শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

এইচএসসিতে শহীদদের সাফল্য, কাঁদছে পরিবারগুলো

যাযাদি ডেস্ক
  ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০৫
আপডেট  : ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:১০
ফাইল ছবি

২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে গতকাল। প্রকাশিত এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ হওয়া অনেকেই।কিন্তু আনন্দের এসব খবরে উচ্ছ্বাসের বদলে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে শহীদরের পরিবার, সহপাঠী ও স্বজনদের মধ‍্যে। যাদেরকে নিয়ে আনন্দ উদযাপন করার কথা ছিল তারা আজ নেই, ঘুমিয়ে আছেন কবরে। কিন্তু পৃথিবীতে রেখে গেছেন তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর।

আবু রায়হান পেয়েছেন জিপিএ-৫

স্বপ্ন ছিল মেডিক্যাল পড়াশোনা করে চিকিৎসক হবেন একমাত্র ছেলে সন্তান আবু রায়হান। ছোটবেলা থেকে সেভাবেই তাকে গড়ে তুলেছে তার পরিবার। প্রাথমিক থেকে প্রথম স্থান অধিকারকারী রায়হান দাখিল পরীক্ষায় পেয়েছেন জিপিএ-৫। সদ্য প্রকাশিত আলিম পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন শহীদ আবু রায়হান। স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ছুঁতে পারলেন না। কৃতিত্বের সঙ্গে ফলাফলে উত্তীর্ণ হলেও অধরাই রয়ে গেল সেই স্বপ্ন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ঘাতকদের অগ্নিসংযোগে শহীদ হন আবু রায়হান।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের ফজলে আলম ও রেহেনা বেগম দম্পতির সন্তান আবু রায়হান। বাড়ির পাশের স্কুল থেকে প্রাথমিক শেষ করে উত্তর হরিহরপুর মাদরাসা থেকে দাখিলে জিপিএ-৫ ও আলিমে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন রায়হান। মেধাবী রায়হান ছিলেন পরিবারের একমাত্র বাতিঘর। শিক্ষাজীবনে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ায় তাকে নিয়ে গর্ব করতেন প্রতিবেশীরা।

এর আগের সব পরীক্ষায় সন্তানের ফলাফলে মিষ্টি মুখে মুখরিত ছিলেন পরিবার ও প্রতিবেশীরা। তবে এবারের ফলাফলে সন্তানের স্মৃতি দেখে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশীরা। তবুও শহীদ সন্তানের বাবা-মা পরিচয়ে ভুলে থাকার চেষ্টা করেন ছেলের অনুপস্থিতি। সন্তানের শহীদের বিনিময়ে হলেও আর কোনো প্রাণহানি ও বৈষম্য চান না রায়হানের বাবা-মা।

প্রতিবেশী জাহেদা খাতুন বলেন, এলাকার ভাতিজা হয় রায়হান। তার মেধা দেখে সবাই তাকে ডাক্তার বলে ডাকতাম। সে বেঁচে থাকলে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হত। আমরা একজন এলাকার গর্বিত ডাক্তার পেতাম।

শহীদ আবু রায়হানের মা রেহেনা বেগম বলেন, ‘আমার সন্তানকে নিয়ে কেউ কটূ মন্তব্য করতে পারবে না। সে অনেক ভদ্র ও ভালো ছিল। আমাকে বলতো, ‘মা তোমার স্বপ্ন পূরণ করব ডাক্তার হয়ে’৷ আমার ছেলে তো জিপিএ-৫ পেয়েছে। আর তো কোনো ছেলে নেই আমার। কে স্বপ্ন পূরণ করবে এখন। কী হবে আমার পরিবারের।’

শহীদ আবু রায়হানের বাবা ফজলে আলম রাশেদ বলেন, ‘আজকের আনন্দের দিনে এতটুকু ভেবে আনন্দ লাগছে যে, আমার মেধাবী সন্তান শহীদ হয়েছে দেশের জন্য। আমি একজন গর্বিত শহীদের বাবা। তাকে একজন মানবিক চিকিৎসক বানানোর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে তার রেখে যাওয়া নতুন বাংলাদেশ আবার নতুন করে সাজবে এই প্রত্যাশা।’

শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন জিপিএ-৪.৮৩

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি ময়মনসিংহ বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৮৩ পেয়েছেন।

মঙ্গলবার তার বাবা মোহাম্মদ আবদুল মতিন ফেসবুকে এক পোস্টে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শাহাদাত বরণকারী আমার একমাত্র ছেলে কলিজার টুকরা শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।’

গত ১৮ জুলাই বিকেলে ঢাকার মিরপুরে ১০ নম্বরের গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হন শেখ শাহরিয়ার বিন মতিন। ডান চোখের পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে মস্তিষ্ক ছেদ হয়ে যায়।

শাহরিয়ারের পরিবার সূত্রে জানা যায়, পরীক্ষার মধ্যে বন্ধ পেয়ে ঢাকায় মায়ের কাছে যায় শাহরিয়ার। পরে মিরপুর ২ নম্বর সেকশনে খালার বাসায় বেড়াতে যায়। সেখানে খালাতো ভাইয়ের সাথে আন্দোলনে অংশ নেয়। পরে মিরপুর ১০ নম্বরের গোলচত্বরের কাছে গুলিবিদ্ধ হয় শাহরিয়ার। তার খালাতো ভাইও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। ওই দিন একপাশে আন্দোলনকারী অন্য পাশে পুলিশ ও ছাত্রলীগ ছিল।

শাহরিয়ারের ফলাফল শেয়ার করে ফেসবুকে রিফাত উল্লাহ নামে একজন লিখেছেন, ‘জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ২০ জুলাই সন্ত্রাসী লীগ বাহিনী এবং আওয়ামী পুলিশের গুলিতে শহীদ শাহরিয়ার এইচএসসি রেজাল্ট বেরিয়েছে। শহীদ শাহরিয়ার আমার বন্ধু শেখ আব্দুল মতিনের ছেলে। সান্ত্বনা দেবার মতো কোনো ভাষা আমার জানা নাই। আল্লাহ শাহরিয়াকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন।’

শহীদ নাফিসা পেলেন ৪.২৫

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হওয়া নাফিসা হোসেন মারওয়া ৪.২৫ পেয়ে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। নাফিসার এ অর্জন তার মা-বাবার মনকে নতুন করে কাঁদিয়েছে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে সহপাঠিরা যখন উল্লাস করছেন, তখন চিরনিদ্রায় শায়িত নাফিসা।

জানা যায়, বাসায় না জানিয়ে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিতেন কলেজ শিক্ষার্থী নাফিসা। ১৭ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী আন্দোলনে সবসময় ছিলেন সম্মুখ সারিতে।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন গত ৫ আগস্ট দুপুরে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন থানা রোডে পুলিশের গুলিতে মারা যান তিনি।

নাফিসার বাবা আবুল হোসেন বলেন, ‘মেয়ের যাতে লেখাপড়া নষ্ট না হয়, সেজন্য রান্না করতে দিতাম না। চায়ের দোকান দিয়ে যা দুই টাকা উপার্জন করেছি, মারওয়ার লেখাপড়ায় দিয়েছি। মেয়ে আমাকে না জানিয়ে গত ১৮ জুলাই থেকে উত্তরায় যেত আন্দোলনে। সারা দিন দোকানে থাকায় খোঁজ পেতাম না। প্রতিবেশীর কাছে জেনে মেয়েকে ঘরে আটকাই ‘

আবুল হোসেন আরো বলেন, সাভারের বক্তারপুরে মামার বাসায় গিয়ে পুরনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে আবার আন্দোলনে যায়। ৪ আগস্ট দুপুরে মেয়েকে ফোন করলে গোলাগুলির শব্দ শুনি। মেয়ে তখন বলে, আন্দোলনে আছি। আর পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ৫ আগস্ট থানা রোডে যায় নাফিসা। তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে ফোনে বলল, শেখ হাসিনা পলাইছে। আব্বু, আমি গণভবন যামু। আজ আমারে বাধা দিও না। আমি বললাম, শেখ হাসিনা পলাইছে, তাতে তর বাপের কী! তর বাপে করে চায়ের দোকানদারি।’

আবুল হোসেন বলেন, ‘রাগ করে ফোন রেখে দিই। দুপুর ২টার দিকে মেয়ের ফোন থেকে এক ছেলে জানায়, আমার মেয়ের বুকে গুলি লাগছে। মেয়েটা সোয়া ২টার দিকে আমারে ফোন করে বলে, ‘আব্বু আমি মরে যামু। লাশটা নিও।’ এটাই মেয়ের শেষ কথা ছিল।’

শহীদ আফনানও পেয়েছে জিপিএ ৪.১৭

লক্ষীপুর ভিক্টোরি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন সাদ আল আফনান পাটোয়ারি। বাবা সালেহ আহমেদ বেঁচে নেই। মা নাসিমা আক্তার স্বপ্ন দেখতেন ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু সে স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ হয়ে যায় ৪ আগস্ট। লক্ষীপুরের মাদাম ব্রিজ এরাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গুরিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ মা নাছিমার কষ্টকে যেন আরো বাড়িয়ে দিল। ছেলে তার জিপিএ ৪.১৭ পেয়ে পাস করেছেন। বেঁচে থাকলে বন্ধুদের সাথে উল্লাসে মেতে থাকতো তার ছেলেও। কিন্তু সে আজ চিরনিদ্রায় শায়িত।

নাছিমা বলেন, ‘আফনানের রেজাল্ট আমার কাছে খুশির খবর। কিন্তু যাকে নিয়ে এ খুশি উদযাপন করবো সেই তো নাই। গুলি করে আমার ছেলের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।আমার কোল আজ শূন্য।’

সবুজ মিয়া পেলেন জিপিএ-৪.৩৩

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সবুজ মিয়া এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।

মঙ্গলবার এইচএসসির প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায় শ্রীবরদী সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে সবুজ জিপিএ-৪.৩৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

শহীদ সবুজের এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতকার্যের খবরে পরিবার, শিক্ষক ও সহপাঠীদের মাঝে আনন্দের পরিবর্তে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শহীদ সবুজ মিয়া শ্রীবরদী উপজেলার খড়িয়া কাজিরচর ইউনিয়নের রুপারপাড়া গ্রামের আজহার আলীর ছেলে।

গত ৪ আগস্ট শেরপুর জেলা শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে শহীদ হন সবুজ মিয়া।

সবুজের মা শমেজা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে আজ বেঁচে থাকলে রেজাল্টটা নিয়ে আমার কাছে আসতো সবার আগে। সবাইকে খুশিতে মিষ্টি খাওয়াতো। আজ আমার ছেলে না থাকায় সবকিছু অন্ধকার। ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে আমার ঘুম নেই। সারাক্ষণ টেনশনে মাথা ব্যথা করে। সবুজ আমাদের গোবরে পদ্ম ফুল ছিল, এলাকার সবার সাথে ও খুব ভালো ব্যবহার করতো। প্রতিদিন কবিতা লিখে ও আমাকে শোনাতো। এখন আর কেও আমাকে কবিতা শুনায় না। আমার ছেলে পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল, ওর কবি হওয়ার ইচ্ছা ছিল। আমার ছেলেকে যারা গুলি করে মারছে আমি তাদের বিচার চাই।’

সবুজের মা রেজাল্টের কার্ড নিয়ে ঘুরছেন। এ দিকে সবুজের অসুস্থ বাবা সবুজের অপেক্ষায় বাড়ির সামনে পথ চেয়ে বসে আছেন।

শহীদ মো রায়হান

শহীদ মো. রায়হানের মৃত্যুর প্রায় আড়াই মাস পেরিয়ে গেছে। গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রায়হান। তিনি আজ জিপিএ-২.৯২ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

রায়হান নোয়াখালীর সদর উপজেলার নোয়ান্নই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব দুর্গানগর গ্রামের আমজাদ হাজী বাড়ির মো: মোজাম্মেল হোসেন ও আমেনা দম্পতির একমাত্র ছেলে। তিনি রাজধানীর গুলশান কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।

মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টায় ফলাফল জানতে পারে তার পরিবার। ফল পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন পরিবারের সদস্যরা।

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট বাড্ডায় বিজয় মিছিলে যোগদান করলে গুলিবিদ্ধ হন রায়হান। এরপর ৬ আগস্ট দুপুরে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তার বাবা মো: মোজাম্মেল হোসেন বাড্ডায় একটি বাড়িতে কেয়ারটেকারের চাকরি করতেন। রায়হান পাশেই একটি মেসে থাকতেন।

রায়হানের একমাত্র বোন উর্মি আক্তার বলেন, ‘আমার ভাই অনেক ভালো ছাত্র ছিল। তার আচরণ কখনো খারাপ ছিল না। তার জন্য বাবা-মা সব সময় কান্না করেন। ফলাফল দেওয়ার খবর শুনে বাবা-মা কান্না করছেন। আমার ভাই বেঁচে থাকলে সবাই খুশি হত।

রায়হানের মা আমেনা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে বেঁচে নেই, তার এই ফল দিয়ে কী হবে? সে পাস করসে তা দিয়ে এখন কী করব। তার আরও ভালো রেজাল্ট করার কথা। সে মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা এখনো কান্না করছেন। নিজেরা না খেয়ে সন্তানকে খাইয়েছি। তাকে ঢাকায় পড়ালেখা করাইসি। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন বুলেটে শেষ হয়ে গেছে।’

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে