বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
জলবায়ুর প্রভাবে কৃষিতে অশনিসংকেত

হুমকির মুখে জীবন-জীবিকা

আলতাব হোসেন
  ২২ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

'যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ'। এ কথার অর্থ, মাঘের শেষের বৃষ্টিপাতে রাজা ও দেশের কল্যাণ হয়। বহুকাল ধরে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে খনার বচন প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে আমন চাষ সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন পঞ্জিকা বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। বর্ষার নতুন পানিতে আমন ও আউশ রোপণ করেন কৃষক। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বজ্রপাত শুরু হলে মাছ, ব্যাঙ ও সরীসৃপ প্রাণীদের প্রজনন শুরু হয়। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলোতে মা মাছ এসে ডিম পাড়ে। এ সময় পাট 'জাগ' দিতে প্রয়োজন হয় পানির। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। শীতও তার প্রচলিত সময়ের নিয়ম মানছে না। আবার বন্যাও তার ব্যাকরণ ভুলে হানা দিচ্ছে অসময়ে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি ও জনজীবনে।

আবার অন্যদিকে জলবায়ুর প্রভাবে উপকূলের মানুষকে আট থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এক কলসি পানি কিনে আনতে হয়। উপকূলীয় এলাকায় এক কলসি পানির দাম পঞ্চাশ থেকে আশি টাকা। উপকূলের নারীদের পানির সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘপথ। বিশুদ্ধ যাচাই-বাছাই তো দূরের কথা, কোনোমতে খাওয়া যায় এমন খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন কেটে যায়। দেশের উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলেও সুপেয় খাবার পানি এখন দুষ্প্রাপ্য।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবতনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে। দেশি-বিদেশি গবেষকরাও অসময়ের বৃষ্টিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। বৃষ্টির বাড়াবাড়ির ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, নতুন নতুন দুর্যোগ বাড়ছে ও রোগবালাইয়ের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। ষড়ঋতুর এ দেশে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ হেমন্ত ঋতু। হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রহর। অক্টোবরের শেষেও শ্রাবণের মতোই বৃষ্টি ঝড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বৃষ্টিপাতের এই আচরণ স্বাভাবিক নয় বলে বলছেন বিজ্ঞানীরা।

খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে বাংলাদেশের কৃষি খাত। জলবায়ুর প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ফসলি জমির পরিমাণ কমতে শুরু করেছে বলে নতুন এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণা ভিত্তিক এ প্রতিবেদন তৈরি করে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিশ্বব্যাংক। 'ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার ইনভেস্টমেন্ট পস্ন্যান (সিএসএআইপি)' শীর্ষক এই প্রতিবেদনে এসব তথ্য ওঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ২০৪৫ সালের মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় ২৪ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নয় শতাংশ ফসলি জমি কমতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় ছয় শতাংশ এবং অন্য অঞ্চলে দুই শতাংশ আবাদি জমি কমবে। মাটির লবণাক্ততা উপকূলীয় জমিগুলোর ৬২ শতাংশকে প্রভাবিত করেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ আট কিলোমিটার উত্তরে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের মূল জাতীয় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলেও বিশ্বব্যাংক সর্তক করেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠ সর্বোচ্চ এক মিটার উঁচু হতে পারে, যার ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৮.৩ শতাংশ এলাকা নিমজ্জিত হতে পারে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের 'বাংলাদেশের জলবায়ু' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়ার বৈরী আচরণে বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে গেছে। এতে দেখা যায়, প্রতি বছর বৃষ্টিপাত টেকনাফে ৩৬ শতাংশ, কক্সবাজারে ২২ এবং পটুয়াখালী ও বরগুনায় ১৫ ও ১০ শতাংশ করে বাড়ছে। অন্যদিকে ভোলা, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় বৃষ্টিপাত ২০ শতাংশ করে কমে

আবহাওয়া বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এল-নিনোর শিকার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এসব দেশে কোনো বছর কৃষি মৌসুমে তীব্র খরা হচ্ছে। আবার কোনো বছর অতিবৃষ্টি বা ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে। আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণের প্রভাব কৃষির ওপর সরাসরি পড়ছে। দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটও বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায়ও বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষিবিদরা।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন দেশের কৃষক। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কৃষি খাত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে সর্বোচ্চ ঝুঁকি বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন থেকে দেশের কৃষিকে রক্ষার জন্য সরকার জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ধান ও গমের উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দেশে ধান ও গম উৎপাদন করতে হলে জলবায়ু সহিষ্ণু ও উষ্ণতা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করতে হবে। জলবায়ুর থাবায় প্রায় প্রতি বছরই খরা, বন্যা, ঝড় ও অন্যান্য দুর্যোগে কৃষি ও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে কৃষকদের বাঁচাতে শস্যবিমা চালু এবং কৃষিপণ্যের আগামমূল্য নির্ধারণে একটি জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করা জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে