সফলতার ৫৪ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

প্রকাশ | ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৪

শিহাব উদ্দিন, জাবি

দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। স্বাধীনতার সমবয়সি বিশ^বিদ্যালয়টি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস ও ঐতিহ্যে অনন্য স্থান দখল করে আছে। 

১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে বিশ^বিদ্যালয়টি। দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় গৌরব ও ঐতিহ্যের ৫৩ বছর পেরিয়ে ৫৪ বছরে পদার্পণ করল সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত জাবি। দীর্ঘ এ পথচলায় বিশ^বিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে বিশ^বিদ্যালয়টির অর্জনের ঝুলি হয়েছে পূর্ণ।

১৯৭০-১৯৭১ শিক্ষাবর্ষে অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত ও পরিসংখ্যানÑ এ চারটি বিভাগে প্রথম ব্যাচে ১৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ^বিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আহসান বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রজেক্ট ডাইরেক্টর ছিলেন ডক্টর সুরত আলী এবং বিশিষ্ট রসায়নবিদ অধ্যাপক ডক্টর মফিজ উদ্দিন আহমদ প্রথম উপাচার্য হিসেবে এ বিশ^বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব নেন। সে সময় বিশ^বিদ্যালয়ের নাম ছিল ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়’। ১৯৭৩ সালের এক অধ্যাদেশ অনুযায়ী মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে নাম রাখা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়। মূলত গবেষণাভিত্তিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান বিশ^বিদ্যালয়ে ৩৪টি বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউটের অধীনে ৭২৫ জন শিক্ষক এবং ১২ হাজার ৫৩৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে বিশ^বিদ্যালয়টি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই)’ সম্প্রতি বিশে^র ১০৮টি দেশের ১ হাজার ৯০৪টি বিশ^বিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং তালিকা প্রকাশ করেছে। শিক্ষা ও গবেষণার মান, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারী অনুপাত, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীসহ ১৮টি পারফরম্যান্স সূচকের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ের এ তালিকায় দেশের মধ্যে সেরা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়। 
বিশ^বিদ্যালয়ের এমন সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। এ লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন উপাচার্য।

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে জাবির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল পদাঙ্ক। এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শতাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, যা বিশ^বিদ্যালয়কে সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশের নাট্যাঙ্গনে বিশ^বিদ্যালয়টির রয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব। নাট্যকার সেলিম আল দীনের সাহচর্যে এই অঙ্গনে আরও কয়েক ধাপ এগিয়েছে বিশ^বিদ্যালয়টি। তাছাড়া এখানে রয়েছে শিক্ষার্থীদের নাট্যচর্চার অন্যতম মঞ্চ ‘সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ’, নির্মিত হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার। এছাড়াও ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত ‘অমর একুশে’ ও অকুতোভয় সৈনিকের আদলে নির্মিত ‘সংশপ্তক’ জাতিকে দেশপ্রেমের প্রবল মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণা যোগায় প্রতিনিয়ত। বীরত্বগাথা এসব স্থাপনা যেন প্রতিনিয়ত শ্রেষ্ঠত্বের জানান দিচ্ছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও অতুলনীয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়। শীত মৌসুমে এখানকার স্বচ্ছ পানির লেকে আসে হরেক রকমের অতিথি পাখি। লেকগুলোতে ফুটে থাকা লাল শাপলার বুকে এসব পাখির জলকেলি মুগ্ধ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীদের। বিশাল জলাশয়যুক্ত বিশ^বিদ্যালয়কে পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। প্রতিবছর পাখি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অনুষ্ঠিত হয় পাখি মেলা। এছাড়া এখানে প্রজাপতির সংরক্ষণ ও প্রজনন বৃদ্ধির জন্য রয়েছে ‘প্রজাপতি পার্ক’। প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ শোভাবর্ধনকারী অনুষঙ্গ এসব প্রজাপতি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতি বছর এখানে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্রজাপতি মেলা’। বিজ্ঞান গবেষণার জন্য এ বিশ^বিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’। তাছাড়া সবুজ গাছপালায় ঘেরা লাল ইটের ক্যাম্পাস যেন এক টুকরো ভূস্বর্গ হিসেবে টিকে আছে বছরের পর বছর। এখানে ছেলেদের জন্য ১১টি এবং মেয়েদের জন্য ১০টি আবাসিক হল রয়েছে। সাময়িক সিট সংকট থাকলেও এসব কৃত্রিম সংকট কাটিয়ে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক রূপে জাবিকে ফেরাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রশাসন।

দীর্ঘপথ পরিক্রমায় বিশ^বিদ্যালয়টি পেয়েছে অসংখ্য গুণী মানুষের সংস্পর্শ। এসব ব্যক্তিদের সংস্পর্শে বিশ^বিদ্যালয় পরিচিত হয়েছে বিশ^দরবারে। তাদের মধ্যে প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, লেখক হায়াৎ মামুদ, লেখক হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান, রসায়নবিদ অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, ডক্টর সৌমিত্র শেখর, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আনু মুহাম্মদ, অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি, শহীদুজ্জামান সেলিম, জাকিয়া বারী মম, সজল নূর, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম প্রমুখ অন্যতম।

স্বাধীনতার দীর্ঘদিনে জাবির প্রাপ্তি নেহায়ত কম নয়। তবে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির সমীকরণে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে কল্পনাতীত। নির্মিত হচ্ছে লেকচার থিয়েটার ও পরীক্ষার হল, যেখানে একসঙ্গে ৮ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। এমনকি নির্মাণাধীন রয়েছে স্পোর্টস কমপ্লেক্স ও ছয়তলা বিশিষ্ট নতুন লাইব্রেরি ভবন। তবে এসব উন্নয়নের ফলে নষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। এমনকি গবেষণা কার্যক্রমেও বেশ পিছিয়ে বিশ^বিদ্যালয়টি। তাছাড়া পূর্ণাঙ্গ আবাসিক রূপে ফেরানোর প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ প্রশাসন। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখনো গণরুম কিংবা মিনি গণরুমে অবস্থান করতে হয় শিক্ষার্থীদের। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে শিক্ষা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ ফেরাতেও বেশ পিছিয়ে বিশ^বিদ্যালয়টি।
তবে প্রতিষ্ঠার ৫৪ বছরে বিশ^বিদ্যালয়ের সব সংকট কাটিয়ে জাবিকে বিশ^মানের বিশ^বিদ্যালয়ে রূপান্তরের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে জানিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর মো. নূরুল আলম বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে আমরা দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি। সংকট কিছুটা থাকলেও তা উত্তরণের চেষ্টা করছি। নতুন হলগুলো চালু হলেই আবাসন সংকট আর থাকবে না। ইতোমধ্যে বিশ^বিদ্যালয় ডি-নথির যুগে প্রবেশ করেছে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন নতুন লাইব্রেরির কাজ শেষের দিকে। উত্তরোত্তর আমরা সফলতার দিকেই যাচ্ছি। এই ধারা অব্যাহত রাখতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’

যাযাদি/ এস