নতুন ছন্দে সাবিনা ইয়াসমিন
প্রকাশ | ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৩৮

সাবিনা ইয়াসমিন- দেশের সঙ্গীতাকাশের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম।
জীবন্ত এই কিংবদন্তিকে গানের পাখি এমনকি প্লে-ব্যাক সম্রাজ্ঞী বলেও ডাকা হয়। এখনো তার মধুমাখা সুরেলা কণ্ঠ মুগ্ধ করে রাখে শ্রোতাদের। আধুনিক, দেশাত্মবোধক, প্লে-ব্যাক সব ঘরানাতেই যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ের গভীরে স্থায়ী হয়ে আছে তার সুরের জাদুমাখা গান।
কিংবদন্তি এই গায়িকা অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ এক বছর মঞ্চে অনুপস্থিত ছিলেন। গত বছর দীর্ঘ সময় বিদেশে থেকেছেন চিকিৎসার জন্য। কারণ, তার শরীরে ক্যানসার ফিরে এসেছিল।
চিকিৎসা আর রেডিওথেরাপি শেষে সুস্থ হয়ে আবার গানে ফেরার ঘোষণা দিয়েছিলেন চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩১ জানুয়ারির সন্ধ্যায় বনানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ‘আমাদের সাবিনা ইয়াসমিন : আমি আছি থাকব’ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের সময় স্টেজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
সেখান থেকে হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। এরপর সুস্থ হয়ে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র একটি গানে কণ্ঠ দেন এই খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী। গানের রেকর্ডিংয়ে ফিরলেও স্টেজ শোতে আর ফেরা হয়নি তার।
তবে, নতুন খবর হলো আবারও স্টেজ শো’তে ফিরছেন নন্দিত এই গায়িকা। তবে, এবার দেশে নয়, দেশের বাইরে কানাডার টরন্টোতে অষ্টম বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যালের এক কনসার্টে প্রবাসীদের গান শোনাবেন এই সঙ্গীতশিল্পী।
জানা গেছে, টরন্টো প্যাভিলিয়নে আগামী ১৭ মে অনুষ্ঠিত হবে এই কনসার্ট। সেখানে সাবিনা ইয়াসমিনকে দেওয়া হবে বিশেষ সম্মাননাও।
অষ্টম বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল নিয়ে এক ভিডিও বার্তায় সাবিনা ইয়াসমিন দর্শকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছেন, ১৭ মে আপনারা সবাই আসবেন, দেখা হবে, গল্প হবে, গান তো হবেই। অপেক্ষায় রইলাম আপনাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার।
ফেস্টিভ্যালের আয়োজক শহীদুল ইসলাম মিন্টু বলেন, টরন্টোতে সাবিনা ইয়াসমিন গাইবেন দ্বিতীয়বারের মতো। এর আগে ২০১৭ সালে তিনি সেখানে কনসার্ট করেছিলেন।
সাবিনা ইয়াসমিন আমাদের এই প্রোগ্রামের জন্য খুবই স্পেশাল। এবার কানাডার বাংলাদেশি কমিউনিটির পক্ষ থেকে তাকে আমরা একটা বিশেষ সম্মাননা দিতে চাচ্ছি। বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যালের মঞ্চে আবারও সাবিনা ইয়াসমিনের মতো কিংবদন্তিকে পেয়ে আমরা আনন্দিত।’
সাবিনা ইয়াসমিন কনসার্টের দুই দিন আগে কানাডায় পৌঁছাবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজক কর্তৃপক্ষ। এই উৎসবে বাংলাদেশ থেকে আরও উপস্থিত থাকবেন জনপ্রিয় তারকা মোশাররফ করিম, রোবেনা রেজা জুঁই ও তানজিকা আমিন।
সাবিনা ইয়াসমিন প্রথম দফায় ক্যানসারে আক্রান্ত হন ২০০৭ সালে। পরে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিলেন। এরপর আবারও সঙ্গীতে নিয়মিত হয়েছিলেন তিনি। গত বছরের ফেব্রæয়ারিতে আবারও সাবিনার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে, তখন দেশবাসীর উদ্দেশে এক বার্তায় সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসা নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি সুস্থ রয়েছেন।
সাবিনা ইয়াসমিন এক পারিবারিক সুরের আবহাওয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা লুৎফর রহমান সরকারি চাকরি করলেও চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। মা মৌলুদা খাতুন মুর্শিদাবাদের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ কাদের বক্সের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। সাবিনা ইয়াসমিন ওস্তাদ পিসি গোমেজের কাছে একটানা ১০ বছর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন। তবে মঞ্চে গান গাইতে উঠেছেন মাত্র ৭ বছর বয়সে।
১৯৬২ সালে ‘নতুন সুর’ চলচ্চিত্রে শিশু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে, রবীন ঘোষের সুরে একটি গান গেয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। ১৯৬৪ সালে তিনি বেতারে ছোটদের গানের অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’-এ নিয়মিত অংশ নিতেন। ১৯৬৭ সালে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে সাবিনা ইয়াসমিনের। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা।
চলচ্চিত্রে তার গাওয়া গানের সংখ্যা কয়েক হাজার। পেয়েছেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ১৪ বার। আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ড-২০১৮ এ আজীবন সম্মাননা পান সাবিনা ইয়াসমিন। তার প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে এইচএমভি’র ডবল প্লাটিনাম ডিস্ক, উত্তম কুমার পুরস্কার, বিশ্ব উন্নয়ন সংস্থা থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা।
সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের মধ্যে ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই’, ‘চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘অশ্রæ দিয়ে লেখা এ গান’, ‘দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা’, ‘এ সুখের নেই কোনো সীমানা’, ‘বরষার প্রথম দিনে’ ও ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা’ উল্লেখযোগ্য।
তার দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো’, ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও আমার বাংলা মা’, ‘মাঝি নাও ছাড়িয়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ’ ও ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতা’ উল্লেখযোগ্য। ভারতের বরেণ্য সুরকার আরডি বর্মণের সুরে গান করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। কিশোর কুমার ও মান্না দে’র সঙ্গে দ্বৈতগানেও কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
যাযাদি/আর