শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাতামুহুরী নদীর ভয়াল ভাঙ্গন তাণ্ডবে ছোট হচ্ছে চকরিয়ার তীরবর্তী জনপদ

মুহাম্মদ মনজুর আলম, চকরিয়া-কক্সবাজার
  ১৯ অক্টোবর ২০২০, ১৮:৪৮

উৎপত্তিস্থল বান্দরবানের আলীকদম পাহাড় থেকে নিন্মাঞ্চল কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী সমুদ্র চ্যানেল পর্যন্ত প্রমক্তা মাতামুহুরী নদীর আয়তন ১৪৮ কিলোমিটার। পাহাড়ের আকাঁ-বাকা পথ পেরিয়ে নদীটি মিলিত হয়েছে সাগর চ্যানেলে।

তৎমধ্যে চকরিয়ার বেতুয়াবাজার সেতু পয়েন্ট থেকে নদীর গতিপথ প্রবাহিত হয়েছে দুইদিকে। একটি চলে গেছে বদরখালী সমুদ্র চ্যানেলে, অপরটি কৈয়ারবিল কোনাখালী হয়ে মিলিত হয়েছে পেকুয়ার উজানটিয়া দিয়ে ওপারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি সাগর চ্যানেলে।

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা থেকে পাহাড়ে উৎপত্তি হওয়া চকরিয়া উপজেলার বুকচিরে প্রবাহিত প্রমক্তা মাতামুহুরী নদী একসময় জনগনের ভাগ্য উন্নয়নে আর্শীবাদ হলেও বর্তমানে মরণদশায় পরিণত হয়েছে। নদীর উজানে লামা ও আলীকদম উপজেলার পাহাড় থেকে পাহাড়ে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও অপরিকল্পিত পাথর আহরণের ফলে প্রতিবছর বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির সঙ্গে নেমে আসা পলি জমে মাতামুহুরী নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

প্রাকৃতিক বৈরী আচরণের ফলে মাতামুহুরী নদী বর্তমানে ভয়াবহ নাব্যতা সংকটে পড়েছে। এ অবস্থার কারনে গভীরতা কমে যাওয়ায় গেল দুইযুগের অধিক সময় থেকে ১৪৮ কিলোমিটার আয়তনের মধ্যে অন্তত ৭০ কিলোমিটার জনবসতিপুর্ণ এলাকাজুড়ে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ডুবোচর জেগে উঠেছে। এতে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক চলাচল বিঘিœত হবার কারণে প্রতিবছর বর্ষাকালে দুইতীর উপচে লোকালয়ে প্রবাহিত হয় ঢলের পানি। এতে অব্যাহত রয়েছে ভাঙ্গনের ভয়াবহতাও। এভাবে বছর বছর ভাঙ্গন তাÐবে ক্রমান্বয়ে ছোট হচ্ছে চকরিয়া উপজেলার বির্স্তীন জনপদ। ফলে নদী ভাঙ্গন আতঙ্কে ভুগছেন তীর এলাকায় বসবাসরত লক্ষাধিক বাসিন্দা। পাশাপাশি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলী জমি, একাধিক গ্রামীণ সড়ক, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রসা, এতিম খানাসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অভিযোগ তুলেছেন, প্রতিবছর ভাঙ্গন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোটি কোটি টাকা বরাদ্দে বেসুমার উন্নয়ন কাজ অব্যাহত রাখলেও জনগনের সুরক্ষা নিশ্চিতে স্থায়ীভাবে টেকসই কোন ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অস্থায়ী প্রকল্প গ্রহন করার কারণে নদীর ভাঙ্গনের তীব্রতায় তা বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

তবে কক্সবাজার ও বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, মাতামুহুরী নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে একাধিক টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উধর্বতন দপ্তরে ইতোপুর্বে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দের অভাবে চকরিয়া উপজেলার অধিক ঝুঁিকপুর্ণ এলাকায় টেকসই ও বড় আকারের প্রকল্প নেওয়া যাচ্ছেনা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখাগেছে, বর্তমানে মাতামুহুরী নদীর তীরবর্তী ভাঙ্গনের কবলে চরম হুমকির মুখে পড়েছে উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নস্থ বাটাখালী ব্রীজের উত্তর প্রান্তে নাপিতের টোড়া, পৌরসভার ১নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল বারী পাড়া, ছাবেতপাড়া, চরপাড়া, কাজীরপাড়া, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তরছঘাটা, জলদাশপাড়া ও বাটাখালী সেতুর দুই পাশের গ্রামের বসতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আবাদি জমি। এছাড়াও নদীর ভাঙ্গনের তাÐবে পড়েছে বিএমচর ইউনিয়নের বেতুয়াবাজার সেতু পয়েন্ট, কন্যারকুম, কুরিল্যার তলা, বরইতলী ইউনিয়নের পহরচাঁদা, গোবিন্দপুর, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের খিলছাদক, লামারপাড়া, মন্ডলপাড়া, জলদাসপাড়া, পূর্ববড় ভেওলার সেকান্দর পাড়া, শমসু মিয়ার বাজারস্থ জলদাশপাড়া পয়েন্ট, কোনাখালী ইউনিয়নের কাইদ্যার ডিয়া, বাংলা বাজার, সিকদাপাড়া পয়েন্ট ও চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগর ঘোনাস্থ বুড়িপুকুর পয়েন্টেসহ একাধিক জনপদ।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, প্রমক্তা মাতামুহুরী নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন তাণ্ডবে গেল দুইযুগে বসতি হারিয়ে অন্তত ১২হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছেন। গৃহহারা এসব পরিবার বেঁচে থাকার তাগিদে ঠাই নিয়েছে বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে। নদীতে বিলীন হওয়ার পথে রয়েছে পৌরসভার গুরুত্বপুর্ণ শহররক্ষা বাঁধ, ছিকলঘাটা-কৈয়ারবিল সড়ক, ভাঙ্গারমুখ ফাসিয়াখালী ঘুনিয়া সড়ক ও কোনাখালী-বাংলা বাজার- বদরখালী সড়ক।

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো.আলমগীর চৌধুরী জানান, মাতামুহুরী নদীর শুরুতেই চকরিয়া পৌরসভার ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের অবস্থান। এরপর নদীর মোহনা প্রবাহিত হয়েছে ২ নম্বর ওয়ার্ড হয়ে ১নম্বর ওয়ার্ডের শেষ পয়েন্ট বেতুয়াবাজার সেতু পর্যন্ত। সেখান থেকে নদীটি ঘুরে আবার বন্যার তাÐবে ধাক্কা দিচ্ছে পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের আবদুলবারী পাড়া ও চরপাড়া হয়ে কাজিরপাড়িা এলাকায়। ওই এলাকা থেকে মাতামুহুরী নদী চলে গেছে পালাকাটা রাবারড্যাম হয়ে বদরখালী সমুদ্র চ্যানেলে। যাওয়ার পথে নদীর তাÐব অব্যাহত আছে চকরিয়া পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের তরছঘাট হয়ে বাটাখালী সেতু এলাকায়। সেখান থেকে ভাঙ্গনের খেলা চলছে পৌরসভার ৫নম্বর ওয়ার্ডের খোন্দকারপাড়া পয়েন্টে। ওয়ার্ডের উত্তর কাহারিয়াঘোনা খোন্দকারপাড়ার কয়েক হাজার মানুষের বসতির পৈত্রিক ভিটেবাড়ি, কবরস্থান, মসজিদ-মাদরাসা ও চাষাবাদের শত শত একর ধানি জমি মাতামুহুরীর নদী গ্রাসে বিলীণ হতে চলেছে। সাধারণ মানুষ ও স্কুল কলেজ এবং মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের এই পথটির মাঝখানের অংশ মাতামুহুরী নদীতে বিলীণ হয়ে যাচ্ছে।

তিনি জানান, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পৌরসভার বিভিন্ন জনপদে নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়। এতে প্রতিবারই ১০-১২টি করে বসতঘর নদীতে তলিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গন তাÐব থেকে পৌরবাসিকে রক্ষাকল্পে অধিক ঝুঁিকপুর্ণ পয়েন্ট চিহিৃত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে জানানো হয়েছে।

কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শওকত ওসমান জানান, মাতামুহুরী নদী সৃষ্টির পর থেকে কাকারাবাসী নদীর ভাঙ্গনের তান্ডবের কবলে পড়ে ইউনিয়নের বিপুল বসতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত রয়েছে প্রতিবছর।

তিনি জানান, আমার ইউনিয়নের মাঝেরফাড়ি, কামাল মাস্টারের ঘাটা, রুদ্রপাড়াসহ আশপাশ এলাকাটি নদীর গর্ভে পড়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গনরোধে আমি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

লক্ষ্যারচর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা কাইছার জানান, তার ইউনিয়নে মাতামুহুরী নদীর তীর এলাকায় রয়েছে ৬হাজার মানুষের বসবাস। নদী ভাঙ্গনের ফলে জনগনের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে বেড়ে যায় আতঙ্কের মাত্রা।

তিনি জানান, ভাঙ্গন অব্যাহত থাকলে নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে এলাকার শত শত একর ফসলী জমি, ৩৩ হাজার কেভি’র বিদ্যুৎ লাইনের টাওয়ার, খতিবে আজমসহ বেশ ক’টি সড়ক, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিম খানাসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

জানতে চাইলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা শাখা কর্মকর্তা (এসও) শাহ আরমান সালমান জানান, নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে পাউবো ইতোপুর্বে অনেক গুলো প্রকল্পপ্রস্তাবনা তৈরী করে অর্থবরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট উধর্বতন দপ্তরে পত্র প্রেরণ করা হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ না হওয়ায় সবখানে একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব হচ্ছেনা।

তিনি জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষথেকে বর্তমানে অধিক ঝুঁিকপুর্ণ চকরিয়া পৌরসভার কোচপাড়া, আবদুলবারী পাড়া, লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের রোস্তম আলী চৌধুরী পাড়া, কোণাখালী ও ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের দিগরপানখালী পয়েন্টে ভাঙ্গন ঠেকাতে প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থবরাদ্দ সংস্থান হলে নদীর অন্য পয়েন্টে ভাঙ্গন রোধে কাজ করা হবে।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ফজলুল করিম সাঈদী জানান, মাতামুহুরী নদীর ভাঙ্গনের তাÐবে গেল দুইযুগের অধিক সময়ে অন্তত ১২ হাজার পরিবার গৃহহারা হয়েছে। এখনো উপজেলার বিভিন্ন জনপদে ভাঙ্গন তাÐব অব্যাহত রয়েছে।

তিনি জানান, কিছুদিন আগেও আমি উপজেলার পুর্ববড় ভেওলা, বিএমচর ও ফাসিয়াখালী ইউনিয়নে নদীর ভাঙ্গনের ভয়াবহতা পরিদর্শন করেছি। ওইসময় কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে অনুরোধ করেছি, যত দ্রæত সম্ভব অধিক ঝুঁিকপুর্ণ জনপদে টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চকরিয়াবাসিকে ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা করুন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে