কুয়েটের দুই পক্ষের সংঘর্ষে অস্ত্রধারীরা ছাত্ররা কারা?
প্রকাশ | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:০৩

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে নগরীর রেলিগেট, তেলিগাতিসহ আশপাশের বিএনপি নেতাকর্মীরা ছাত্রদলের সঙ্গে যোগ দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। তাদের কুয়েটে মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুর থেকে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সহিংসতায় রূপ নেয়। সংঘর্ষের ঘটনাটি কুয়েটের প্রধান ফটক পেরিয়ে বাইরের রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দুপুরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা, এই কুয়েটে হবে না’, ‘দাবি মোদের একটাই, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’—এমন স্লোগান দিতে দিতে হল এলাকা প্রদক্ষিণ করছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে আসতেই তাদের সঙ্গে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের তর্ক বাধে। মুহূর্তেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। পরে সংঘর্ষে রূপ নেওয়া এই পরিস্থিতি ক্যাম্পাসের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, দুপুর দুইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাইরে বিএনপি-সমর্থিত কিছু বহিরাগতর এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে ক্যাম্পাসে রেখে যায়। এরপর থেকেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু সূত্র বলছে, সংঘর্ষের মূল সূত্রপাত ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট কয়েকজন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে। দীর্ঘদিন ধরে কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও, ছাত্রদল তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম গোপনে চালিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে ২২ ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থীকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছিল তারা। বিষয়টি সাধারণ শিক্ষার্থীদের নজরে এলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
সংঘর্ষের সময় বিভিন্ন একদল বহিরাগতদের হাতে লাঠিসোঁটা, রড এবং ধারালো অস্ত্র দেখা যায়। তারা মূলত ছাত্রদলের হয়ে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বৈষম্যবিরোধীদের ওপর হামলা করে বলে জানা যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষকরা বলেন, দুপুরের দিকে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমরা দেখেছি, এসময় বহিরাগত অনেকের হাতে বাঁশের লাঠি, রামদা এবং লোহার রড ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ আসে। এরপরে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং পরিস্থিতি সামাল দেয়।
এদিকে, দুই পক্ষের এই ঘটনায় অস্ত্রধারীদের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। লতিফুল ইসলাম নামে একজন ফেসবুকে ছবিগুলো শেয়ার দিয়ে লেখেন, ছবিতে একজনও বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান বা সাবেক শিক্ষার্থী মনে হচ্ছে না। তর্ক, বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনার অবারিত সুযোগ আছে। ছাত্রদলের উচিত নিজেদের নেগেটিভ দিকগুলোও মার্কিং করা। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়রদের বিরুদ্ধে বহিরাগতদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া বোকামি। তাদের উচিত হবে অস্ত্রধারীদের পরিচয় প্রকাশ করে আইনের হাতে তুলে দেয়া।
এদিকে, এদিন দুপুরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করছিল। তারা কুয়েটকে ছাত্ররাজনীতি মুক্ত রাখার দাবি জানাচ্ছিলেন। তবে তাদের শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট কিছু শিক্ষার্থী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন বহিরাগতরা ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে এলোপাতাড়ি হামলা শুরু করে। সংঘর্ষ চলাকালে ক্যাম্পাসে থাকা শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে আহত করা হয়। এমনকি হলের আশপাশেও আক্রমণ চলে, যেখানে সীমানা প্রাচীর না থাকায় বহিরাগতরা সহজেই প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ইট-পাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটে, বহু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন, অনেকের মাথা ফেটে যায়।
শিক্ষার্থী মুজাহিদ ও উৎপল বলেন, ছাত্রদল ক্যাম্পাসে রাজনীতি চালু করার চেষ্টা করছিল এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের উসকানি দিয়ে হামলা চালায়। তারা আমাদের মানববন্ধনের মাইক কেড়ে নেয় এবং পরে বহিরাগতদের নিয়ে পরিকল্পিত হামলা চালায়। আমরা চাই, এই ঘটনায় জড়িত ১৮ জনকে আজীবন বহিষ্কার করা হোক।"
অন্যদিকে, ছাত্রদলের এক নেতা বলেন, আমরা ১০-১২ জন একাডেমিক ভবন থেকে ওমর একুশে হলের দিকে যাচ্ছিলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা তখন একটি মিছিল নিয়ে আসছিল। আমরা রাস্তা ছেড়ে পাশ দিয়ে চলে যাই, কিন্তু হঠাৎ করে তারা আমাদের দেখে হুমকি দেয়—‘তোরা কারা? ছাত্রদল করার সাহস কোথায় পেলি?’ এই বলেই ওরা আমাদের সহপাঠী ইফাজের ওপর হামলা করে। আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি এবং হলের দিকে চলে যেতে থাকি। কিন্তু হলের কাছাকাছি যেতেই তারা আমাদের ঘিরে ধরে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। এমনকি আমার মাথায় চেয়ারের আঘাত করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় আমি কোনোভাবে হলের ভেতর ঢুকে পড়ি, পরে স্থানীয়দের সহায়তায় হাসপাতালে আসতে হয়।
কুয়েট ক্যাম্পাসে সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিজিবির সদস্যরা মোতায়েন করা হয়েছে। খানজাহান আলী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কবির হোসেন বলেন, ছাত্রদের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।
যাযাদি/ এম