জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) মীর মশাররফ হোসেন হলের কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে বহিরাগত এক নারীকে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেছে শাখা ছাত্রলীগের এক নেতা ও বহিরাগত এক সহযোগী। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর স্বামী জাহিদ বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/০৩) এর ৯(৩) ধারায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) আব্দুল্লাহিল কাফি। এছাড়াও ঘটনায় মুল অভিযুক্তসহ চার জনকে আটক করেছে আশুলিয়া থানা পুলিশ।
ধর্ষণ মামলায় মুল অভিযুক্ত হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক ছাত্র এবং শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলের অনুসারী। এছাড়াও ঘটনায় অন্যান্য অভিযুক্তরা হলেন, ভুক্তভোগীর পূর্ব পরিচিত মামুনুর রশিদ মামুন, একই বিভাগ ও ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসানুজ্জামান, ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাগর সিদ্দিকী, মুরাদ এবং বোটানি ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান। এদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান, সাব্বির হাসান, সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামানকে গ্রেফতার করেছে আশুলিয়া থানা পুলিশ। এছাড়া গ্রেফতারকৃতদের সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
এ ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে রবিবার দুপুর ১২ টায় সংবাদ সম্মেলন করেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) আব্দুল্লাহিল কাফি। সংবাদ সম্মেলন শেষে আসামিদের ঢাকার আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
আব্দুল্লাহিল কাফি বলেন, ‘ভুক্তভোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। একই সাথে আসামিদের ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ন্যাক্কারজনক ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে রবিবার দিনভর বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে সাড়ে ১২টায় মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এসময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল উপাচার্যের কক্ষের সামনে অবস্থান নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে বাদী হয়ে মামলা এবং জড়িত সকলের সার্টিফিকেট বাতিলের দাবি জানান।
এছাড়াও ঘটনার পরপরই শাখা ছাত্রলীগ থেকে আবেদনের প্রেক্ষিতে মোস্তাফিজকে বহিঃষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে দুপুর দুইটায় শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে মানববন্ধন করেন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন তার অনুসারীরা। এছাড়াও বিকাল চারটায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়াও রবিবার সন্ধ্যায় মশাল মিছিলের ডাক দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সাব্বির আলম বলেন, ‘ঘটনা শুনেই আমরা এসে বিস্তারিত জেনেছি। পুলিশ এসেছে, তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা নিবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তাদেরকে সহযোগিতা করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম বলেন, রাষ্ট্রীয় আইনে দোষীদের শাস্তি হবে। আমরা প্রশাসনকে সবোর্চ্চ সহযোগিতা করবো। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দোষীদের সবোর্চ্চ শাস্তি নিশ্চিতের ব্যাপারে জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকেছি। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তার শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
এর আগে, শনিবার রাত সাড়ে ৯ টায় মীর মশাররফ হোসেন হল সংলগ্ন জঙ্গলে এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, শনিবার সন্ধ্যায় পূর্বপরিচিতির সূত্রে ভুক্তভোগীর স্বামী জাহিদকে (বাদী) বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে আনেন মামুন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে তাকে নিয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে (মুরাদের কক্ষ) নিয়ে আটকে রাখেন অভিযুক্তরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকদিন থাকবেন বলে জাহিদকে তার স্ত্রীর মাধ্যমে জিরানীর বাসায় নিজের রেখে আসা জিনিসপত্র আনতে বলেন মামুন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামুনের জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন ভুক্তভোগী নারী। পরে ওই নারীর কাছ থেকে জিনিসপত্র নিয়ে মামুন হলের ভিতরে মুরাদের কক্ষে সেগুলো রেখে আসেন। কক্ষ থেকে ফিরে এসে মামুন ওই নারীকে তার স্বামী হলের অন্য ফটক দিয়ে বের হবেন বলে মোস্তাফিজুরসহ হল সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে যায়। পরে সেখানে তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগী নারী।
এদিকে ধর্ষণের পর ভুক্তভোগী নারীকে ভয়ভীতি ও তার স্বামীকে মারধর করে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে অভিযুক্ত অভিযুক্ত মোস্তাফিজ ও মামুন। তবে ঘটনাটি জানাজানি হওয়ায় প্রতিবাদস্বরূপ মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এসময় তারা বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে রাত ১টার দিকে ভুক্তভোগী নারীকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসে সাভার হাইওয়ে থানা পুলিশ। পুলিশ আসার খবরে হলের ডাইনিংয়ের রান্নাঘরের পেছনের তালা ভেঙে পালিয়ে যান অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর।
রান্নাঘরে থাকা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১টা ১৭ মিনিটে মোস্তাফিজুরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করছে ছাত্রলীগ কর্মী সাগর সিদ্দিকী, সাব্বির হাসান ও হাসানুজ্জামান। তবে রাতভর পালিয়ে থাকার পর রবিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে সাভার মডেল থানায় আত্মসমর্পণ করেন মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর। এছাড়া সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মোস্তাফিজুরকে পালাতে সহয়তাকারী তিনজনকে ভোর ৬টায় আটক করে আশুলিয়া থানা পুলিশ।
যাযাদি/এসএস