যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) ফিশারীজ এন্ড মেরিন বায়োসায়েন্স (এফএমবি) বিভাগের ২য় বর্ষের ২য় পর্বের ফিজিক্যাল ওশানোগ্রাফি কোর্সের প্র্যাকটিক্যালের অংশ ছিলো কুয়াকাটা শিক্ষা সফর। উদ্দেশ্য ছিলো সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে বাস্তবিক ধারণা লাভ করা। গতবছর হরতাল-অবরোধের জন্য প্রায় অনিশ্চিত ছিলো এই ভ্রমণ। অনেক আলোচনার ঝড়-ঝঞ্ঝার পর পহেলা ফেব্রুয়ারীর দিন ঠিক হলো ০৫ ফেব্রুয়ারী যাবো কুয়াকাটা। ট্যাুরে যাওয়ার দিন ওশানোগ্রাফি কোর্সের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আমিনুর রহমান স্যার আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেন। গত মঙ্গলবার (০৫ ফেব্রুয়ারী) রাত সাড়ে নয়টায় ক্যাম্পাস থেকে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। এই শিক্ষা সফরে অধ্যাপক ড. আমিনুর রহমান স্যার, স্যারের স্ত্রী, এফএমবি বিভাগের সেকশন অফিসার বিনোদ দাদা ও তাঁর স্ত্রী-সন্তান, আমাদের এফএমবি-১৩ ব্যাচের ৩৩ জন শিক্ষার্থীসহ মোট ঊনচল্লিশ জন ছিলাম ।
ভোর সাড়ে পাঁচাটায় কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টে পৌঁছে যায় আমরা। হোটলে সবাই নিজেদের ব্যাগপত্র রেখে চলে যায় বীচে। প্রথমেই সূর্যোদয় দেখার পরিকল্পনা ছিলো আমাদের, কিন্তু ঘন কুয়াশায় সূর্যের দেখা মেলেনি দুপুর পর্যন্ত। সমুদ্রের তীরে ফুটবল খেলা, গোসল আর ফটোগ্রাফির মধ্য দিয়ে শেষ হয় প্রথম দিনের প্রথম অংশ। তারপর একটি হোটেলে রুপচাঁদা আর পোয়া মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার শেষে আড়াইটার সময় ফাতরার বনের উদ্দেশ্যে প্রথমে ডিঙি নৌকায় তারপর বড় বোটে করে রওয়ানা দিলাম। সমুদ্রের স্নিগ্ধ হাওয়ায় সবাই ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কেউবা ধরেছে গান, কেউবা তাদের অনুভূতিগুলো শেয়ার করছে একে অপরের কাছে। আমিনুর রহমান স্যারের বয়স হলেও সমুদ্রের প্রতি তাঁর যেনো যৌবন রয়ে গেছে। আন্টির অনেক বাঁধার পরও বোটের শেষ মাথায় চলে যায় ফটোশপ করতে, সমুদ্রের স্নিগ্ধ-শীতল হাওয়া উপভোগ করতে। সমুদ্রের মাঝে মাছের ট্রলার দাড়ানো দেখে আমাদের বোট থামিয়ে তাদের জীবন-যাপন ও মাছ ধরার অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছুক্ষণ বর্ণনা শুনি ও স্যাম্পল কালেকশনের জন্য তাদের থেকে কয়েকটি কাঁকড়া কিনে নেয়। এরপর তিন নদীর মোহনা পেড়িয়ে চলে এলাম ফাতরার বনে। বনের প্রবেশপথে স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আমিনুর স্যারের সাথে গ্রুপ ফটোশপ করি। তারপর বনের ভেতর হারিয়ে যায় লবণাক্ত বন্য প্রকৃতিতে চেনা-জানার জন্য। তন্ময়, আদিব, আফ্রিদি, বশির, মন্ময়, সিয়ামসহ আমরা চলে আসি সবাইকে ছাড়িয়ে অনেক দূর । একে-অপরের মাঝে আলোচনা চলছে 'আমরা এ বনেই থেকে যাবো, এ বনেই বাস করবো কুড়েঘর বানিয়ে।' আলোচনার ছেদ ঘটালো এক বন্ধুর ফোন কলে, 'তোরা কোথায় বোট ছেড়ে দিবে, চলে আয়'। যদিও সবসময়ই আমি তাগাদা দিতাম সবাই যেনো যথাসময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুরাফেরা শেষ করে চলে আসে । ফাতরার বনের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আমরা কয়েকটি ফুল ও শ্বাসমূল নিয়ে আসি সাথে করে। আনন্দ বাড়িয়ে তোলার জন্য বন্ধুরা মিলে বিভিন্ন পশুপাখির ডাক দিতে থাকি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় চলে যেতে হবে স্মৃতিময় ফাতরার বন থেকে। বোটে উঠার পর দেখি আমরা এই কয়জন নয় আরও অনেকেই ফাতরার বনে সময় কাটাতে চায়। সমুদ্রের স্নিগ্ধ-কোমল হাওয়ায় বোটের মধ্যে সাগরকন্যার বুকে ঘুমিয়ে পড়ি কয়েকজন। তীরে চলে আসলেও আমাদের মন যেনো ছিলো ফাতরার বনে।
সন্ধ্যায় বিশ্রামের জন্য আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। আর এদিকে আমিনুর রহমান স্যার ও আন্টি চলে যায় বীচের পাশে মাছ বাজারে স্যাম্পল কালেকশনে। এছাড়া অনেকেই বিশ্রাম শেষে বীচে ঘুরাঘুরি, চা পান, সামুদ্রিক মাছের বারবিকিউ ও ফ্রাই খাওয়া , মা-বাবা ও ভাই-বোনের জন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আদিব, বশির, আফ্রিদি আমরা রাতের খাবার শেষে রেস্টুরেন্টে সবার বিল বুঝিয়ে দিয়ে এক প্যাকেট আচার কিনে চলে যায় বীচে। চারজন মিলে রাত তিনটা পর্যন্ত বীচে ও আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়ায়।
প্রথম দিনের মতো দ্বিতীয় দিনেও সূর্যোদয় দেখার পালা, কিন্তু বৃষ্টির জন্য হয়ে উঠেনি। পরে সকাল আটটার দিকে চলে যায় আলীপুর মৎস্য আড়তে। সেখানে বাজারে আমিনুর রহমান স্যার ও আন্টি স্যাম্পল কালেকশন করছেন, বাকিরা মাছের সাথে পরিচয় ও ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলো। তারপর আন্দারমানিক নদীর তীরের কাছে সারি সারি ভেসে থাকা মাছের ট্রলারে থাকা ১০-১২ দিনের ফ্রিজিং মাছ পর্যবেক্ষণ করি ও ফটোশপ করে চলে আসি। তারপর ফিরে এসে নাস্তা শেষে ভ্যানে করে চলে যায় কুয়াকাটার রাখাইন পল্লীতে। প্রথমেই দেখি বৌদ্ধমন্দির ও বন্ধ হয়ে যাওয়া বিখ্যাত মিষ্টি পানির কুয়া। তারপর রাখাইন পল্লীতে, রাখাইনদের হাতে বুনা তাত শিল্পগুলো দেখি। স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আমরা অনেকেই সেখানের ঐতিহ্যবাহী কাপড়, শামুক, ঝিনুক, বাহারী রকমের আচার ও খাবার কিনে হোটেলে চলে আসি।
দুপুরের খাবার শেষে আবার ভ্যানের করে সূর্যাস্ত দেখার জন্য ঝাউবন ও লাল কাঁকড়ার চরে যায়। সেখানে সূর্যাস্তকে বিভিন্নভাবে ক্যামেরাবন্দী করে সবাই। তন্ময়ের ভাই মন্ময়ের ড্রোন ক্যামেরায় শেষবারের মতো এক ফ্রেমে বন্দী হয়। ঝাউবন থেকে ফেরার সময় শুটকীপল্লীর কাছাকাছি একটি জায়গায় কে বা কারা যেনো সমুদ্রের উপকূল রক্ষাকারী গাছগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পর্যটক ও স্থানীয়দের চোখে দৃশ্যগুলো পড়লেও প্রতিকার বিষয়ে সবাই যেনো নিরব। এভাবে নিরব থাকলে হয়তো আমার দেশের উপকূল বিলীন হয়ে যাবে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় ঝড়-ঝঞ্ঝা আর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাবে না উপকূলবাসী।
সন্ধ্যায় হোটেল চেক আউট করে বীচে চলে যায় শেষবারের মতো সমুদ্রের স্নিগ্ধ-শীতল হাওয়া উপভোগ করতে। ৬ জন ব্যাচমেট মিলে টুনা মাছ ও অক্টোপাশের বারবিকিউ খেয়ে কিছুক্ষণ বীচে ঘুরাঘুরি করে রাত এগারোটায় ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, ফিশারীজ এন্ড মেরীন বায়োসাইন্স বিভাগ, যবিপ্রবি।