দ্রুত পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার লক্ষ্যে নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান যুগের শিক্ষার্থীদের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে মৌলিক শিক্ষার পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি জাতীয় উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। আর কোনো জাতির উন্নত ও দক্ষ জনশক্তি বিনির্মাণ সে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ওপর বহুলাংশে নির্ভর করে। স্ব-স্ব দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতির মজবুত ভিত তৈরি করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্যনতুন ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্রগুলো পৌঁছে যাচ্ছে সফলতার চূড়ায়। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনকে কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়নে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, সেটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম গ্রহণ ও উপবৃত্তি প্রদান, ক্লাসগুলোতে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার, ডিজিটাল হাজিরাসহ স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠনের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন স্মার্ট অবকাঠামোগত সুবিধাসম্পন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্মার্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং দক্ষ, অভিজ্ঞ ও স্মার্ট দেশপ্রেমিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি প্রেরণাদায়ী অঙ্গীকার যার রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরে এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেখানো স্বপ্ন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য নিয়েছে বর্তমান সরকার। যে গতিতে বিশ্বে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে, তা সত্যিই অভাবনীয়। অদম্য গতিতে আমরা চলছি তথ্যপ্রযুক্তির এক মহাসড়ক ধরে। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ রূপান্তরে কাজ শুরু হয়ে গেছে। চারটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তিকরে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্তম্ভ হবে চারটি। যথা: স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটির নীতিগত অনুমোদন প্রদান করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ৩০ মে ২০২২ এই রুপরেখাটিকে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসিসি)। আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে প্রণয়ন করা হয় এই রূপরেখা। জীবন ও বাস্তবমুখী শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে ।
নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ভিত্তিতে সারা বছর ধরে ধারাবাহিক মূল্যায়ন থাকবে। রয়েছে পেশাভিত্তিক শিক্ষা যেন দশম শ্রেণী শেষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একটি করে পেশায় দক্ষতা তৈরি হয়। সকল শিক্ষার্থীকে সকল ধর্মের বই পড়ানো হবে যা যুগোপযোগী, ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধ তৈরি, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করবে। এ বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৪ টি শ্রেণীতে এটি চালু হচ্ছে। ২০২৭ সাল থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পুরোপুরি এটি বাস্তবায়িত হবে। ইতোমধ্যে, সারাদেশে ৬১ টি স্কুল, কারিগরি ও মাদ্রাসায় পাইলটিং করা হয়েছে। এছাড়াও, ব্লেন্ডেড লার্নিং বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এই রূপরেখায়। নতুন এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরী। যদিও এটি বাস্তবায়নের আগে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রস্তুতসহ ১১টি বিষয় বাস্তবায়ন আবশ্যক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে সংশ্লিষ্ট রূপরেখায়। উল্লিখিত শিক্ষা কারিকুলামের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষক সংকট। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যানের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে সরকারি, বেসরকারি কিন্ডারগার্ডেন ও এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়সহ মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি এবং শিক্ষার্থী প্রায় ২ কোটি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৬২০টি, শিক্ষক ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৬ জন এবং শিক্ষার্থী ১ কোটি ৪১ লাখ ৪৪৫ জন। দেখা যায়, সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গড়ে ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে ৩৯ জনের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। দেশে ২০ হাজার ৬০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন এবং শিক্ষক ২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৫ জন। অর্থাৎ ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী প্রায় ৪২ জন। এছাড়াও ৪ হাজার ৫৫১টি কলেজে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার ২১০ এবং শিক্ষক ১ লাখ ২৭ হাজার ৭৬৭ জন(ব্যানবেইস)। এছাড়াও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সংকট তো রয়েছেই। গ্রামের স্কুলগুলোতে এই সংকটটি প্রকট হয়ে দাঁড়াবে। ফলে শহর ও গ্রামে মানসম্মত শিক্ষায় একটা বৈষম্য তৈরি হবে। তাই এটি এড়াতে সকল স্কুলে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভাগ ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন কারিকুলামের সাথে শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধনে প্রয়োজন অধিক যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক। তাই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকল শিক্ষকের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন শিক্ষা কারিকুলামের সাথে শিক্ষার্থীরা যাতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে তার জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘টিচার গাইড’। টিচার গাউড অনুসরণ করে শিক্ষকোরা প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন শিক্ষার্থীদের। নতুন কারিকুলামের সাথে যুক্ত হয়েছে আইসিটি ও বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার। এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নিশ্চিত করা নতুন কারিকুলামের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আরও উন্নত ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় নিয়ামক মানসম্মত বই তৈরি। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক যদি কারিকুলামের সাথে সংগতিপূর্ণ না হয় তাহলে পুরো পরিকল্পনাই অধরা রয়ে যাবে। তাই নতুন পাঠ্যপুস্তক নির্ধারণ বড় দায়িত্ববোধের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। অভিভাবকদের সচেতনতার বিষয়টিও গুরুত্বের সংঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কারন নতুন শিক্ষাক্রমের সাথে ছাত্রছাত্রীদের পরিচিত করা ও তাদের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবেন অভিভাবকেরাই। তাই অভিভাবকদের নতুন কারিকুলামের ইতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে জানাতে হবে ও সচেতন করতে হবে। কোনো পরিকল্পনা তৈরির পর উল্লেখযোগ্য করণীয় হলো তা যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়মিত মনিটরিং এর আওতায় রাখা। নতুন কারিকুলামের বাস্তবায়ন যেন যথাযথ হয় ও প্রত্যেকটি নির্দেশনা মেনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় তার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যালয় এবং শিক্ষকদের নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর। বর্তমান শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীগণ মানবিক মানুষ হয়ে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন করবে। সর্বপরি স্মার্ট ক্লাসরুম, স্মার্ট শিক্ষাপ্রদান ব্যবস্থা, স্মার্ট শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এবং স্মার্ট শিক্ষক গঠনের মাধ্যমে আগামী বাংলাদেশ পাবে স্মার্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়।
লেখক: মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম,উপজেলা নির্বাহী অফিসার , গফরগাঁও, ময়মনসিংহ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতকোত্তর ।
যাযাদি/এসএস