কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান এবং এক পর্যায়ে সরকারের পতন। এই আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক ছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ।
পুলিশের গুলিতে তার নিহত হওয়ার পর থেকেই সারাদেশে আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তী ১৫ বছর ধরে এটি আওয়ামী লীগের শাসনামলের মধ্যেই ছিল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের প্রভাব এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরও পড়েছে, যার ফলে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আওয়ামী লীগের সরকারের ও প্রশাসনের সমালোচনা করতেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে কোণঠাসা ছিলেন এবং বিভিন্নভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন।
এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াছ প্রামাণিক। সরকার পতনের পর তিনি একটি নতুন, দুর্নীতিমুক্ত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখেন। তার এক বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক যায়যায়দিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি গাজী আজম হোসেন।
যায়যায়দিন: জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে আপনি কিভাবে দেখেন?
যায়যায়দিন: এই গণঅভ্যুত্থান থেকে আমাদের কী শিক্ষা নেওয়ার আছে?
ড. মো. ইলিয়াছ প্রামাণিক: জুলাইয়ের বিপ্লব থেকে আমাদের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো মানুষের প্রতি সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে, যেন নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়।
যায়যায়দিন: গত ১৫ বছরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কি যথেষ্ট অগ্রগতি করেছে?
ড. মো. ইলিয়াছ প্রামাণিক: গত ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি তেমন হয়নি, বরং আমাদের চেয়ে আগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। আমাদের সমসাময়িক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় যে বাজেট তারা পায়, আমরা তা পাই না। সরকারের রংপুর অঞ্চলের প্রতি একটি অবজ্ঞা ছিল, যা বাজেট বরাদ্দে স্পষ্ট। আগের ভাইস চ্যান্সেলররাও বাজেট বৈষম্যের বিরুদ্ধে তেমন কিছু বলেননি। যেমন, জলিল স্যার তার আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দিয়েছেন, এরপর নূরনবী স্যার ঝুলন্ত নিয়োগগুলো চূড়ান্ত করে তাদের স্থায়ী করেছেন। আর কলিমুল্লাহ স্যার তো ক্যাম্পাসেই আসতেন না, রাতে ক্লাস নিতেন এবং ঢাকায় লিঁয়াজো অফিস করতেন। পরপর প্রশাসনের অবজ্ঞার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যেতে পারেনি। অথচ 'রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়' নিয়ে ৯০-এর দশকে যে আন্দোলন হয়েছিল, তার পেছনে রংপুর অঞ্চলের মানুষের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ১৫ বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট দল ক্ষমতায় থাকায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
যায়যায়দিন: বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা মেগা প্রকল্পগুলো এবার কি আলোর মুখ দেখবে?
ড. মো. ইলিয়াছ প্রামাণিক: এখানে কিছু জটিলতা আছে, প্রকল্পগুলো যে কাঠামোতে এসেছে, অন্য কোনো ভাইস চ্যান্সেলর আসলে সেটি পরিবর্তন করে দেন। এভাবে বিষয়টি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে গেছে। এখন একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে আরেকটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় না মন্ত্রণালয়। শেখ হাসিনা হল, ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতো ভবনগুলো এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। আমরা নতুন ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে দাবি জানাবো, হয় কাজ শেষ করবেন, নতুবা ভবনগুলো ভেঙে ফেলবেন। একটি প্রকল্পের কারণে যেন অন্য প্রকল্পগুলো আটকে না থাকে।
যায়যায়দিন: ১৫ বছরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কি পুরোপুরি দলীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে?
ড. মো. ইলিয়াছ প্রামাণিক: শুধু দলীয় নয়, চরম দলীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি তারা আওয়ামী লীগের আদর্শের অনুসারী না হন, তাহলে চাকরি পাওয়া কল্পনাও করা যেত না। নিয়োগের আগে বিভিন্নভাবে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই করা হতো। চাকরি পাওয়ার পর ভিন্ন মতাদর্শের হলে তাদের চাকরি আটকে দেওয়ারও ইতিহাস রয়েছে।
যায়যায়দিন: নতুন ভাইস চ্যান্সেলর আসলে তার কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
ড. মো. ইলিয়াছ প্রামাণিক: জুলাইয়ের বিপ্লব ছিল একটি সংস্কারের বিপ্লব। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে কেউ এই আন্দোলন করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব জায়গায় মেধার পরিবর্তে আদর্শের ভিত্তিতে বিচার করা হয়েছে। যদি আপনি তাদের আদর্শের না হন, তবে যত মেধাবীই হন, তাদের কাছে আপনি মূলহীন। আমরা আশা করি, যিনি নতুন ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে আসবেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারের কাজ করবেন। তিনি শুধু একজন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নয়, সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, ও কর্মচারী সবার ভাইস চ্যান্সেলর হবেন। পাশাপাশি, আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।
যায়যায়দিন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ড.মো.ইলিয়াছ প্রামাণিক: আপনাকেও ধন্যবাদ।
যাযাদি/ এসএম