সকাল সোয়া ১০টা। চোখে-মুখে একরাশ উচ্ছ্বাস। কথা ছিল একটু পরেই বাস গন্তব্যে পৌঁছে যাবে; এরপর শুরু আনন্দ-উল্লাস-উৎসব-হইচই। কিন্তু কে জানত? মিনিট দশেক পরেই সেই উচ্ছ্বাস রূপ নিতে যাচ্ছে বিষাদে-করুণ পরিণতিতে!
গতকাল শনিবার (২৩ নভেম্বর) গাজীপুরের শ্রীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। ঘটনায় ইতোমধ্যেই জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে।
নিহত হওয়া শিক্ষার্থীরা হলেন- ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জোবায়ের আলম সাকিব (২২), মোজাম্মেল হোসেন নাঈম (২৪) এবং একই বিভাগের মোস্তাকিম রহমান মাহিন (২২)। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আইপিই বিভাগের আরও অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী। তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কী হয়েছিল ওই সময়?
কথা হয় বাসে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সামিউল আলম মুন্নার সাথে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, মর্মান্তিক এই ঘটনার সূত্রপাত হয় বাস থেকে নামতে গিয়ে। পাশাপাশি একজনকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারাণ তিনজন। তবে বেঁচেও ফিরেছেন দু’জন। আহতরা সবাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের শিক্ষার্থী।
সামিউল আলম মুন্না বলেন, ‘প্রথমে বাস থেকে নামতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন এক শিক্ষার্থী। পরে তাকে বাঁচাতে গিয়ে জোবায়ের আলম সাকিব নিচে পড়ে যান। সেখানে সাকিবের মুখ আটকে গেলে আর কোনোভাবেই তাকে ছাড়ানো যায়নি। কিন্তু ততক্ষণে বেচে যান বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া সেই শিক্ষার্থী। ইতোমধ্যে সাকিবকে বাঁচাতে অন্য সহপাঠীদের সাথে ছুটে আসেন নিহত হওয়া মোজাম্মেল হোসেন নাঈমও।
কিন্তু এবার নাঈমের সাথে আসা শিক্ষার্থী পুনরায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছেন এটা বুঝতে পেরে ওই শিক্ষার্থীকে লাথি মেরে দরজার বাইরে ফেলে দেন নাঈম। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া সেই শিক্ষার্থী বাইরে পড়ে বাঁচতে পারলেও এবার নাঈমের হাত আটকে যায় দরজার হাতলের সঙ্গে। সহপাঠীরা শত চেষ্টা করলেও দরজা থেকে নাঈমকে আর ছাড়ানো সম্ভব হয়নি। সেখানেই প্রাণ হারান মোজাম্মেল হোসেন নাঈম। একইভাবে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে নিতে গেলে পথেই প্রাণ হারান মোস্তাকিম রহমান মাহিন।
শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী চায়না প্রজেক্টের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ‘শেষের বাসটি সড়কের পাশের ১১ হাজার ভোল্টেজের লাইনে বিদ্যুতায়িত হয়। এ সময় বাস থেকে ধোয়া বের হতে থাকলে ছাত্ররা চিৎকার শুরু করেন। আমরা তাদের চিৎকার শুনে বাসের কাছে যাই। এ সময় তিনজন ছাত্র বাস থেকে নেমে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের একজনের মৃত্যু হয়। অপর দুই জনকে শুকনো বাঁশ দিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করি।’
স্থানীয় বাসিন্দা আফসার উদ্দিন (৭০) জানান, বোর্ড বাজার এলাকায় আইইউটির ৪৬০ জন শিক্ষার্থী ‘মাটির মায়া’ রিসোর্টে ছয়টি বিআরটিসি দোতলা বাস এবং তিনটি মাইক্রোবাস নিয়ে পিকনিকে আসেন। তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামে পৌঁছানোমাত্র সড়কের পাশ দিয়ে যাওয়া ১১ হাজার ভোল্টেজের লাইনে একটি বাস (নং ঢাকা মেট্রো ব-১৫৭০৩৮) বিদ্যুতায়িত হয়। এ সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে দুই ছাত্রের মৃত্যু হয়। আহতদের শরীরের বিভিন্ন অংশ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কারও হাত, কারও পা, কারও মুখ ঝলসে যায়।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক জাকিউল ইসলাম জানান, মোজাম্মেল হোসেন নাঈম, মোস্তাকিম রহমান মাহিন ও জোবায়ের আলম সাকিবকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। আরও কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন মণ্ডল জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
যাযাদি/ এস