মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ বছর পূর্তি 

প্রকাশ | ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৪ | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৪৫

ইশতিয়াক আহমেদ, মাভাবিপ্রবি
ছবি : যায়যায়দিন

টাঙ্গাইল শহরের অদুরে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও কাশ্মীরের পীর শাহ-জামানের স্মৃতি বিজড়িত সন্তোষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার প্রসারে স্থাপিত হয় মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পেরিয়ে ২৬তম বর্ষে পদার্পণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস:

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো গতানুগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সাধারণ মানুষের অবদান। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের অবদানও কম নয়। এই বিশ্বাবদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগ ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ভাগ তৎকালীন ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা ।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মওলানা ভাসানী মানেই- এক কর্মোদ্যোগী, সংগ্রামী, মানবতাবাদী ও মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির দিশারী, গতানুগতিক ধারার বাইরে ভিন্নধর্মী, বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারার এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। গরীব ও অসহায় জনগণ কীভাবে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের উন্নয়ন তথা বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবে এটাই ছিল তাঁর চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু।

মওলানা ভাসানীর এই ভিন্নধর্মী শিক্ষা দর্শনের প্রতিফলনস্বরূপ তিনি সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি একাধারে বিদ্যাপীঠ ও কর্মশালারূপী এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কর্ম ও উৎপাদনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে । এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনে ঘোষণা দেন- সন্তোষে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। যদিও ১৯৭০ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করতে সক্ষম হন। ১৯৭০ সালে ৮ সেপ্টেম্বর সন্তোষে অনুষ্ঠিত এক সুবিশাল সম্মেলনে মওলানা ভাসানী 'আমার পরিকল্পনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়' শিরোনামে একটি লিখিত নিবন্ধে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত প্রস্তাব পেশ করেন।

ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন:

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ১২ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে অধ্যাপক ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্য নিয়োগ পান এবং তিনি ৫ মাস দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের ১২ জুলাই মহান জাতীয় সংসদে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়।

শিক্ষা কার্যক্রম:

২০০২ সালে ২১ নভেম্বর উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বিশিষ্ট সমুদ্রবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. ইউসুফ শরীফ আহমেদ খান । উপাচার্যে নিয়োগর পর ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এ দুটি বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়।২০০৩ সালের ২৫ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে দুইটি বিভাগে সর্বমোট ৭৫ জন শিক্ষার্থী এবং ৫ জন শিক্ষক নিয়ে একাডেমিক যাত্রা শুরু হয়।এর ঠিক ৮ মাস পর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ও ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স নামে দুটি নতুন বিভাগ খোলা হয় লাইফ সায়েন্স অনুষদের অধীনে।যার মধ্যে দিয়ে অপরাধ বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলাদেশে একাডেমিক ভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সূচনা হয়।বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭টি অনুষদের অধীনে ২০টির অধিক বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করা হয় এবং প্রায় ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী নিয়মিত অধ্যয়ন করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো:

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো সমূহের মধ্যে রয়েছে ৩টি এ্যকাডেমিক ভবন , ২টি প্রশাসনিক ভবন, ৪টি ছাত্র হল , ৩ টি ছাত্রী হল, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত মেডিকেল সেন্টার, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সুবিধার্থে হাজার হাজার বই সম্বলিত ৫ তলা বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসিক সুবিধার জন্য রয়েছে ৩ টি কোয়ার্টার ,অতিথি ভবন। উপাচার্যের বসবাসের জন্য রয়েছে বাংলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন:

 বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারকে সমুন্নত রাখতে কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক, সৃজনশীল ও সাহিত্য সংগঠন।এসব সংগঠনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুলো হলো, ধ্রুবতারা কালচারাল ক্লাব, মাভাবিপ্রবি ফিল্ম সোসাইটি, মাভাবিপ্রবি ডিবেটিং সোসাইটি ,রোটারেক্ট ক্লাব অব মাওলানা ভাসানী, মাভাবিপ্রবি বিজ্ঞান ক্লাব, মাভাবিপ্রবি ক্যারিয়ার ক্লাব, প্রথম আলো বন্ধুসভা, মাভাবিপ্রবি লিও ক্লাব,ফটোগ্রাফিক সোসাইটি,গ্রীন ক্লাব, রক্তদান সংগঠন বাঁধন, নৃত্যধারা,কাম ফর রোড চাইল্ড, মাভাবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি, মাভাবিপ্রবি সাহিত্য সংসদ।

ইতিহাস ঐতিহ্যে মাভাবিপ্রবি ক্যাম্পাস:

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাটি শুধুমাত্র একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস নয়। এ ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে, অলি-গলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মওলানা ভাসানীর স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য নিদর্শন। আছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি স্মারক শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্মারক প্রত্যয় ৭১, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি স্তম্ভ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ম্যুরাল। ক্যাম্পাসে মওলানা ভাসানীর স্মৃতিজড়িত দরবার হল, মাজার শরীফ, সুউচ্চ মিনার সম্বলিত বিশাল আকৃতির কারুকাজমণ্ডিত একটি মসজিদ, একটি মুসাফির খানাসহ চারটি স্কুল, একটি কলেজ, একটি স্বাস্থ্যক্লিনিক, এতিমখানা ও একটি মাদ্রাসা রয়েছে। সাড়ে তিনশত বছরের প্রাচীন। পীর শাহজামান দিঘীসহ বিশ্বাবদ্যালয় ক্যাম্পাস ও তার আশে পাশে প্রায় ডজনখানেক পুকুর রয়েছে, যা সহজেই দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে।

শিক্ষার্থী ও গবেষণায় সাফল্য:

দেশের গবেষণা খাতে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। চলতি বছরে প্রকাশিত স্পেন‌ ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিমাগো ইন্সিটিউট দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১ম ও সারাদেশে ৫ম স্থান অর্জন করে। এছাড়া চলতি বছরের জুন মাসে প্রকাশিত অ্যালপার ডগার (এডি) সায়েন্টিফিক ইনডেক্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিশ্বসেরা গবেষকদের তালিকায় স্থান পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৫ জন গবেষক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।গত বছর যা ছিলো ১১৯ জন। এছাড়া 
ওয়েবমেট্রিক্স র‍্যাংকিং-২০২৪ এ দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তৃতীয় এবং সব (পাবলিক ও প্রাইভেট) উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৬তম স্থান অর্জন করেছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (নাসা) এ কর্মরত এবং ইনফরমেশন ও কমিনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন শিক্ষার্থী বর্তমানে গুগলে কর্মরত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ারুল আজীম আখন্দ বলেন,বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীবান্ধব ও শিক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। যেহেতু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তাই দেশের জন্য উপযোগী রিসার্চ,যা দেশীয় সমস্যার সমাধানে কাজে আসবে এসব ক্ষেত্রে কাজ করতে চাই। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলের পরিবেশ উন্নত করা,ক্লাস রুম সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কাজ করবো।

যাযাদি/ এসএম