দালালির খেসারত : পালিয়েছেন অনেক অভিনেত্রী-অভিনেতা

প্রকাশ | ২০ আগস্ট ২০২৪, ১২:২৬

বিনোদন রিপোর্ট
ফাইল ছবি

শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী প্রবল আন্দোলনের তোপে পড়ে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পলায়ন করেন শেখ হাসিনা। এরপরই ঘটতে থাকে নাটকীয় পরিবর্তন। ক্ষমতার পালাবদলে দেখা যাচ্ছে এখন অনেক কিছু। 

সরকারের দালালি করে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন অভিনয় শিল্পীরাও। এখন দালালির খেসারত দিতে হচ্ছে তাদেরও। কেউ দেশ ছেড়ে পলায়ন করছেন, কেউ বা কাজ না পাওয়াসহ নানাবিধ সংকটে পড়েছেন। সরকার পতনের পর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না অনেক তারকা অভিনয়শিল্পীর, সোশ্যাল মিডিয়াতেও নেই বেশির ভাগ শিল্পীর কার্যক্রম। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হামলার শিকারও হয়েছেন কয়েকজন। 

২০১৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক-বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। সরকারের সব কার্যক্রমে থাকেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ করা নির্বাচনে নৌকার হয়ে একই আসন থেকে মনোয়ন ফরম কিনেছিলেন শমী কায়সার এবং রোকেয়া প্রাচী। দুইজনই আশাহত হয়েছেন। এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়াসহ দলটির অভ্যন্তরীণ ‘আয়নাঘরের’ ভয়াবহ রোমহর্ষক নৃশংসতা প্রকাশ, হাজার হাজার মানবাধিকার লঙ্ঘন, লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার, পিলখানা হত্যাকাণ্ড রহস্য, পলায়নের সময় শেখ হাসিনা নিজে চার-পাঁচ বস্তা ডলার নিয়ে যাওয়া প্রভৃতি প্রকাশের পরও রোকেয়া প্রাচী দলটি সম্পর্কে নীরবতা পালন করেননি। এটা কেউ দলের বিষয়ে সাইকো প্যাথ হলেই করতে পারে। সাইকো প্যাথ হলেও একটা গোটা পরিবারের সবাই একই দল করতে পারে। যারা সাইকো প্যাথ, তাদের চিন্তার কোনো স্বাধীনতা থাকে না। রোকেয়া প্রাচী তেমনি সাইকো প্যাথ। যদি দলের নৃশংসতা, হিংস্রতার বিরুদ্ধে মানবিক হৃদয়ের প্রকাশ না ঘটে, তা হলে বুঝতে হবে ব্যক্তি হিসেবে সে নিজেও তেমন সাইকো প্যাথ নৃশংস, হিংস্র স্বভাবের নারী। এ জন্যই দলের হয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রাচী। কোনো শিল্পীই এমন নৃশংস, হিংস্র হায়েনার স্বভাব হতে পারে না। তাই অনেকে বলেন, ‘রোকেয়া প্রাচী ভালো অভিনেত্রী হতে পারেন, কিন্তু কিছুতেই ভালো শিল্পী নন’।

নয়ত কতটা হিংস্র হায়েনাস্বভাব নৃশংস হলেই বলতে পারেন, ‘প্রয়োজনে ১৫ আগস্ট একাই যাব বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।’ ১৪ আগস্ট বিকালেই তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনের সামনে হাজির হন। এ সময় আরও ৭০-৮০ জন সংস্কৃতিকর্মী রোকেয়া প্রাচীর সঙ্গে যোগ দেন। সন্ধ্যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের বাইরে স্মৃতিফলকে মোমবাতি প্রজ্বলন করেন তারা।

একপর্যায়ে রোকেয়া প্রাচীর ওপর হামলা চালানো হয়। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রোকেয়া প্রাচী দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। তার সে পরিচয়ের কারণে সোশ্যাল মিডিয়াতেও নানা কটাক্ষ শুনতে হয়েছে হিংস্র হায়েনা প্রাণের অভিনেত্রীকে।

একই রাতে অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে বেশ কয়েকজন। খবরটি নিশ্চিত করেছেন অভিনেতা সাজু খাদেম ও অভিনেত্রী বিজরী বরকতুল্লাহ। তারা জানান, বাড়িতে হামলা হলেও নিরাপদে আছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। ২০১৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসন-৪-এর প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা।
এ ছাড়া পাঁচবারের এমপি আসাদুজ্জামান নূর, সাবেক নারী সংরক্ষিত আসনের এমপি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী তারানা হালিমের কোনো খোঁজ নেই কোথায় আছেন তারা। পলাতক আছেন অভিনেত্রী সোহানা সাবাও।

এদিকে ৫ আগস্টের পর থেকে খোঁজ নেই অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদের। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করে ঢাকা-১০ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। গুঞ্জন আছে, এই মুহূর্তে ভারতে আছেন ফেরদৌস। অনেকের ধারণা, দেশেই আছেন তিনি।

ফেরদৌসের মতো আত্মগোপনে আছেন চিত্রনায়ক রিয়াজও। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার খবর না মিললেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সামনের সারিতেই দেখা যেত এই অভিনেতাকে। 
একই অবস্থা আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও সঙ্গীতশিল্পী মমতাজের। তারও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ২০০৮ সালে সংরক্ষিত মহিলা আসনে এবং ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

এদিকে ১৩ আগস্ট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন শমী কায়সার। বেশ কয়েক বছর ধরে অভিনয় থেকে দূরে থাকা শমী কায়সার ব্যস্ত ছিলেন ব্যবসা ও রাজনীতি নিয়ে। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনি। 

রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের সমর্থনে কথা না বলায় রোষানলে পড়েছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। মায়ের অসুস্থতার কারণে ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন না জানানোর পরও অভিনেতার দিকে ধেয়ে আসে নেতিবাচক মন্তব্য। যদিও তিনি প্রথমে আন্দোলনে ছয় ছাত্রের হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বলেন, ‘গুলি কেন করতে হলো’। কিন্তু কথাটিও যে ছাত্রদের পক্ষে যায় না, সেটা বোঝা গেল পরে আর কিছু না বলায়। মনে হয় প্রশ্নটি তিনি পুলিশকে করেছেন এবং এরপর হয়ত এর সদুত্তর পেয়ে গেছেন। তাই আর কোনো প্রশ্ন করেননি পুলিশের হত্যার মহোৎসব করা নিয়ে।

শিল্পীদের ওপর হামলা ও আক্রোশের প্রতিবাদ করেছেন অনেক শিল্পী। রাজনৈতিক পরিচয় নয়, শিল্পীদের বিচার করা উচিত তাদের কাজ দিয়ে, এমনটাই মনে করেন অনেকে। তবে কেউ কেউ আবার বলছেন, শিল্পীদের নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ না করাই ভালো।
 
অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম বলেন, ‘সক্রিয় রাজনীতি শিল্পীদের কাজ নয়। শিল্পী তার শিল্পকর্মটা ঠিকমতো করবেন। এটাও ঠিক, মানুষ যখন কোনো রাষ্ট্রে বসবাস করেন, তিনি নিরপেক্ষ হতে পারেন না। কোনো না কোনো পক্ষের প্রতি তার সমর্থন থাকেই। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যেন অন্ধের মতো না হয়। শিল্পীরা মানুষের জন্য কথা বলবেন, সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবেন। রাজনীতির কারণে শিল্পী অন্ধ হলে পথ দেখাবেন কে।’

অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা বলেন, ‘আমরা একটা নতুন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় আগে কখনো দেখিনি। এখন আমাদের ধৈর্যশীল হতে হবে। আমরা এখন আর কোনো বিভক্তি চাই না। কে কখন কী কথা বলেছেন, সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের সামনের কথা ভাবতে হবে। পেছনের কথা ভাবলে এখন চলবে না।’ 

অভিনেত্রী রুকাইয়া জাহান চমক বলেন, ‘শিল্পীদের রাজনৈতিক ট্যাগ থাকা উচিত নয়। তারা সব মানুষের। কিন্তু অনেকেই রাজনৈতিক ট্যাগ ব্যবহার করে সুযোগ নিয়েছেন। শিল্পীদের এমন করা উচিত নয়। এখন দ্রুত শিল্পীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা উচিত। যে কমিটি আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন রক্ষায় কাজ করবে। মূলধারার শিল্পী, যাদের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই, তাদের নিয়ে কমিটি গঠন করা উচিত।’

এ বিষয়ে নির্মাতা সৈকত নাসির ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শিল্পীদের রাজনৈতিক দর্শন, ভিন্নমত, ভিন্ন আদর্শ থাকতেই পারে। এটি সবার নাগরিক অধিকার। তাই বলে দল ক্ষমতাচ্যুত হলেই তাদের ওপর আক্রমণ করতে হবে? এটা কোন সভ্য রাজনীতি? চলচ্চিত্রের অনেক শিল্পী আজ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, যা একেবারেই কাম্য নয়। এই শিল্পীরাই আপনাদের বিনোদিত করেছেন, আপনাদের ভালোবাসায় তারা পরিচিতি পেয়েছেন। অন্তত সেসব কথা মাথায় রেখে ক্ষমা করতে শিখুন।’

নির্মাতা কবিরুল ইসলাম রানা লিখেছেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এ দেশে শিক্ষক, ডাক্তার, পরিচালক, শিল্পী তাদেরও রাজনৈতিক পরিচয় লাগে। দলের সাপোর্ট করেন, সমস্যা নাই, শুধু দলকানা হয়েন না। এর পরিণতি সবাই দেখছি। আমরা অবশ্যই রাজনীতি করব, সাপোর্ট করব, কিন্তু তারও লিমিটেশন থাকা উচিত। সব সরকার আমাদের ব্যবহার করতে চাইবে, কিন্তু আমাদেরও বোঝা উচিত, কতটা আমরা ব্যবহার হব।’

যাযাদি/ এস