‘বাইরের বাতাসের চেয়েও বিপজ্জনক ঢাকার ঘরের ভেতরের বায়ু দূষণ’

প্রকাশ | ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:০০

জাবি প্রতিনিধি
ছবি : বায়ু দূষণ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পাবলিক হেলথ্ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য গবেষক ড. সাখাওয়াত হোসেনের গবেষণা পত্রে ঢাকার ঘরের ভেতরের বায়ু দূষণ বাইরের বাতাসের চেয়েও বিপজ্জনকের তথ্য পাওয়া গেছে।

সোমবার (২ ডিসেম্বর) বেলা সাড়ে ৩ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ্ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য তুলে ধরেন ড. সাখাওয়াত হোসেন।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,  'বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের শীর্ষ বায়ু দূষিত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে, যেখানে ঢাকা শহরও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। তবে বাহ্যিক বায়ু দূষণের পাশাপাশি গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। এই দূষণের ফলে শ্বাসযন্ত্রের রোগ, হৃদ্রোগ, ফুসফুসের ক্যানসার, কম ওজনের শিশু জন্মদান, মস্তিষ্ক বিকাশজনিত সমস্যা, মানসিক স্বাস্থ্য অবনতি এবং অপমৃত্যুর মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে বায়ুদূষণ-সংবেদনশীল গ্রুপ, যেমন শিশু, বৃদ্ধ ও যাদের আগে থেকে শ্বসনযন্ত্র-সম্পর্কিত রোগ, হৃদ্রোগ ও অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ আছে।'

"স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার" ২০১৯ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ বাংলাদেশের ৪র্থ প্রধান মৃত্যুঝুঁকির কারণ এবং এর ফলে প্রতিবছর ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। গৃহের ভেতরের বায়ুতে ক্ষতিকর পদার্থ জমা হওয়ার ফলে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ তারা বেশিরভাগ সময় ঘরের ভেতরে কাটায়। দুঃখজনকভাবে, এ সমস্যাটি নিয়ে দেশে যথেষ্ট আলোচনা না হওয়ায়, এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে জনগণকে সুরক্ষিত রাখা ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠছে। তাই গৃহ- অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং এ থেকে রক্ষা পেতে কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

এই বিষয়েই নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেট্রিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও Air Quality, Climate Change and Health (ACH) ল্যাবের প্রধান ড. সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত "Characterizing Indoor Air Quality and Identifying Factors Influencing Air Quality at Home Microenvironment in Dhaka City" শীর্ষক একটি গবেষণা সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন "ইন্ডোর ইনভাইরন্টমেন্টস” জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত গবেষণায় ঢাকায় প্রথম বারের মত ব্যাপকভাবে ৪৩টি গৃহের অভ্যন্তরে PM25 দূষণের মাত্রা নির্ণয় করা হয়েছে এবং বায়ুমান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গৃহের গড় দূষণ মাত্রা ছিল ৭৫.৬৯ মাইক্রোগ্রাম/ মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা থেকে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। কিছু গৃহে দূষণ মাত্রা ছিল ২০০ মাইক্রোগ্রাম/ মিটার'-এর বেশি, যা বাসিন্দাদের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বের অনেক শহরের তুলনায় ঢাকার গৃহের বায়ু মান অনেক বেশি উদ্বেগজনক।

গৃহের অভ্যন্তরে বায়ু দূষণের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাইরের দূষিত বায়ুর প্রবেশ। ঘরের জানালা বা অন্যান্য ছিদ্র দিয়ে বাইরের দূষিত বায়ু অনুপ্রবেশ করে এবং অভ্যন্তরীণ বায়ুকে প্রভাবিত করে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ঘরের ভেতরের বায়ু দূষণের প্রায় ৪০% বাইরের বায়ুর অনুপ্রবেশের কারণে ঘটে। দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করা। রান্নার সময় পিএম ২.৫-এর যাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে যখন প্রতিবার রান্নার সময়কাল ১.৫ ঘন্টার বেশি হয়। এছাড়াও গবেষণায় উঠে এসেছে, যারা নিয়মিত ঘর পরিষ্কার করেন, তাদের ঘরের দূষণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাবক হলো গৃহের আয়তন; গবেষণায় দেখা গেছে, ১২০০ বর্গফুটের বেশি আয়তনের বাড়িতে দূষণের মাত্রা বেশি ছিল।

ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, "মানুষ তার দিনের প্রায় ৬০-৬৫% সময় ঘরের ভেতরে কাটায়। মানুষের দৈনন্দিন বায়ু দূষণের একটি বড় অংশ ঘরের ভেতরে শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। তাই গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। আমরা সাধারণত বাহ্যিক দূষণ সম্পর্কে সচেতন থাকি, কিন্তু ঘরের অভ্যন্তরের দূষণ সম্পর্কে অনেকটাই অবহিত নই। যেহেতু ঘরের দূষণকে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়, তাই দূষণ কমাতে উৎসগুলো চিহ্নিত করে তা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাইরের দূষিত বায়ু ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভেতরে অবস্থানরত মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায়। তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই দূষণের অনুপ্রবেশ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন 'বিল্ডিং অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট' জার্নালে প্রকাশিত আমার গবেষণায় দেখা গেছে, জানালা বন্ধ রাখলে ঘরের ভেতরে বাইরের পিএম ২.৫ দূষণের প্রায় ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত প্রবেশ বন্ধ করা যায়। ঘরের ভেতর এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার করতে হবে। একটি গবেষণায় আমরা পেয়েছি, হেপা-ফিল্টারসহ এয়ার পিউরিফায়ার ঘরের ভেতরে পিএম ২.৫-এর দূষণ অনেক কমিয়ে দেয়।"

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য আফসানা ইয়াসমিন বলেন, "উৎসগুলো আমরা এখন চিহ্নিত করতে পেরেছি। তাই যখন বাইরে দূষণের মাত্রা বেশি থাকে, তখন ঘরের জানালা বন্ধ রাখার মাধ্যমে বা এসি ব্যবহার করে বাইরের বায়ুর অনুপ্রবেশ রোধ করা যেতে পারে। এছাড়া রান্নার সময় রান্নাঘরের ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, এবং ঘর নিয়মিত পরিষ্কার রাখা দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।"

নারী, শিশু এবং পূর্ববর্তী শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিরা গৃহ-অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার, কারণ তাদের দিনের অধিকাংশ সময় ঘরের ভেতরে কাটে। এখনই যদি এই সমস্যার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তবে গৃহ- অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ এক নীরব ঘাতক হিসেবে আমাদের জীবনে আরও গভীর প্রভাব ফেলবে। তাই সচেতনতা বাড়ানো এবং এই সমস্যার সমাধানে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাইরের দূষিত বায়ুর প্রবেশ রোধে ঘরে জানালা ও বায়ুচলাচল ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি, যা ঘরের ভেতরের বায়ুমান উন্নত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। রান্নার সময় দূষণ কমাতে পরিবেশবান্ধব এবং উন্নতমানের চুলার ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত, যা বিশেষত নারীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে, জনগণকে গৃহস্থালি বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। সর্বোপরি, নীতি-নির্ধারকদের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কার্যকর সমাধানমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব।

যাযাদি/ এম