রোববার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বারবার হোঁচট খাচ্ছে সুনীল অর্থনীতির স্বপ্ন

আলতাব হোসেন
  ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৫
আপডেট  : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪২
ছবি: সংগৃহীত

সুনীল অর্থনীতির (ব্লু-ইকোনমি) অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। নৌপথ ও সমুদ্র অর্থনীতি হবে আগামী বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী উৎস। অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত হতে পারে ব্লু-ইকোনমি। ব্লু-ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। সামুদ্রিক সম্পদের এক বিশাল আধার হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। সমুদ্র সম্পদ ঘরে তুলতে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তারপরও সমুদ্র অর্থনীতি ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন বারবার হোঁচট খাচ্ছে।

বঙ্গোপসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক ঠিকাদার বাছাই করতে ৬ বছর পর দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৯ সালে অফশোর বিডিংয়েও উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাতিল করা হয়। ওই বছর তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও অংশীদারত্ব নিয়ে চুক্তির খসড়া নীতিমালা (মডেল পিএসসি) তৈরি করেছিল পেট্রোবাংলা। তা আকর্ষণীয় না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এতে হোঁচট খায় সমুদ্র অর্থনীতি ঘিরে নতুন স্বপ্ন। এরপর ২০২৩ সালে আরেকটি মডেল পিএসসি তৈরি করা হয়। আন্তর্জাতিক জ্বালানি কোম্পানিগুলোর কাছে বঙ্গোপসাগরে খনিজ সম্পদ আহরণের কাজকে আকর্ষণীয় করে তুলতে নতুন পিএসসিকে ঢেলে সাজানো হয়। এটিকে বিনিয়োগ আকর্ষণের উপযোগী করে তোলা হয়। বিদেশে বিনিয়োগ বিষয়ক বিভিন্ন রোড শোতে সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়টিকে সামনে রাখা হয়। দেশের সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। দরপত্র জমা দিতে সময়ও বাড়ানো হয়। ২ বছর ধরে এসব প্রচেষ্টার পর এবারও হোঁচট খেলো সুনীল অর্থনীতির স্বপ্ন।

বঙ্গোপসাগরে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এবার যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সাতটি কোম্পানি দরপত্র সংগ্রহ করে। চলতি বছরের ৯ ডিসেম্বর দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। নির্ধারিত সময় একটিও প্রস্তাব জমা হয়নি। পেট্রোবাংলার পরিচালক প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ যেন অধরাই থাকছে সুনীল অর্থনীতির হাতছানি।

বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক আছে। অগভীর সমুদ্রের দু'টি ব্লককে অনুসন্ধান পরিচালনা করছে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি। বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে ২৪টি ব্লককে (গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ৯টি) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করা হয় চলতি বছরের ১১ মার্চ।

দরপত্র জমার জন্য ৬ মাস (৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সময় দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আরও তিন মাস সময় বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে দরপত্রে নয় মাস (৯ ডিসেম্বর-২০২৪ পর্যন্ত) সময় বাড়িয়েও বাংলাদেশ এবারও হোঁচট খেলো সমুদ্রনিভর্র অর্থনীতি স্বপ্ন।

পেট্রোবাংলার গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট ছাড়াও ২২০ প্রজাতির সি-উইড বা শ্যাওলা, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস রয়েছে। সুনীল অর্থনীতির (ব্লু-ইকোনমি) অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত হতে পারে ব্লু-ইকোনমি। বব্লু-ইকোনমি হচ্ছে সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। সামুদ্রিক সম্পদের এক বিশাল আধার হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমার মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তির পর বঙ্গোপসাগরে জলরাশির সুবিশাল এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) ও মহীসোপান অঞ্চলে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম অধিকার সুনিশ্চিত করে আদালতের রায়- যার আয়তন প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান। সমুদ্র থেকে আহরণকৃত যে কোনো সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়, তাই বস্নু-ইকোনমির বা সুনীল অর্থনীতির পর্যায়ে পড়ে। সমুদ্র পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশাল এ জলসীমাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ. কে. এনামুল হক বলেন, সমুদ্র থেকে নবায়নযোগ্য শক্তি, টেকসই শক্তির উৎস হিসেবে ব্লু-ইকোনমির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রচলিত উপকূলীয় অঞ্চল এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য অনন্য এবং টেকসই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আয়তন ৬৬৪ কিলোমিটার, কিন্তু মাছ আহরণ করা হয় মাত্র ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে। আর তাই মাছের বৈশ্বিক উৎপাদনে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। শুধু মাছ কিংবা খনিজ সম্পদ নয়, নিজেদের সীমানার সাগরকে ব্যবহার করে পাল্টে দেওয়া যেতে পারে বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতির চিত্র। সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন, জাহাজ শিল্প, গভীর সাগরে মাছ ধরার উপযোগী জাহাজ নির্মাণ, কনটেইনার, ওষুধ, প্রসাধনীসহ নানা শিল্প বিকশিত হতে পারে। এর জন্য দরকার সঠিক কর্ম-পরিকল্পনা ও তার যথার্থ বাস্তবায়ন। আগামীতে বিশ্বের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে সমুদ্রকেন্দ্রিক। বব্লু-ইকোনমিকে কাজে লাগাতে পর্যটন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, ফিশিং, বন্দর, মেরিটাইম ইক্যুইপমেন্ট খাতে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাসসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্র্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর পাঁচ লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব।

বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন সেভ আওয়ার সি'র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমুদ্রের তলদেশে পস্ন্যাটিনাম, কোবাল্ট, মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ, তামা, সিসা, জিঙ্ক ও সালফাইড রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামালের সন্ধান পাওয়া গেছে। বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর তলদেশে মহামূল্যবান ধাতু ইউরেনিয়াম রয়েছে। বাংলাদেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ হয় সমুদ্রপথে। তাছাড়া বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় দুই হাজার ৬০০ জাহাজের মাধ্যমে ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। এসব জাহাজ থেকে ভাড়া বাবদ আয় হয় ছয় বিলিয়ন ডলার। সমুদ্রসম্পদকে কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বৃদ্ধি এবং মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সমুদ্রের তলদেশে খনিজসম্পদের যে ভান্ডার রয়েছে, তা আহরণ করা গেলে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি আরও মজবুত হবে।

এ বিষয়ে খনিজসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ড. সামসুল ইসলাম বলেন, সমুদ্র বিজয় নিয়ে যতটা মাতামাতি হয়েছে, সমুদ্র অর্থনীতি অর্জন ঘরে তুলতে তেমন উদ্যোগ নেই। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এলাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ। খুলে দিতে পারে অর্থনীতির নতুন দুয়ার। গভীর সমুদ্রের নীল জলের পরতে পরতে অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা এখনো আমাদের অজানাই রয়ে গেছে। সমুদের টুনা জাতীয় মাছ আহরণ এখনো সম্ভব হয়নি। নন-লিভিং সোর্সের মধ্যে তেল, গ্যাস এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের বিশাল সম্ভার রয়েছে। পর্যটন সম্ভাবনাও জোরালো হচ্ছে। প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশ সমুদ্র সম্পদ আহরণে পিছিয়ে আছে। এখনো গভীর সমুদ্রে আমাদের জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারে না। অফুরন্ত সম্পদ লুকিয়ে আছে আমাদের সমুদ্রে। তেল ও গ্যাস ছাড়াও আছে বিপুল সম্পদ। সমুদ্রসম্পদের অর্থনৈতিক ভূমিকা বিশাল। সাম্প্র্রতিক সময়ে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ-পূর্ব থেকে শুরু করে সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের দিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ৭১০ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্যসম্পদ ছাড়াও বাংলাদেশের সমুদ্র-তীরবর্তী এলাকা তেল ও গ্যাসের একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু-ইকোনমি বা নীল অর্থনীতির ধারণা দেন। বিশ্বের ৪৩০ কোটিরও বেশি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তৈল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। চীন, জাপান, ফিলিপাইনসহ বেশ কিছু দেশ ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগেই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকান্ড হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে থাকে। ২০২৫ সালে এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সে দেশের সরকার।

যাযাদি/ এসএম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে