মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

রাজপথে আবার সংঘর্ষ লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস

যাযাদি রিপোর্ট
  ৩০ জুলাই ২০২৪, ০৯:২৪
ছবি-যায়যায়দিন

এবার কোটা সংস্কার নয়, বরং এই ইস্যুতে শুরু হওয়া আন্দোলন ঘিরে গত কয়েকদিনে নির্বিচারে গুলি ও হত্যার পর নতুন করে গণহারে গ্র্রেপ্তার এবং আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকে রেখে জোরপূর্বক বিবৃতি আদায়ের প্রতিবাদে ফের মাঠে নেমেছে শিক্ষার্থীদের একাংশ।

সোমবার সকাল থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহীসহ দেশের ১৩ জেলায় অন্তত ২০টি স্থানে জড়ো হয়ে রাজপথ দখলের চেষ্টা চালায় তারা। এতে বাধা দেওয়ায় বেশ কয়েকটি স্পটে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ এবং রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুলিশ। শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নতুন করে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারেÑ এই আশঙ্কায় সোমবার সকাল থেকে আন্দোলনের হটস্পট হিসেবে পরিচিত প্রতিটি পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আকাশে টহল দেয় র‌্যাবের হেলিকপ্টার। জোরদার করা হয় বিজিবির টহল। এ ছাড়া সারাদেশে গোয়েন্দা নজরদারি আরও একধাপ বাড়ানো হয়েছে।

র‌্যাব ও পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীরা রাজপথ দখলে নেওয়ার পর তাদের তুলে দিতে বলপ্রয়োগ না করে, এবার তারা জড়ো হওয়ার আগেই ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার ‘স্ট্যাটিজি’ নেওয়া হয়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা কখন কোন স্পটে জড়ো হওয়ার পরিকল্পনা করছে, সে তথ্য আগাম সংগ্রহ করে সেখানে বিপুল সংখ্যক ফোর্স মোতায়েনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা আকস্মিক কোথাও জড়ো হয়ে রাস্তা অবরোধ করলে তাদের শক্তহাতে প্রতিহত করা হবে। কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা হামলার চেষ্টা চালালে তাকে তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করবে পুলিশ।

এদিকে সোমবার দুপুরে রাজধানীর মিরপুর ১০, ইসিবি চত্বর ও ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। ইসিবি চত্বরে জড়ো হওয়া একদল বিক্ষোভকারীকে লাঠিপেটা করে সরিয়ে দেয় পুলিশ।

ডিএমপি সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণার পর রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়।

এর আগে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় শিক্ষার্থীদের চলমান কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এরপরই অন্য সমন্বয়কদের মধ্যে কয়েকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গতকাল বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে এই আন্দোলন চলমান থাকবে বলে জানান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকার আটটি স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি হবে বলে জানানো হয়েছিল। এই আট স্থান হচ্ছে- সায়েন্স ল্যাব, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ নম্বর গেট, জাতীয় প্রেস ক্লাব, উত্তরার বিএনএস সেন্টার, মিরপুর-১০, মিরপুরের ইসিবি চত্বর, রামপুরা ও মহাখালী।

বিক্ষোভ কর্মসূচির সময় মিরপুর ১০ নম্বরের গোলচত্বর থেকে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সি ছাব্বীর আহম্মেদ। ধানমণ্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে ১০ জনকে আটকের কথা জানিয়েছেন নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার মো. রেফাতুল ইসলাম। পুলিশ জানায়, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ইসিবি চত্বরে কয়েকজন বিক্ষোভকারী গলি থেকে ইটপাটকেল ছুড়ছিল। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। এ সময় সেখান থেকে কয়েকজনকে আটক করা হয়। রাজধানীর বেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সামনে প্রতিবাদে সমাবেশ করেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে ৯ দফা দাবি আদায়ে এই সমাবেশ করেন তারা।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে সমাবেশ করার কথা থাকলেও পুলিশি বাধায় ডিআরইউ’র সামনে কর্মসূচি পালন করতে হয়েছে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। সমাবেশে শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি আদায় না হলে রাজপথে থাকার ঘোষণা দেন। তারা গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানান।

এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিবৃতিতে প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাইলে আমরা সকাল থেকে দেখেছি পুলিশ, বিজিবি বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়েছে। ছাত্রদের তারা বিভিন্নভাবে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া করছে। রাতের বেলা তারা প্রত্যেক মেসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হেনস্থা করছে। তারা মোবাইল চেক করছে। এই অধিকার তাদের কে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আটক করছে, গ্রেপ্তার করছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’

যে পর্যন্ত আমাদের ৯দফা আদায় না হচ্ছে সে পর্যন্ত আমরা রাজপথ ছাড়ব না। অবিলম্বে সব রেইড বন্ধ করতে হবে। বিজিবি, সেনাবাহিনী রাজপথ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। এ সময় কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানান ওই শিক্ষার্থী। ডিবি কার্যালয়ে কোটা আন্দোলনের নেতাদের আটকে রেখে জোরপূর্বক আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহারের অভিযোগ করে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘রোববার রাতে যে নাটক সাজানো হলো, তা ছাত্রসমাজ বুঝে গেছে।’

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিজিবি, র‌্যাব,পুলিশসহ সশস্ত্র বাহিনী নামিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়ে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ চোখ হারিয়েছে, পঙ্গুত্ববরণ করেছে, অনেকের মৃত্যু হয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। এটা সমাজের ওপর ফ্যাসিস্ট আক্রমণ। এর প্রতিবাদে আমরা আমাদের ৯ দফা দাবি জানিয়েছি। সে দাবি না মানা পর্যন্ত আমরা রাজপথ থেকে সরবো না’।

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষার্থীদের আটক-গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের ছত্রভঙ্গ করতে ছোড়া সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেলের আঘাতে অন্তত তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে বিক্ষোভরত অন্তত ১০ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ জোন) মোস্তাফিজুর রহমান।

পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে নগরীর জামালখান এলাকায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ করার কথা ছিল। এর আগে, দুপুর ১২টার দিকে ওই এলাকায় পুলিশ ও বিজিবি অবস্থান নেয় এবং সেনাবাহিনী টহল দেয়। এ ছাড়াও নগরীর বিভিন্ন মোড়ে নতুন করে তল্লাশি চৌকি বসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যেই বিকাল ৩টার দিকে চেরাগীর মোড়ে জড়ো হন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের প্রায় ১০০ শিক্ষার্থী।

তখন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর শৈবাল দাস সুমনের নেতৃত্বে প্রায় ১০০-১৫০ ছাত্রলীগ-যুবলীগকর্মী সেখানে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। তারা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বিভিন্ন স্লোগান দিলে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয় এবং একপর্যায়ে হাতাহাতিও হয়। এ সময় যুবলীগ কর্মীরা ৪-৫ জন শিক্ষার্থীকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আন্দোলরত শিক্ষার্থীরা আটককৃতদের ছোটাতে গেলে তাদের সঙ্গে পুলিশের হাতাহাতি হয়। পুলিশ সে সময় লাঠিচার্জ শুরু করলে শিক্ষার্থীরা রাস্তার অন্য পাশে সরে গিয়ে বসে অবস্থান নেয় এবং বিভিন্ন স্লোগান দেয়। বিকাল ৪টার দিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করে। এগুলো ছোড়ার সময় তিন পুলিশ সদস্য মাথায়, চোখে গুরুতর আঘাত পান। তারা হলেন- কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার অতনু চক্রবর্তী, এসআই মোশারফ হোসেন হাবিব ও এসআই মেহেদী হাসান শুভ। এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আশপাশের অলিগলিতে ছড়িয়ে গেলে, পুলিশ সেখানে তল্লাশি চালায়। সে সময় ৬-৭ জন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়।

এরপর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলে বিকাল ৫টার দিকে পুলিশ ফিরে যাওয়ার সময় আন্দরকিল্লা মোড়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে একদল বিক্ষোভকারী। সেখানেও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের আরেক দফা সংঘর্ষ হয় এবং পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

জানতে চাইলে উপকমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কারফিউ চলছে, এ অবস্থায় বিক্ষোভ মিছিল, সভা নিষিদ্ধ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে অন্তত ১৫ জন সাধারণ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। সোমবার দুপুর ২টায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ব্যানারে রাজনীতি করেন এমন শিক্ষার্থীরা লাঠি, রড, পাইপ নিয়ে এই হামলা চালান। আহতদের মধ্যে ৯ জনকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বরিশাল শাখার সমন্বয়ক সুজয় শুভ বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পক্ষে গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। কিন্তু কিছু পত্রিকায় উল্টো সংবাদ আসে। এ নিয়ে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এ কে আরাফাতের নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জন লাঠিসোটা নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়। হামলাকারীরা বেধড়ক পিটিয়ে অন্তত ১৫ জনকে আহত করে। সুজয় শুভ বলেন, আহতদের মধ্যে মাহামুদুল হাসান, সুজন মাহামুদ, শর্মিলা জাহান ও সিরাজুল ইসলামের আঘাত কিছুটা গুরুতর।

এদিকে হামলার সময় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রহমান বলেন, হামলার খবর শুনে তারা উপস্থিত হয়ে ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনেন। যতদূর শুনেছেন, আন্দোলনের পক্ষের ছাত্রদের সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের হাতাহাতিতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আহতদের মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম, খুনের প্রতিবাদে সরকারি বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা সোমবার দুপুরে বিক্ষোভ করেছেন। ক্যাম্পাস থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে তারা নগরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদ এলাকায় যান। পরে বিক্ষোভকারীদের সেখানে আটকে দেয় পুলিশ। তখন তারা সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। সমাবেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, যত দিন গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম, খুন চলবে, তত দিন আন্দোলন চলবে। ৯ দফা দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে তারা এই কর্মসূচি শুরু করেন।

এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে জড়ো হতে থাকেন। এরপর ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়লে স্লোগান শুরু হয়। এ সময় পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন কয়েকজন শিক্ষক। তাদের মধ্যে ছিলেনÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ছাইফুল ইসলাম এবং সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জামিলুর ইসলাম।

শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বক্তব্য রাখেন। তিনি ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবির কথা তুলে ধরেন। মেহেদী সজীব বলেন, ‘আমরা শান্ত ছিলাম। আমাদের ভাইদের বুকে গুলি চালিয়েছে। আমরা সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছি। সারাদেশের ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রজাতন্ত্রের চাকর, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে। কিন্তু শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের টাকায় কেনা গুলি আমাদের ছাত্রদের বুকে চালিয়েছে। এসবের প্রতিবাদে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি।’

শিক্ষকদের পক্ষ থেকে সেখানে বক্তব্য রাখেনÑ ইফতিখারুল আলম মাসউদ ও সালেহ হাসান নকীব। অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। যে ঘটনা ঘটে গেছে, তা নৃসংশ। যেভাবে ঠান্ডা মাথায় মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, এর সঙ্গে যে অরাজকতা শুরু হয়েছে রাষ্ট্রজুড়ে, এতে শুধু আমরা ব্যথিত নই, অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ। শিক্ষার্থীরা ন্যায়ের পথে আছে। তারা সারাজীবনই ন্যায্যতার পক্ষে থাকবে। শিক্ষার্থীদের সাহস ও দৃঢ়তা দেখে শিক্ষক হিসেবে আমি গর্বিত।’

শিক্ষকদের বক্তব্য শেষ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত কর্মসূচি শেষ করার তাগাদা দেয়। পরে শিক্ষার্থীরা জানান, তারা সেখানে থেকে বিনোদপুরে গিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শেষ করবেন। বিপুলসংখ্যক পুলিশঘেরা অবস্থায় শতাধিক শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে যান। পরে দুপুর পৌনে ১টার দিকে কর্মসূচি শেষ হয়। কর্মসূচি শেষ করার আগে সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, কেন্দ্র থেকে যেসব কর্মসূচি দেওয়া হবে, তারা সেসব কর্মসূচি পালন করবেন।

এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মোহাম্মদ হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে কর্মসূচি পালন করেছেন। তারা শান্তিপূর্ণ ছিলেন। তারাও চাননি কোনো ধরনের সংঘাত, শিক্ষার্থীরাও চাননি। কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন, তারা ছাত্রদের বুঝিয়েছেন। পুরো রাজশাহীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।

এদিকে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে করা বিক্ষোভে বাধা দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সোমবার দুপুর ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন ছাত্র আন্দোলন চত্বরে তাদের বাধা দেওয়া হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সেশনের মারুফ শেখ এবং নারী শিক্ষার্থী একা তালুকদার হেনস্তার শিকার হন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আন্দোলনে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েকজন শিক্ষার্থী মারধর ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। তারা অভিযোগ করেন, ১০ জনের অধিক শিক্ষার্থী মারধরের শিকার হয়েছেন।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহীর নেতৃত্বে আবু সাদাৎ মো. সায়েম ও ইকবাল খানসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ছাত্র আন্দোলন চত্বর ও ব্লুু ওয়াটার পার্কে রাস্তার মোড়ে হামলা চালায়। দুপুরের পর থেকে কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশা ক্যাম্পাস মুখে আসলে থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা। আন্দোলনে যাচ্ছে বললে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বললে ফেরত পাঠিয়ে দেন তারা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য আছে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা সেখানে বিশৃঙ্খলা করতে পারে। তাই কেন্দ্রের নির্দেশে সেখানে অবস্থান নিয়েছি, যেন কেউ বিশৃঙ্খলা করতে না পারে।’

নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীতে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার বিকাল ৩টা থেকে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী নোয়াখালী জিলা স্কুলের সামনে শহরের প্রধান সড়ক (চার লেনের সড়ক) বন্ধ করে ওই সমাবেশ শুরু করেন। সমন্বয়কদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি, দমন-নিপীড়ন বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবার পদত্যাগের দাবিতে ওই কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। এতে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বিকাল ৩টার কিছু আগে থেকেই জিলা স্কুলের আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হতে থাকেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বিকাল ৩টার দিকে তারা জিলা স্কুলের সামনের সড়কে দাবি-সংবলিত ব্যানার নিয়ে অবস্থান নেন। এ সময় কিছু শিক্ষার্থীর হাতে লাঠি ও জাতীয় পতাকাও দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা এ সময় কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে স্লোগান দেন। শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি শুরুর আগে জিলা স্কুলের সামনের সড়কে পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যদের অবস্থান করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে সেখানে যান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তার সঙ্গে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ সুপার তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তখন শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কিছু সময় সড়কে অবস্থান ও বিক্ষোভ সমাবেশ করার কথা বলেন। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালনে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়। একপর্যায়ে বিকাল ৩-১০ মিনিটে পুলিশ সুপার তার সদস্যদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের সমাবেশস্থল থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচির কারণে শহরের প্রধান সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কিছু কিছু যানবাহন বিকল্প পথে চলাচল করছে।

শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, শিক্ষার্থীরা বলেছেন, তারা আধ ঘণ্টা সড়কে অবস্থান করে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবেন। সে জন্য তাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে বাধা দেবে না। পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। তিনি নিজেই সড়কে অবস্থান করে বিষয়টির প্রতি নজর রাখছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ৯ দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিল শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে সমাবেশ করেন তারা।

সমাবেশে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের ‘জিম্মি’ করে আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়েছে দাবি করে ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জোরালোভাবে চারটি দাবির কথা উল্লেখ করেন।

দাবিগুলো হলোÑ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি, কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের ওপর নৃশংস অত্যাচারের বিচারসহ আটক ও গ্রেপ্তারকৃতদের দ্রুত মুক্তি, আন্দোলন চলাকালে নিহতদের হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থীদের ওপর মামলা এবং গণগ্রেপ্তার বন্ধ করা।

সোমবার বিকাল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের সামনে মহুয়াতলায় জড়ো হন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। সমাজবিজ্ঞান ভবনের সামনে দিয়ে ঘুরে পুনরায় শহীদ মিনার চত্বরে এসে শেষ হয়। সমাবেশে তারা বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে জোরালোভাবে চারটি দাবির কথা উল্লেখ করেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার সমন্বয়ক আহসান লাবিব বলেন, ‘আমরা একটি যৌক্তিক, ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম কোটা সংস্কার করা হোক। মেধাবীদের অধিকার নিশ্চিত করা হোক। একটি সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক। এই আন্দোলন সরকার বা কোনো দলের বিরুদ্ধে ছিল না। কিন্তু পরে আমাদের ওপর ছাত্রলীগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্মমভাবে হামলা চালিয়েছে। যার নির্দেশে এগুলো হয়েছে, সেই স্বৈরাচারী সরকারকে এর জবাব দিতে হবে।’

ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, ‘আমি একজন শিক্ষক। আমার যে শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হয়েছে, আমি তার বিচার চাই। আমি চাই শিক্ষার্থীরা নিরাপদে ঘুমাক, নিরাপদে থাকুক, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসুক, ক্লাসে ফিরে আসুক।’

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সোমবার বিকাল ৩টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে শতাধিক শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন শুরু করেন।

জানা গেছে বিক্ষোভের সময় শিক্ষার্থীরা ‘স্বৈরাচারের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে’, ‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’ সহ নানা স্লোগান দিতে থাকেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান নেয় পুলিশ ও বিজিবি। এ ছাড়াও নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানে রয়েছে সেনাবাহিনীও। পরে বিকাল সাড়ে ৪টায় শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটক থেকে একটি মিছিল বের করে কর্মসূচি শেষ করেন। বগুড়ায় পুলিশের বাধা ভেঙে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। শিক্ষার্থীদের গুলি করে হত্যা, গণগ্রেপ্তার ও সমন্বয়কদের আটকের প্রতিবাদে সোমবার বিকালে তারা ওই বিক্ষোভ মিছিল করেন। বিক্ষোভের আগে শহরের সাতমাথাসহ বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের রূপা আক্তারসহ রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্ত ১০ শিক্ষার্থীকে পুলিশ আটক করে।

আন্দোলনকারীরা শহরের জলেশ্বরীতলা কালীবাড়ি মন্দির মোড় থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বাকী সড়ক হয়ে জেলখানা লাবাম্বা মোড় থেকে আবারও কালীবাড়ি মোড়ে ফিরে এসে রহমানিয়া সিটির সামনে শহীদ আবদুল জব্বার সড়ক অবরোধ করে সমাবেশ করেন। এ সময় শহীদ আবদুল জব্বার সড়ক ছাড়াও রোমেনা আফাজ সড়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বাকী সড়ক ও জলেশ্বরীতলা নূর মসজিদ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

তবে পুলিশ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, মিছিলে বাধাও দেয়নি। সমাবেশে শেষে সেখানে উপস্থিত বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুর রশিদ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা মিছিল শেষে কাউকে হয়রানি ও গ্রেপ্তার না করার অনুরোধ জানান।

ঠাকুরগাঁওয়ে কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার দুপুর ১২টার দিকে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে এই কর্মসূচি পালন করে।

স্থানীয়রা জানান, সকাল ১০টা থেকে ওই বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। এরপর দুপুর ১২টার দিকে কালো পতাকা হাতে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের চৌরাস্তার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পথে বাধা দেয় পুলিশ। ওই সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে সড়কের এক পাশে অবরোধে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

জেলার কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মী হাবিবুল্লাহ সুমন বলেন, ‘অধিকার আদায়ের জন্য সারাদেশের ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই আন্দোলন ঠেকাতে একটি গোষ্ঠী অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এই আন্দোলন ঠেকাতে শিক্ষার্থীদের বুকে গুলিও চালানো হয়েছে। সারাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত হওয়ার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত, বিচারসহ ৯ দফা দাবিতে আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছি।’

ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ বি এম ফিরোজ ওয়াহিদ বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের বুঝিয়েছি। তারা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ পালন করতে চাইলে তাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের জিম্মি করে বিবৃতি নেওয়ার প্রতিবাদে যশোরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়েছে। সোমবার বিকালে যশোর শহরের কারবালা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এর আগে শিক্ষার্থীরা জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করলে এক শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। তবে তাৎক্ষণিকভাবে আটক শিক্ষার্থীর নাম জানা যায়নি।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের পুলিশি নিপীড়ন ও সমন্বয়কদের জিম্মি করে জোর করে কর্মসূচি প্রত্যাহারের বিবৃতি নেওয়ার প্রতিবাদে বিকালে শহরের ধর্মতলা মোড় থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি কারবালা এলাকায় পৌঁছলে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মিছিলে বাধা দেয়। শিক্ষার্থীরা মিছিলটি দড়াটানা মোড় পর্যন্ত নিতে চান। তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশের বাধায় মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রাশেদ খান বলেন, জোর করে সমন্বয়কদের কাছ থেকে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি আদায় করা হয়েছে। সারাদেশে দমন-পীড়নের মাধ্যমে ছাত্রদের আন্দোলন আটকানো চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না।

ময়মনসিংহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীদের নামতে দেওয়া হয়নি। সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। কিন্তু পুরো শহর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও অবস্থান ছিল বিভিন্ন পয়েন্টে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘটিত ‘গণহত্যার বিচার, মিথ্যা মামলা ও হয়রানি’র প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি দেওয়া হয়। নগরের গাঙ্গীনারপার মোড়সংলগ্ন শহীদ ফিরোজ জাহাঙ্গীর চত্বরে কর্মসূচির জায়গা নির্ধারণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক প্যানেল। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে তাদের জমায়েত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে বিকাল ৩টার আগেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয়।

বিকাল পৌনে ৪দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহসমন্বয়ক তানজিল হোসেন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষার্থী ঐশ্বর্য সরকারসহ চারজন ফিরোজ জাহাঙ্গীর চত্বরে যান। তারা নিজেদের কর্মসূচি পালন করতে পুলিশের কাছে সহযোগিতা চান। ওই সময় পুলিশ তাদের সেখান থেকে সরে যেতে বলে। আন্দোলনকারীরাও পুলিশের সঙ্গে মিনিট-পাঁচেক বাগ্বিতণ্ডা করে সেখান থেকে সরে যান। যাওয়ার সময় কর্মসূচি করতে না দেওয়ার প্রতিবাদ জানান তারা।

ঐশ্বর্য সরকার বলেন, ‘আমাদের যে ভাইয়েরা শহীদ হয়েছেন, সেই রক্তের জবাব চাই। আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম, কিন্তু পুলিশ আমাদের সরিয়ে দিয়েছে। আমরা এ ঘটনায় ধিক্কার জানাই। ঢাকাসহ সারাদেশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন চেক করে যে হয়রানি করা হচ্ছে, এর তীব্র নিন্দা জানাই। নাগরিক হিসেবে এটি তীব্র অসম্মানের। রাষ্ট্রের যে চুক্তি জনগণের সঙ্গে, তা ভঙ্গ করা হয়েছে।’ ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শাহীনুল ইসলাম ফকির বলেন, ‘ছাত্রদের যে যৌক্তিক দাবি ছিল, সেগুলো সরকার মেনে নিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের নিয়মিত আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারও করে নিয়েছে। কয়েক দিন আগে দুষ্কৃতকারীদের মাধ্যমে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। এর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, জনগণ যেন স্বস্তির সঙ্গে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন, সে জন্য কয়েক দিন ধরেই পুরো শহরকে নিরাপত্তার চাদরে রেখেছি। নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই আমরা এখানে টহল দিচ্ছি।’

এদিকে শুধু ফিরোজ জাহাঙ্গীর চত্বর নয়, নগরের মিন্টু কলেজ এলাকা, টাউন হল মোড় এলাকাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ, এপিবিএন, র‌্যাব ও বিজিবির টহল ও অবস্থান ছিল। নগরের মিন্টু কলেজ এলাকায় সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমানের সমর্থকদের অবস্থান ছিল। টাউন হল এলাকায় রওশন এরশাদের বাসার সামনের এলাকায় অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েকশ’ নেতাকর্মী। সেখানে উপস্থিত ছিলেনÑ নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি মেয়র মো. ইকরামুল হক এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেনসহ দলীয় নেতাকর্মীরা। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বিবৃতি আদায়, গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে লক্ষ্মীপুরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।

সোমবার বিকাল ৪টা থেকে জেলা শহরের মাদাম ব্রিজ এলাকায় ঘণ্টাব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে লক্ষ্মীপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যানজট সৃষ্টি হয়। পরে আন্দোলনকারীদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ।

এ সময় নাফিস আহমেদ ইকরাম নামের এক কলেজছাত্রকে আটক করা হয়। তার ব্যাগে হাতুড়ি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আটক ইকরাম লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র।

জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা বিকাল ৩টা থেকে লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের ঝুমুর ও মাদাম ব্রিজ এলাকায় জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। বিকাল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত তারা লক্ষ্মীপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করে মাদাম ব্রিজ এলাকায় বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। এতে দুই পাশে যানজট সৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগানে মুখরিত করে তুলেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) হাসান মোস্তফা স্বপন বলেন, কোটা আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিয়ে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়েছে। পরিস্থিতিও স্বাভাবিক রয়েছে। ইকরাম নামের এক শিক্ষার্থীর ব্যাগে হাতুড়ি পাওয়া গেছে। তাকে আটক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে