৭০ টন, রাশিয়া ১ কোটি ৮২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৩৫ টন ও জার্মানি ১ কোটি ১৩ লাখ ১২ হাজার ১০০ টন আলু উৎপাদন করে। সপ্তম অবস্থানে বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স, পোল্যান্ড ও মিশর উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে অষ্টম, নবম ও দশম অবস্থানে রয়েছে
প্রকাশ | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু। কৃষি বিজ্ঞানীদের অদম্য প্রচেষ্টা ও চাষিদের পরিশ্রম আর কৃষি বিভাগের অনুকূল সহায়তায় বাংলাদেশে নীরবে ঘটে গেছে আলুর বিপস্নব। গত ৫০ বছরে আলুর উৎপাদন বেড়েছে ৩০ গুণ। আর মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে দশগুণ। ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য ও খাদ্যশক্তির উৎস হচ্ছে আলু। আলু উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য থেকে এটি এখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশে উৎপাদিত আলু দেশের চাহিদা পূরণ করে বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের ১১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আলু হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে বাংলাদেশের খাদ্যশক্তির দ্বিতীয় প্রধান উৎস আলু। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি করে আলু খায়- যা ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। আলু খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলেও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ভর্তা-ভাজি আর তরকারির গন্ডি ছাড়িয়ে আলু এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পটেটো চিপস বা পটেটো ফ্লেক্স হিসেবে প্যাকেটজাত হয়ে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। গত এক যুগে দেশে ৫০টিরও বেশি আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছ। এর মধ্যে অন্তত আটটি কোম্পানি আলু থেকে উৎপাদিত চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিদেশে রপ্তানি করছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ আলুর উৎপাদন বিষয়ক পরিসংখ্যান বলছে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের ওপরে আছে চীন, ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, বছরে দেড় কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদন হচ্ছে। দেশে আলুর চাহিদা সব্বোর্চ ৮৫ হাজার টন।
গত এক যুগে দেশের বিজ্ঞানীরা প্রায় ৭০টি আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। মূলত ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে আলু উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। ইউরোপে যেখানে আলুর সঠিক ফলন পেতে পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগে, সেখানে বাংলাদেশে আলু পেতে তিন মাস লাগে। এখানকার মাটি, পানি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যাওয়ায় আলুর উৎপাদন সময়কাল কমেছে।
আশির দশকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা নেদারল্যান্ডসের জাতগুলোকে উন্নত করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করার প্রচেষ্টা শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আলুর জাত নিয়ে কৃষকরা আবাদ শুরু করেন। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা ছাড়া দেশের সব স্থানেই আলুর চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলু ফলে মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর অঞ্চলে।
এদিকে, শিল্পকারখানায় ব্যবহার উপযোগী এবং বিদেশে রপ্তানির উদ্দেশ্যে উন্নত জাতের আলু উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) উদ্যোগে কিশোরগঞ্জের চরাঞ্চলে শুরু হয়েছে বিদেশে রপ্তানি উপযোগী উন্নত জাতের আলু চাষ।
খাবার তালিকায় ভাতের পরেই আলুর অবস্থান। আলু বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খাদ্যশস্য- যার পূর্বে রয়েছ ভুট্টা, গম ও চাল। ফলে দেশে ও বিদেশে আলুর চাহিদাও বাড়ছে। আলু হয়ে ওঠতে পারে রপ্তানির একটি বড় খাত। দেশে রপ্তানি ও শিল্পে ব্যবহারযোগ্য এবং আগাম জাতের আলুর আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। রপ্তানিযোগ্য জাতগুলো মাঠ পর্যায়ে দ্রম্নত সম্প্র্রসারণ করতে কাজ চলছে। আলু রপ্তানিতে শুল্ক কমানোর চিন্তা ভাবনা করছে সরকার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের প্রণোদনা ও কৃষি গবেষকদের চেষ্টায় বাংলাদেশ এখন আলুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রতি বছরই আলু রপ্তানি হচ্ছে। আলু এখন কৃষকের মাঠে-ওঠানে গড়াগড়ি খায়। আলু উৎপাদন বাড়াতে সারে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। তিনি আরো বলেন, ইউরোপে আলুর ফলন পেতে পাঁচ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময় প্রয়োজন হয়। সেখানে বাংলাদেশে তিন মাসেই আলু উৎপাদন হয়। কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রায় ১০০টি উচ্চফলনশীল আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। আলুর আদিজাত হচ্ছে মিষ্টি আলু। আর গোলআলর আদিজাত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। পরবর্তী সময়ে তা পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও নাবিকদের হাত ধরে ইউরোপে আলুর চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০০ বছর আগে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলায় প্রথম আলুর আবাদ শুরু হয়।
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আলু ভর্তার গন্ডি থেকে বেরিয়ে এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিপস হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে আলু। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি করে আলু খায়। যা ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। আলু খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও। এতে বাংলাদেশের মানুষের ভিটামিন ও কার্বোহাইড্রেটের চাহিদার অনেকাংশ পূরণ করছে। বর্তমানে দেশে আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য যেমন চিপস, ফ্লেক্স, অন্যান্য খাদ্য ও পণ্য উৎপাদন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্যাটালিস্টের হিসাবে দেশে অন্তত ৩০টি আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেক কোম্পানি আলু থেকে উৎপাদিত চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রপ্তানি করছে।
আলু রপ্তানিতে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে আলুর উৎপাদন বছরে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দেড় কোটি টন ছাড়িয়েছে। আলুর বার্ষিক অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রায় ৮৫ লাখ টনের মতো। সে হিসাবে দেশে প্রায় ৬০ লাখ টন আলু অতিরিক্ত থাকছে। রপ্তানি উপযোগী আলু উৎপাদনে উন্নতমানের বীজের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ থেকে স্থায়ীভাবে বৃহৎ পরিসরে আলু রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।
আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ আর এশিয়ায় তৃতীয়। দেশের প্রধান খাদ্যপণ্যের মধ্যে আলু একমাত্র উদ্বৃত্ত ফসল। এছাড়া চাল, গম, তেল, ডাল ও ভুট্টাসহ প্রায় সব খাদ্যশস্যই কমবেশি আমদানি করতে হয়। দেশে চাহিদার চেয়ে বছরে প্রায় ২০-২৫ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হয়। তবে রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে পেছনের দিকে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ ২০২৩ সালের উৎপাদন পর্যালোচনার তথ্য অনুযায়ী, আলু উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে চীন। দেশটিতে ৯ কোটি ৪৩ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়। এছাড়া ভারত ৫ কোটি ৪২ লাখ ৩০ হাজার টন ও ইউক্রেন ২ কোটি ১৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩২০ টন উৎপাদন করে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ১ কোটি ৮৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৭০ টন, রাশিয়া ১ কোটি ৮২ লাখ ৯৫ হাজার ৫৩৫ টন ও জার্মানি ১ কোটি ১৩ লাখ ১২ হাজার ১০০ টন আলু উৎপাদন করে। সপ্তম অবস্থানে বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স, পোল্যান্ড ও মিশর উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে অষ্টম, নবম ও দশম অবস্থানে রয়েছে।
এদিকে পাকিস্তানের উৎপাদন বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক। ৫৮ লাখ ৭২ হাজার ৯৬০ টন আলু উৎপাদন করে দেশটি। তবে রপ্তানিতে দেশটি বিশ্বে দশম অবস্থানে রয়েছে। দি অবজারভেটরি অব ইকোনমিকস কমপেস্নক্সিটির (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, আলু রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মিশর। দেশগুলো যথাক্রমে বিশ্বের মোট রপ্তানির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৪ দশমিক ৮, ১০, ৬ দশমিক ২৯, ৫ দশমিক ৮৯ ও ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ রপ্তানি করে। এছাড়া এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীন ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ, পাকিস্তান ৩ দশমিক শূন্য ৬, ভারত ২ দশমিক ৪৬, ইসরায়েল ১ দশমিক ৯৯, সাইপ্রাস ১ দশমিক ৩২, ইরান ১ দশমিক ১৮ ও তুরস্ক ১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ রপ্তানি করে। অন্যদিকে, রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে মোট রপ্তানি হওয়া আলুর মাত্র দশমিক ৩১ শতাংশ রপ্তানি করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের আলু রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার মালয়েশিয়া। প্রায় ৫২ শতাংশই এ দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া শ্রীলংকা, নেপাল, সিঙ্গাপুর ও আরব আমিরাতেও রপ্তানি হয়।
ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশক্তির উৎস আলু। অন্য যে কোনো শস্যের চেয়ে আলুর ফলনও বেশি হয়। আলুতে ভিটামিন 'এ', 'বি' ও 'সি' আছে। এ ছাড়া আলুর খোসায় আছে ভিটামিন 'এ', পটাশিয়াম, আয়রন, অ্যান্টি-অক্সাইড, ফাইবারসহ আলু থেকে আমরা প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট পাই। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা কেন্দ্রের (ইফ্রি) এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন বলছে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আলু উৎপাদনে নীরব বিপস্নব ঘটেছে। উৎপাদন বেড়েছে ২৬ গুণ। মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ২৩ কেজি আলু খায়- যা ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। সিঙ্গাপুর বছরে দুই লাখ টন এবং শ্রীলংকা বছরে ১ দশমিক ৫ লাখ টন আলু আমদানি করে। তাই রপ্তানিতে অপ্রচলিত পণ্যের তালিকায় আলুকেও সংযোজন করার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া এসব দেশের আলুরবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের আলুবাজার প্রায় সম্পূর্ণ ভারতের নিয়ন্ত্রণে। চলতি মৌসুমে দেশে ৪ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদের মাধ্যমে ৯০ লাখ টন গোলআল উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, গোলআলু উৎপাদনে এখনো বড় বাধা উন্নত বীজ ও এর আবাদ প্রযুক্তি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-বারির বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন মাঠপর্যায়ে কৃষকের কাছে উন্নত জাতের বীজ ও এর আবাদ প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করা গেলে দেশে আলুর উৎপাদন আগামী পাঁচ বছরে ২ কোটি টন অতিক্রম সম্ভব। তাদের মতে, উন্নত বীজ এবং পরিমিত জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহারসহ সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশে হেক্টরপ্রতি ৩০-৪০ টন পর্যন্ত গোলআলু উৎপাদন সম্ভব বলে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, গোলআলুর উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। পরবর্তী সময়ে তা পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও নাবিকদের হাত ধরে ইউরোপে আসে। বাংলাদেশে ২০০ বছর আগে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলায় আলুর আবাদ শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট নিরসনকল্পে মানুষের খাদ্য হিসেবে আলুর কদর বেড়ে যায়। গোলআলু এবং মিষ্টিআলু দুটোই যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর খাদ্য সংকট মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে আলুর আদি নিবাস পেরুতে হলেও ১৫৭০ সালে এর বিস্তার ঘটে স্পেনে। ১৬০০ সালে আলুর আবাদ ছড়িয়ে পড়ে ইতালি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানিসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। ১৭৯৫ সালে ইংল্যান্ডের কৃষিবিভাগ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে- যার শিরোনাম ছিল 'আলু ভালোবাসুন, আলুর ব্যবহার বৃদ্ধি করুন। সিদ্ধ আলুতে মোট যে পরিমাণ খনিজ পদার্থ থাকে তা সমপরিমাণ রুটি বা ভাতের চেয়ে অনেক বেশি। খোসাসহ আলু সিদ্ধ করে খাওয়া হলে ভিটামিন 'সি' অপচয় কম হয়। দামে যেমন সস্তা, ব্যবহার বৈচিত্র্যেও আলু তুলনাহীন। সিদ্ধ আলু, আলু ভাত, আলু খিঁচুড়ি, আলু চাপাতি, চপ, চটপটি, লুচি, শিঙাড়া, দম, আলু সবজি, আলু পায়েস, হালুয়া ইত্যাদি নানাবিধ উপাদেয় খাদ্য তেরি করা যায়। আর ব্যস্ত নাগরিক জীবনে আলুর জনপ্রিয় পদ চিপস ও ফ্রেঞ্জ ফ্রাই।
বিশ্বে কয়েকশ জাতের আলু চাষ হয়। এগুলোর পার্থক্য বাহ্যিকরূপ, কন্দের গঠন, আকার ও বর্ণ, পরিপক্বতার সময়, রান্না ও বাজারজাতকরণ গুণাবলি, ফলন এবং রোগ ও পোকা-মাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতায়। এটি এলাকার জন্য উপযোগী একটি জাত অন্য এলাকায় উপযোগী নাও হতে পারে। বাংলাদেশে চাষকৃত আলুর জাতগুলোকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়, যেমনথ স্থানীয় ও উচ্চফলনশীল (উফশী)। দেশের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় আলুর প্রায় ২৭টি জাত আবাদ করা হয়। এগুলোর পরিচিত স্থানীয় নাম রয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, পরিচিত স্থানীয় জাতগুলো হচ্ছে (ক) শীলবিলাতি- যা প্রধানত রংপুরে চাষ করা হয়। এর কন্দ আয়তাকার ও লালচে। প্রতি কন্দের ওজন প্রায় ৩০ গ্রাম। (খ) লালশীলথ প্রধানত বগুড়ায় চাষ করা হয়। এর কন্দ গোলাকৃতির, লালচে, প্রত্যেকটির ওজন হয় প্রায় ৫৫ গ্রাম। এ জাতটি লালমাদ্যা বা বোগরাই নামেও পরিচিত। (গ) লালপাকরীথ দিনাজপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়- যার কন্দ লালচে, গোলাকার, প্রত্যেকটির ওজন প্রায় ৩০ গ্রাম। (ঘ) দোহাজারী- প্রধানত চট্টগ্রাম এলাকায় চাষ হয়। দেখতে গোলাকার ও ফ্যাকাসে, প্রত্যেকটির ওজন প্রায় ২৫ গ্রাম। অন্যান্য দেশি জাতগুলোর মধ্যে ঝাউবিলাতি ও সূর্যমুখী উলেস্নখযোগ্য। উলেস্নখযোগ্য অন্যান্য উন্নত জাতগুলোর মধ্যে আছে- পেট্রোনিস, মুলটা, হীরা, মরিন, ওরিগো, আইলসা, গ্রানুলা, ফেলসিনা, রাজা, ডুরা, অ্যাস্টারিক্স প্রভৃতি।
আলু উৎপাদনের এ সাফল্যের মূল কারিগর কৃষকই। মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, নাটোর, নওগাঁ, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নীলফামারী, রংপুরের বদরগঞ্জ, পঞ্চগড়, যশোর, বগুড়া, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ ও লালমনিরহাট জেলায় প্রায় প্রতি বছর আলুর বাম্পার ফলন হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪০টি জাতের উন্নত আলুর চাষাবাদ হচ্ছে কৃষকপর্যায়ে। উচ্চফলনশীল জাতের আলুবীজ সম্প্রসারিত হয়েছে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি আবাদি এলাকায়। এক দশক আগেও উৎপাদন ছিল ৫০ হাজার টনের নিচে। এখন তা এগোচ্ছে দুই কোটি টনের দিকে। সরকারও আলুর উৎপাদন বাড়াতে নানাভাবে উৎসাহিত করেছে- কৃষককে দেয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তা।