বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না ইবি ছাত্রলীগের
প্রকাশ | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৫২
নতুন বছরেও নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে দিয়ে চলছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগ। একের পর এক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ক্লিপ, বিয়ের কাবিননামা ও হোয়াটসঅ্যাপে লেনদেনের কথোপকথন ফাঁস হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া গত বছরে র্যাগিং, মারামারি, বহিষ্কারের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
২০২২ সালের ৩১ জুলাই ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাতকে সভাপতি ও নাসিম আহমেদ জয়কে সাধারণ সম্পাদক করে ২৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির অনুমোদন দেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি-সম্পাদক। তবে দ্রুতই কমিটি পূর্ণাঙ্গ হওয়ার কথা থাকলেও দেড় বছরেও তা সম্ভব হয়নি বলে সংগঠন সূত্রে জানা গেছে। এ নিয়ে একাধিক পদবঞ্চিত কর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৩ নভেম্বর থেকে শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাতের কণ্ঠসদৃশ একের পর এক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁস হতে থাকে। সর্বশেষ এ বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪টি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয় তার। ওইসব ক্লিপে নিয়োগপ্রাপ্ত ড্রাইভার মিলনের থেকে চুক্তিকৃত ২০ লাখ টাকা নিতে শাখা ছাত্রলীগ সভাপতিকে চাপ দিতে শোনা যায়। এছাড়া অন্য এক চাকরি প্রত্যাশীর কাছে ১০ লাখ টাকা দাবিসহ সভাপতি-সম্পাদকের মধ্যে নিয়োগের টাকা ভাগ-বাটোয়ারার কথা বলতে শোনা যায়। তবে এগুলো সত্য নয় বলে দাবি করছেন শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি।
এদিকে গত ৩০ জানুয়ারি ছাত্রলীগ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের নাম সম্বলিত বিয়ের কাবিননামা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সাড়ে তিন লাখ টাকা দেনমোহরে বৈশাখী খাতুনকে বিয়ে করার কথা উঠে আসে। মুসলিম পারিবারিক রীতি অনুযায়ী ২০২১ সালের ১৩ মে ঢাকার নিকাহ রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে তারা বিবাহ সম্পন্ন করেন। ২৪নং ভলিউমের ৭১নং পৃষ্ঠায় তাদের বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এছাড়া ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের গুলসান-১ এর বিবাহ রেজিস্ট্রার সৈয়দ মাহবুবুর রহমান তাদের বিবাহ পড়ান বলে ওই কাবিননামায় উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও তার হোয়াটসঅ্যাপে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে কথোপকথন ফাঁস হয়। এগুলো ফেক ও এডিট করা বলে দাবি করেছেন শাখা ছাত্রলীগ সম্পাদক।
এছাড়া দেড় বছরের কমিটিতে র্যাগিং, মারামারি, বহিষ্কারের মতো ঘটনাও ঘটেছে। তবে এত কিছুর মাঝে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ফুলপরী ইস্যু। গত বছরের ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের নবীন শিক্ষার্থী ফুলপরীকে রুমে ডেকে রাতভর নির্যাতন ও বিবসনা করে ভিডিও ধারণের অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। নির্যাতনের পরদিন ভয়ে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যান ওই ছাত্রী। এ ঘটনায় ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী। পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ।
পরবর্তী সময়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ছাত্রলীগের নেত্রীসহ পাঁচজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। বহিষ্কৃতরা হলেন শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, ছাত্রলীগ কর্মী ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া, আইন বিভাগের ইসরাত জাহান মীম, ফাইন আর্টস বিভাগের হালিমা খাতুন উর্মী। এর মধ্যে অন্তরা ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের। এছাড়া বাকি সবাই ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
ওই বছরের ৩০ মার্চ লালন শাহ হলের এক আবাসিক ছাত্রকে হল থেকে জোর করে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগ সম্পাদকের পক্ষের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ সময় ভুক্তভোগীর বই, খাতা, তোশক ও বালিশ কক্ষের বাইরের করিডোরে ফেলে দেয় এবং হুমকি-ধামকি দেওয়ার অভিযোগও উঠে।
৩১ মে বটতৈল এলাকায় মেয়েদের জন্য ছিট ছাড়তে বলায় বাসচালককে মারধরের অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি বনি আমিনসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গাড়ির সুপারভাইজার ও হেলপারদেরও বেধড়ক মারধর করে তাদের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়ে নেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী বাসচালক। এ ঘটনায় প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন তিনি।
২০ আগস্ট শোক দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা শেষে ছাত্রলীগ কর্মীদের মাঝে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ সময় ছুরিকাঘাতের অভিযোগও উঠে। পরে ২২ আগস্ট সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে আট কর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করে শাখা ছাত্রলীগ। এছাড়া তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি বরাবর সুপারিশ করা হয়।
এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি এ টি এম এমদাদুল আলমকে লাঞ্ছিতের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ সম্পাদক ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এ সময় তারা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে গালাগাল এবং মারতে উদ্ধত হয় বলে অভিযোগ করেন এমদাদ।
এদিকে ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের চাকরিপ্রত্যাশী সাবেক ও বর্তমান বেশকিছু নেতাকর্মীদের বাধার মুখে নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধের অভিযোগ উঠে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার টাইপিস্ট পদের নিয়োগের জন্য পূর্বনির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শুরু করতে গেলে নেতাকর্মীদের বাধার মুখে পড়ে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া চাকরি প্রার্থীদের পরীক্ষাস্থল থেকে জোর করে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। ফলে নিয়োগ বোর্ড বন্ধ হয়ে যায়।
কাবিননামা ও স্কিনসর্টের বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় বলেন, এগুলো ফেক ও এডিট করা। সংগঠনকে বিতর্কিত করার জন্য এ ধরনের কাজ করা হয়েছে। যারা করতেছে আমি তাদের বিচার চাই।
তিনি আরও বলেন, কমিটি গঠনের পর থেকে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা তাদের ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কোনো ব্যক্তিগত অপকর্মের দায় ইবি শাখা ছাত্রলীগ নেবে না।
পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিষয়ে তিনি বলেন, কেন্দ্রে এ বিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে। অতি দ্রুত কমিটি দেওয়া হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, অনেকে সংগঠনের ভেতরে ঢুকে সংগঠনকে বিতর্কিত করতে চায়। এর দায়ভার সংগঠন কখনো নেবে না। অনেকে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য এগুলো করে থাকে। তবে কেউ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে তার বিরুদ্ধে তারা সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তবে তাকে জড়িয়ে যে অডিও ফাঁস হয়েছে তা আমার নয়। কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তার সম্মানহানির চেষ্টা করছে। এ ঘটনায় তিনি জিডি করেছেন।
কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, যদি কারোর বিরুদ্ধে সঠিক অভিযোগ থাকে তাহলে সে বিষয়টা খতিয়ে দেখবেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটির বিষয়ে তিনি বলেন, আশা করি, দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে।
যাযাদি/ এস