আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে দেশের কৃষি খাতে এসেছে বৈপস্নবিক পরিবর্তন। এসব যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কয়েকগুণ বেড়েছে উৎপাদন। আধুনিক প্রযুক্তির ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার, জমি আবাদ, নিড়ানি হতে শুরু করে জমিতে সেচ দিতে ইঞ্জিনচালিত শ্যালো মেশিন ও বৈদু্যতিক পাম্প, ড্রাম সিডার (বীজ বপন যন্ত্র), ধান কাটার কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন, পাওয়ার থ্রেসার (পায়ে চালিত মাড়াই যন্ত্র), গ্রেডিং মেশিন, গুটি ইউরিয়া সারসহ সবকিছুতেই চলছে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার। এসব যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কৃষকের কমেছে শ্রম ও উৎপাদন ব্যয়।
আধুনিক প্রযুক্তি, সময়োপযোগী কৃষিনীতি আর কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বদলে গেছে দেশের কৃষির চিত্র। কৃষিক্ষেত্রে নীরব বিপস্নব ঘটেছে। বর্তমানে দেশে জমি তৈরির ৯৫ শতাংশ কাজ পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর দিয়ে করা হচ্ছে। সার প্রয়োগ ও আগাছা দমনের কাজে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং দ্রম্নত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিপর্যায়ে ভাড়ার ভিত্তিতে ফসল কাটার যন্ত্র রিপার ও কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার শুরু হয়েছে। এছাড়া মাড়াই কাজে বিশেষ করে ধান, গম, ভুট্টাসহ সব দানাদার ফসল মাড়াইয়ের কারে প্রায় ৯৫ শতাংশ যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খোরপোশের কৃষি বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ কৃষির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিকশিত হচ্ছে কৃষির আধুনিকায়ন তথা টেকসই যান্ত্রিকীকরণ। তথাপি ধান কর্তন বা কর্তনপরবর্তী পদ্ধতিতে উন্নত ব্যবস্থাপনার অভাব প্রায় সর্বত্র। ধান কর্তন বা কর্তনপরবর্তী ব্যাপক ক্ষতি হয়। আমরা জানি, খাদ্য সরবরাহ জাতীয় অর্থনীতির প্রাণশক্তি। খাদ্য উৎপাদন একটি কৌশলগত শিল্প- যা দেশ এবং দেশের জনগণের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। খাদ্য নিরাপত্তা এবং ধানের টেকসই উৎপাদন অবিচ্ছিন্ন। ধানের উৎপাদন টেকসই এবং স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ব্রিসহ অন্যান্য কৃষি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানসমূহ ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার ধান কর্তন যান্ত্রিকীকরণে বিশেষ জোর দিয়েছে। ইতোমধ্যে হাওড়সহ দেশের বেশ কিছু এলাকায় ধান কর্তন যান্ত্রিকীকরণে আশানুরূপ উন্নতিও হয়েছে। যদিও শতকরা হিসাবে তা এখনো উলেস্নখযোগ্য পরিমাণ নয়। এখনো প্রচলিত কাস্তে দিয়ে ফসল কাটা হয় এবং কার্যক্ষমতা অত্যন্ত কম হওয়ায় ফসল কাটতে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয় এবং ফসল কর্তনজনিত অপচয় অনেক বেশি। তাছাড়া ফসল কাটার ভরা মৌসুমে শ্রমিকের অভাব প্রকট হয়ে দেখা দেয়। ফলশ্রম্নতিতে সময়মতো ফসল কাটা সম্ভব হয় না। এ কারণে ফসল কর্তন কৃষির প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শ্রমিকের অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কোনো কোনো সময় পুরো ফসলই নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) আওতায় পরিচালিত সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের সরাসরি সমতল এলাকায় ৫০ শতাংশ এবং হাওড় ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র দিচ্ছে।
অনেকটা ট্রাক্টরের মতো দেখতে এ যন্ত্র দিয়ে একই সঙ্গে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তায় ভরা যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ কমানো যায়। যন্ত্রটি ব্যবহার করলে সময় বাঁচায় ৭০-৮২ শতাংশ এবং ৭৫ শতাংশ কম শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে এক একর জমির ধান বা গম কাটতে খরচ হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। সেখানে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ব্যবহারে লাগে মাত্র ৪০০ টাকা। এটি অল্প কাদার মধ্যেও ব্যবহার করা যায়। একই সঙ্গে এ যন্ত্র দিয়ে ফসল কাটার পর খড়ও আস্ত থাকে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শস্যের ফলন পরবর্তী ক্ষতি হ্রাস করা এমন একটি টেকসই পদ্ধতি যার মাধ্যমে শস্য সরবরাহ বৃদ্ধি করতে এবং কৃষিকে লাভজনক পেশায় পরিবর্তন করতে কার্যকর। তাই ধান কর্তন পরবর্তী ব্যবস্থাপনা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যদিও আমাদের দেশে এ বিষয়ে মৌলিক গবেষণা অপর্যাপ্ত। অন্যদিকে, প্রচলিত পদ্ধতি উন্নত জ্ঞান বা আধুনিক প্রযুক্তি ভিত্তিকও নয়। ধান কর্তন পরবর্তী ব্যবস্থাপনাকে কয়েকটি ধাপে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। ধান কর্তন পরবর্তী ধাপসমূহ হলো- ধান কাটা, স্তূপ, শুকানো, গুদামজাতকরণ (স্টোরেজ) এবং মিলিং। শুধু কম্বাইন হারভেস্টার প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ধান কাটা, স্ট্যাকিং, মাড়াই এবং শুকানো ধাপসমূহকে কমিয়ে সংশ্লিষ্ট ধাপের অপচয় অধিকাংশে রোধ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে শুকানো, গুদামজাতকরণ এবং মিলিং পদ্ধতির উন্নয়নের মাধ্যমে ধানকর্তন পরবর্তী ব্যবস্থাপনা উন্নত করা সম্ভব।
ব্রি ইতোমধ্যে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুটি ভিন্ন মডেলের কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র উদ্ভাবনের কাজ শেষ করেছে এবং মূল্যায়নের কাজ চলমান আছে। সবমিলে দেশে ৩০০০টির অধিক কম্বাইন হারভেস্টার কৃষক পর্যায়ে সফলতার সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভর্তুকিতে কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র কৃষক পর্যায়ে সরবরাহের ফলে এবং মাঠপর্যায়ে ৩০০০টির অধিক যন্ত্র সফলভাবে কাজ করার ফলশ্রম্নতিতে কৃষক ২০২২-২৩ বোরো মৌসুমেও নির্বিঘ্নে মাঠের ধান ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ধান কর্তন যান্ত্রিকীকরণে অভূতপূর্ব সাফল্য আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে ছোট আকারের কম্বাইন হারভেস্টারের পরিবর্তে মধ্যম আকারের কম্বাইন হারভেস্টারের (৬৫ অশ্বশক্তির অধিক) জনপ্রিয়তা এবং প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আকার এবং শক্তিভেদে এই যন্ত্রের কার্যক্ষমতা ভিন্ন হলেও গড়ে একটি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে দিনে ২.৫-৩.২৫ হেক্টর জমির ধান কাটা সম্ভব। এলাকাভেদে কর্তন মৌসুমের ব্যাপ্তি, ধানের জাত, জমির প্রকৃতি, যন্ত্র চালকের দক্ষতা ইত্যাদি বিবেচনা করে একটি কম্বাইন হারভেস্টার যন্ত্র বছরে মাত্র ৫০-৮০ দিন ব্যবহার করা সম্ভব। এই হিসাবে তিন মৌসুম মিলে ৯৫ লাখ হেক্টর জমির ধান কর্তনের জন্য প্রায় আটচলিশ হাজার (৪৮০০০টি) কম্বাইন হারভেস্টার প্রয়োজন। কিন্তু মাঠে মোট প্রয়োজনের মাত্র ৫.০-৬.০ ভাগ যন্ত্র কাজ করছে। অন্যদিকে, একটি যন্ত্র থেকে সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে দক্ষ জনবল তৈরি, মেরামতের সুযোগ সৃষ্টি এবং খুচরা যন্ত্রাংশ স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তারপরও কম্বাইন হারভেস্টার বিক্রেতা, ক্রেতা ও ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি কর্মচঞ্চলতা দৃশ্যমান।
ধান ও গম কাটার যন্ত্র 'রিপার' ফসল কাটার মৌসুমে এ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। এই মেশিন ব্যবহার করে ১ ঘণ্টায় ৬৬ শতাংশ জমির ধান ও গম কাটা সম্ভব এবং এখানে পেট্রোল খরচ হচ্ছে মাত্র ১ লিটার। যেখানে সনাতন পদ্বতিতে প্রয়োজন হচ্ছে ১০/১২ জন শ্রমিকের, যার খরচ নূন্যতম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর অফিস বলছে এ যন্ত্র ব্যবহারে সাশ্রয় হচ্ছে ৯২ ভাগ খরচ, শ্রম ও সময় ব্যয় কমে প্রায় ৯০ ভাগ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, নিয়ন্ত্রিত ও নিখুঁতভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণে চারা রোপণ সুবিধার কারণে যন্ত্রটির প্রতি দিন দিন আগ্রহী হয়ে পড়ছে কৃষকরা। রাইস ট্রান্সপস্ন্যান্টার যন্ত্র ব্যবহার করে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিভিন্ন দূরত্বে ও গভীরতায় চারা রোপণ করা যায়। একজন শ্রমিক ঘণ্টায় প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ জমিতে চারা রোপণ করতে পারে। যন্ত্রটি ব্যবহার করতে জ্বালানি খরচও খুব কম, ঘণ্টায় মাত্র ০.৫-০.৬ লিটার অকটেন প্রয়োজন পড়ে। যন্ত্রটি ব্যবহার করলে বীজতলা তৈরি করার জন্যও আলাদা জমির প্রয়োজন হয় না। বাড়ির উঠানেই বীজতলা তৈরি করা সম্ভব।
ফসলের জমির সারিতে এ যন্ত্রটির সাহায্যে বীজ বুনলে কম বীজ লাগে, সহজে আগাছা পরিস্কার করা যায়, গাছ বেশি আলো বাতাস পায় এবং সর্বোপরি উৎপাদন বাড়ে। সারিতে ও নির্দিষ্ট দূরত্বে এবং গভীরতায় সহজে বীজ বোনার জন্য পাওয়ার টিলার চালিত বীজবপন যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়। এ যন্ত্র দিয়ে চাষ করা জমিও চাষবিহীন অবস্থায় বেলে ও বেলে দোআঁশ মাটিতে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, তৈলবীজ ও ডাল শস্য সারিতে বোনা যায়। এ যন্ত্রটি ব্যবহারে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ১০-৪০ শতাংশ বীজ কম লাগে এবং ফলন ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ পদ্ধতিতে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ০.১৮ হেক্টর (৪৫ শতাংশ) জমিতে বীজবপন করা যায়।
বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করতে এ যন্ত্রটি ব্যবহার হয়। আলু, ভুট্টা, মরিচ, সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল বীজ-ফারো বা বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করা হয়। বেড পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করলে বাতাস সহজেই গাছের শিকড়ের কাছে যেতে পারে। এ যন্ত্রের ব্যবহারে ১-২টি চাষে বেড তৈরি, সার প্রয়োগ ও বীজবপনের কাজ একই সঙ্গে করা যায়, স্থায়ী বেডেও বীজবপন করা যায়, যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ০.১১ হেক্টর জমিতে বেড তৈরি করতে পারে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এঙ্গেলবার্গ হালার সম্পূর্ণ অটো এবং সেমি অটো রাইস মিলে পরিবর্তিত হচ্ছে। অটোমেটিক বা আধুনিক চালকলে ধান ভাঙানো হলে এঙ্গেলবার্গ হালারের বা সেমি অটো চালকলের তুলনায় প্রতি মণ ধানে ২-৫ কেজি বেশি চাল পাওয়া যায়। ধান থেকে চালের পরিমাণ ধান শুকানোর মাত্রা, শুকানোর পদ্ধতি, মিলিং করার সময় আর্দ্রতা, মিলিং মেশিনসহ অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যদিও ব্রির এফএমপিএইচটি বিভাগ প্রচলিত এঙ্গেলবার্গ হালারকে উন্নয়ন করে একটি এয়ার ব-টাইপ হালার উদ্ভাবন করেছে- যাতে প্রচলিত এঙ্গেলবার্গ হালারের তুলনায় প্রায় ১ শতাংশ এর বেশি চাল পাওয়া যায় এবং খরচও অর্ধেক কম হয়। তাছাড়া দেশের প্রচলিত এঙ্গেলবার্গ হালারে প্রায় ২-৩ কেজি চাল প্রতি মণে ভেঙে যায়। সাধারণত সিদ্ধ ধান থেকে ৬৮ শতাংশ চাল পাওয়া গেলেও দেশের প্রচলিত এঙ্গেলবার্গ হালারে প্রায় ৬২ এবং সেমি অটো রাইস মিলে প্রায় ৬৩ শতাংশ চাল পাওয়া যায়। ধান ভাঙানোর ক্ষেত্রে এঙ্গেলবার্গ হালার এবং সেমি অটো রাইস মিলকে সম্পূর্ণ অটো রাইসমিলে রূপান্তর করে চালের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। কারণ আধুনিক প্রযুক্তি এবং উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সব পর্যায়ে ধান এবং চালের ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবৃদ্ধিমান জনসংখ্যার খাদ্য উৎপাদন নিরাপদ এবং টেকসই করতে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি সব ধরনের অপচয় রোধ করা খুব জরুরি। দিন দিন ফসলের জমি কমে যাচ্ছে। অপরদিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। আর সে কারণেই অধিক জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার আরো বাড়াতে হবে।