বরিশাল বিভাগের একেবারে দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী ও বরগুনা। সমুদ্র উপকূলীয় জেলা হওয়ায় এ অঞ্চলের ফসল বিন্যাস দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে আলাদা। জোয়ারভাটাপ্রবণ এলাকা এবং খাল ও নদনদীতে লবণাক্ত পানি থাকায় বোরো বা শুষ্ক মৌসুমে এই দুই জেলার বেশির ভাগ আবাদযোগ্য জমি পতিত থাকে। এসব কারণে কৃষি জমি ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় এই দুই জেলায় ফসলের নিবিড়তা ও ফসল উৎপাদনশীলতা কম।
উদাহরণস্বরূপ, বরিশাল অঞ্চলে ফসলের নিবিড়তার গড় ২০৪ শতাংশ কিন্তু বরগুনা জেলার তালতলি ও পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ফসলের নিবিড়তা ১৫০ শতাংশ এর কম। অথচ এই অঞ্চলের খাল ও নদীর স্বাদু পানি ব্যবহার করে ফসলের নিবিড়তা আরো বৃদ্ধি করা সম্ভব।
উলেস্নখ্য, এসব এলাকায় কিছু কিছু খাল বা নদীতে বছরের বিশেষ সময়ে স্বাদু পানি পাওয়া যায়।
এই অঞ্চলে বোরো আবাদ সম্প্রসারণে প্রধান অন্তরায়সমূহ হচ্ছে- উচ্চফলনশীল আধুনিক বোরো ধানের বীজের অভাব। সেচ যন্ত্রের অভাব তথা সেচ যন্ত্র না থাকায় কৃষককে সেচযন্ত্র ভাড়া করতে হয়। এছাড়াও বোরো আবাদে কৃত্রিমভাবে পানি উত্তোলন করতে ইঞ্জিনের জ্বলানি খরচ বেশি লাগে। এই দুইভাবে বোরো আবাদে খরচ বেশি হয়। বোরো মৌসুমে চারা রোপণ ও কাটার সময় কৃষি শ্রমিকের অভাব। বোরো ধান আবাদে কৃষকের জ্ঞান যেমন, সার ব্যবস্থাপনা, কীট নাশক ইত্যাদি প্রায়োগিক জ্ঞানের অভাব এবং বোরো ধান আবাদে কৃষকের ইতিবাচক মানসিকতার অভাব।
উপরোক্ত অন্তরায়সমূহের কথা মাথায় রেখে পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ)-এর অর্থায়নে তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০২১-২২ বোরো মৌসুমে পটুয়াখালী জেলার সদর উপজেলা ও বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলায় ভূপরিস্থ পানি যেমন খাল ও নদীর স্বাদু পানি ব্যবহার করে দুই উপজেলার ৫০০ বিঘা পতিত জমিতে বোরো ধান আবাদ বৃদ্ধির প্রদর্শনী বাস্তবায়িত হয়েছে। বিস্তীর্ণ এই পতিত জমিকে বোরো ধান আবাদের আওতায় আনতে ও কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্যতিক্রমী এই প্রকল্পে যুগোপযোগী কয়েকটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের আওতায় পোল্ডারভিত্তিক মাটি ও পানির লবণাক্ততা পরীক্ষা করা হয়। সেসব এলাকার স্বাদু পানি অথবা কম লবণাক্ত কিন্তু ধানের জমিতে সেচের উপযোগী পানি রয়েছে তা চিহ্নিত করা এবং ম্যাপিং করা হয়েছে। চিহ্নিত এলাকায় বোরো ধান আবাদে কৃষক গ্রম্নপ ডিসকাশনের মাধ্যমে বোরো ধান চাষে কৃষকদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সমস্যার সমাধান বের করে আলোচনার মাধ্যমে আগে যেসব এলাকায় কখনই বোরো ধান আবাদ করা হয়নি সেসব এলাকায় বোরো ধান আবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আধুনিক উচ্চফলনশীল ধানের বীজ ও উপকরণ সহায়তা দিয়ে বোরো ধানের প্রদর্শনী পস্নট বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জিআইএস ম্যাপিং এর মাধ্যমে খালের পানি ধারণ ক্ষমতা নির্ণয় করা হয়েছে। খালের নির্দিষ্ট স্থানে অস্থায়ী মাটির বাঁধ দিয়ে খালে সেচ উপযোগী পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে। বোরো মৌসুমে এই পানি সেচ দিয়ে পতিত জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১ বা ২ বিঘা নয় বরং ২৫ বিঘার এক একটি বস্নকভিত্তিক প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। সেই হিসেবে ২০টি বস্নক প্রদর্শনীর মাধ্যমে ৫০০ বিঘা পতিত জমিতে বোরো ধান আবাদ বৃদ্ধির প্রদর্শনী বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি যেমন- এলএলপি সেচ যন্ত্র, ভূপরিস্থ পিভিসি পাইপ দিয়ে পানি বিতরণ ব্যবস্থা, ফিতা পাইপ, এডবিস্নউডি সেচ পদ্ধতি ইত্যাদি প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে এবং প্রযুক্তিগুলো প্রদর্শন ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় ২০২১-২২ বোরো মৌসুমে ভূপরিস্থ পানি যেমন খাল ও নদীর পানি ব্যবহার করে পটুয়াখালী সদর ও তালতলী উপজেলার ২০টি বস্নকে ৫০০ বিঘা পতিত জমিতে বোরো ধান আবাদ বৃদ্ধির প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা হয়। কৃষকদের কৃষি উপকরণ দেওয়া হয়। প্রদর্শনীর ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পটুয়াখালী সদর উপজেলায় ব্রি ধান ৬৭, ব্রি ধান ৭৪ ও ব্রি ধান ৮৯ জাতের ধানের গড় ফলন বিঘাপ্রতি যথাক্রমে প্রায় ১৯.৭-২০.৬৫, ২৩.৩-২৪.৩, ২৩.৬-২৫.৩ টন (চিত্র-১)। অপরদিকে, তালতলী উপজেলায় ব্রি ধান-৬৭, ব্রি ধান-৭৪ ও ব্রি ধান ৮৯ জাতের ধানের গড় ফলন বিঘাপ্রতি প্রতি যথাক্রমে প্রায় ২০-২১.৭, ২৩.৭-২৪.৭, ২৪.৪-২৬.৭ টন। ধানের ধরনের ওপর ভিত্তি করে দুই উপজেলার কৃষকরা সাধারণত মোটা জাতের ব্রি ধান ৭৪ বেশি পছন্দ করেছেন। এছাড়া, কিছু কিছু কৃষক ব্রি ধান-৮৯ আবাদ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রদর্শনী চলাকালীন সময়ে কৃষকদের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফলে ওই প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এলাকার ২৬৫ জনেরও অধিক বোরো ধানের আবাদের কলাকৌশল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আহরণ করতে পেরেছেন। ধানের জমিতে পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রযুক্তিগুলো হলো: ১) সেচ যন্ত্র পরিচালনা, ২) ফিতা পাইপ ও পিভিসি পাইপ ব্যবহার করে পানি বিতরণ ব্যবস্থা, ৩) খালের পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা ইত্যাদি।
কেজিএফের অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রকল্পের মাধ্যমে পটুয়াখালী সদর ও তালতলী উপজেলার ৬৮ হেক্টর বা ৫০০ বিঘা পতিত জমি থেকে ৪৬৫ টন ধান উৎপাদন সম্ভব হয়েছে- যা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এই পরিমাণ ফসলের বাজারমূল্য প্রায় এক কোটি টাকা- যা জাতীয় অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে। বোরো মৌসুমে প্রদর্শনীর এলাকায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং বরিশাল অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা ও জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও উন্নত সেচ প্রযুক্তি ও আধুনিক উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত ব্যবহার করে বরিশাল অঞ্চলে বোরো ধান আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষককে উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। উপকূলীয় প্রতিকূল পরিবেশে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক উন্নত প্রযুক্তি ও লবণসহিষ্ণু আধুনিক উচ্চফলনশীল ধানের জাত ব্যবহার করে বরিশাল অঞ্চলে বোরো ধান আবাদ বৃদ্ধিতে কৃষককে উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
তবে, বোরো ধান আবাদ করতে গিয়ে কৃষকদের বেশ কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। দরিদ্র কৃষককে সরকারিভাবে আর্থিক ঋণ বা প্রণোদনা দিয়ে বোরো ধান আবাদে আগ্রহী করা যেতে পারে। সামাজিক সমস্যা, যেমন খালের পানি ব্যবহারে বিদ্যমান কৃষক-মৎস্যজীবী বিরোধ সমাধানের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভালো বীজ সরবরাহ, যন্ত্রপাতির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা গেলে কৃষকরা বোরো আবাদে আগ্রহী হবে। সর্বোপরি কৃষকদের বোরো আবাদের মানসিকতা তৈরি করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। ধান যে শুধু নিজের পরিবারিক খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে পারে তা নয় বরং ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে উৎপাদন করতে পারলে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারবে। এই মনোভাব তৈরি করতে পারলে বরিশাল অঞ্চলের ভূপরিস্থ পানি ব্যবহার করে পতিত জমিতে বোরো ধান আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
লেখক: ডক্টর শাহরীনা আখতার: টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট,
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন।